প্রকৃতির নিয়ম মেনে, কালের ধারায়,
ঋতু বদলের পর্যায় মেনে আবার এসেছে বসন্ত। এ নববসন্তের অর্ধেকটা পথ ইতোমধ্যেই
পেরিয়ে এসেছি আমরা। এই
মধ্য বসন্তে চরাচর জুড়ে যে রঙিন আদল, যে প্রস্ফুটিত কুসুমের সুবাস, মনমাঝে যে উতলা আবহ এতে বোধ করি সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত হয় প্রেমিক মন আর কবির
হৃদয়। তাই
তো বসন্তেই আসে বিশ্ব কবিতা দিবস। কবির কলমে উৎসারিত হয় রঙের আভাস, প্রেমের আবেশ আর বিরহী
হৃদয়ের আকুল আর্তি।
সবাকার একান্ত নিজস্ব অনুভবে, ছন্দে - কথায় বসন্তের এই দোলা, এই আনন্দের বার্তাটুকুই এসে আজ ধরা দিয়েছে কবিমানসে - স্বতঃস্ফুর্ততায়। ধরা দিয়েছে কবি নিশুতি মজুমদারের ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ কবিতায় -
বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
নিশুতি মজুমদার
বসন্ত এসেছে আজ উন্মনা মন
চারিদিকে প্রকৃতির নব জাগরণ,
কোকিলের কুহুতান অমল প্রভাতে
কিশলয় গাছে গাছে ভ্রমরের সাথে।
ফুলে ফুলে ভরে আছে বৃক্ষলতা যত
মন যেন উড়ু উড়ু সদা অবিরত।
সব কিছু ঠিকঠাক, তবু মনে হয়
পলাশ, শিমূল আজ পরিপূর্ণ
নয়।
চারিদিকে মানুষের হীন আগ্রাসন
সুন্দরতা হারিয়েছে বন উপবন।
চৈতন্যের দ্বার খুলে দাও ভগবান
আনন্দে প্লাবিত হোক সকলের প্রাণ।
বসন্ত মানেই ফাগুন। চৈতি হাওয়ায় উড়ু উড়ু মন। ফাগুন মানেই আবির গুলাল। যে কবি-মন বসেই থাকে পথ চেয়ে আর কাল গুনে, সেই কবির সামনেই অধরা এসে ধরা দেয় ফাল্গুনে। আর সেই আবেশেই পরান ছুটে যায় নেশায় নেশায়, রঙের ছোঁয়ায় - কবি মধুমিতা দত্তের কবিতা ‘ফাগুন দোলা’য়...
ফাগুন দোলা
মধুমিতা দত্ত
আয়রে সবাই আয় ধেয়ে
পলাশ ফুলের রঙ ছেয়ে,
বুকের ভেতর ফাগুন দোলা
চল না সবাই করবো খেলা।
রঙের নেশায় মন মেতেছে
পলাশ ফুলে রঙ লেগেছে,
বসন্ত যে দাঁড়িয়ে দ্বারে
কোকিল ডাকছে ওই সুরে।
আগুন রাঙা ওই আকাশে
আবির গুলাল মন তিয়াসে,
ছুটলো পরান রঙের ছোঁয়ায়
চল না ছুটে ওই নেশায়।
এমন দিনে মনের কোণে
থাকব না তো বসে,
রঙের নায়ে ভেসে যাব
সাতরঙা ওই দেশে ।
ধূসর মলিন জীবনটাকে
পরাই রঙের সাজ,
পিচকারিতে রং ভরেছি
খেলব হোলি আজ।
হে বসন্ত, হে ঋতুরাজ - কবিমন আজ তোমার আবাহনে আনমনা। এই প্রকৃতি, এই ধরাধাম তোমারই আগমন বার্তায় আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেয় রং আর খুশির সুরেলা বাহার। তোমারই আবাহনে দিকে দিকে ধ্বনিত হয় কুহুরব, তরুশাখে পল্লবিত হয় নবকিশলয় বৃন্ত। ঝরা পাতার আবহেও নবরূপে সেজে ওঠে বনানী। তোমাকে স্বাগত জানাতে নিবেদন কবি সুস্মিতা মজুমদারের আগমনি কবিতা - ‘ঋতুরাজ’
ঋতুরাজ
সুস্মিতা মজুমদার
ঋতুরাজ তুমি চিরযৌবনের প্রতীক।
পলাশ শিমূল রক্তরাঙা সাজে
তোমায় বরণ করে,
কোকিল সুমধুর গান গেয়ে
তোমায় আনন্দিত করে।
আবিরের রঙে ধরাতল রঙিন হয়ে ওঠে,
বৃক্ষ তরুলতাও পুরাতন সাজ ছেড়ে
নতুন সাজে সেজে ওঠে।
বাতাসও বাঁধনছাড়া পাগলপারা উল্লাসে মাতে,
ফাগুনের উদাসী হাওয়ায় -
আপনজনকে কাছে পেতে
মন আকুলিবিকুলি করে।
ঋতুরাজ বসন্তের এই অনাবিল স্নিগ্ধ, শান্ত রূপের গভীরতায় কবি মন খুঁজে ফেরে শান্তির অনন্ত আবহ। মোহন বাঁশির ফাল্গুনি সুরে দূর হোক যত বিষণ্ণতা, যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে স্নিগ্ধ বসন্ত আসুক ঝেঁপে। সৃষ্টিমগ্নতায় কবি সপ্তমিতা নাথ তাই তো আঁকেন বসন্তের আলপনা।
এল ফাগুন
সপ্তমিতা নাথ
আঁকড়ে ধরা জড়সড় শীত শেষে,
কি যে মায়াবী মধুর কোকিল ডাকে,
শিশিরের গায়ে বসন্তের আলপনা,
টিমটিম আলোয় পদ্ম পাতায় জোনাকির
বাসর।
দক্ষিণা হাওয়ায় বাজে মোহন বাঁশির সুর,
বসন্তের হাত ধরে এল ফাগুন,
ব্যথা-জড়ানো বিরহ ভরা স্বপ্ন
ভোরে।
এ যে, বসন্ত আজি রঙিন কথা বলে।
রঙিন ফুলতটে বসন্ত আজি গায় গান,
দিগবিদিক সুবাসিত, পথে পথে শিমুল
পলাশ কাঠগোলাপ।
ধ্বংস হোক বিষণ্ণতা শান্তি আসুক
পূর্ণিমার ফাগুনে,
দোলের আবিরে সাজুক, হাজার প্রেমের
গল্প এই বসন্তে।
বসন্ত মানেই নিত্য নতুন উদঘাটন। কিছু আনমমা ভুল, পেয়ে হারানোর কিছু অকারণ ভয়, আর গোলাপি খামের চিঠি। কবি ঋতা চন্দের উদঘাটনে আদ্যোপান্ত মধুময় হয়ে ওঠে এই আনচান বসন্ত, এই মধুমাস …।
মধুমাস
ঋতা চন্দ
বসন্ত মানেই অকারণ শিহরণ
বুকের ভেতর ভ্রমরের গুঞ্জন
শিমূল-পলাশ আর মাতাল হাওয়া
অকারণে বারবার শুধু পথ চাওয়া।
বসন্ত মানে চাঁদ, ফুল আর কিছু ভুল
বসন্ত মানে প্লাবিত হৃদয়ের দুকূল।
বসন্ত এলে জীবনে আসে জোয়ার
অকারণ ভয়, পেয়ে হারাবার।
বসন্ত আনে যৌবনের চিঠি গোলাপি খামে
ফাগুয়ার রঙে ভালোবাসার বৃষ্টি নামে।
আকুল প্রাণ ব্যাকুল করে কোকিলের কুহু
মধুমাস কাল হয়, পরানটা করে হু হু।
বসন্তে জীবন খুঁজে পায় জীবনের মানে
মধুমাস মধুময় হয় মহুয়ার টানে।
নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ার পরশে একদিকে যেমন বুকের ভেতর বয়ে যায় দমকা দমকা বাউল বাতাস, অন্যদিকে আবার বনে বনে জেগে ওঠে শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া। পাশাপাশি আবার আবিরসিক্ত মনোবনে কুহু রবে অকারণে কবি মীনাক্ষি চক্রবর্তীর কবিতায় ফিরে ফিরে আসে মন-উচাটন।
আবিরসিক্ত বসন্তোচ্ছ্বাস
মীনাক্ষি চক্রবর্তী
অষ্টাদশী প্রকৃতি জুড়ে মুখর বসন্তের সঘন আন্দোলন
শীতকাতর কুয়াশার হিমভরা অভিমান সরে
গেছে কখন
ফাগুন হাওয়ায় মন উতলা
বুকের ভিতর বাউল বাতাস,
একতারাতে গুঞ্জনতান অনুরাগে ভরা
ফল্গুধারায় প্রেম বয়ে যায় দুর্দম।
আবিরসিক্ত অলিন্দ ঘিরে বসন্তোচ্ছ্বাস টালমাটাল
প্রেমের ফাঁদ পেতেছে ঋতুরাজ ঘোর ফাল্গুনে
দিকে দিকান্তরে জ্বলে রংমশাল, হৃদয় ভাসে প্লাবনে
ভালোবাসার আসর বসে আগুনরাঙা, শিমুল পলাশ কৃষ্ণচূড়া
দখিনা বাতাস দোল দিয়ে যায় মনোবনে, সঙ্গোপনে
গাইছে কোকিল কুহু কুহু, মন উচাটন অকারণে।।
কবি, কবিতা ও বসন্ত। ফাগুন দোলায়, চৈতি হাওয়ায় শুধুই কি প্রেমের জয়জয়কার, ভালোবাসারই সংসার ? নিশ্চিতভাবেই নয়। প্রেমেরই অনুষঙ্গ হয়ে সমান গরজে, সমান বিস্তৃতি, বিশালতা নিয়ে আসে বিরহ। কুহু রবের আর্তি নিয়ে, পথ চেয়ে বিরহে আকুল হয় প্রেমিক মন। কবি বিমলেন্দু চক্রবর্তীর কবিতার ক্যানভাসে উদভাসিত হয় পূর্ণিমার চাঁদ।
বিরহে আকুল
বিমলেন্দু চক্রবর্তী
তুমি আসবে, তাইতো এত আয়োজন
আমের মুকুল ঝরে, ফোটে নাহরের ফুল
দক্ষিণ সমীরণে ওড়ে ভ্রমর, ভাসে ফাগুয়ার গান
এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে মাটি, ছাড়ে ঘ্রাণ
মৃত পাতাগুলো বড়ই ধূসর, মলিন সব পুরাতন
বিষাদের নৌকাগুলো ভেসে যাবে, নিয়ে সব অভিমান
বাউলের একতারায় সুরেলা বসন্তের গান, প্রেমের গান
তোমার আসার পথ চেয়ে পূর্ণিমা চাঁদ
জাগে,
বিরহে আকুল।।
বহু না-বলা কথারা এসে সঙ্গোপনে বাসা বাঁধে এই পাতাঝরা বসন্তে। অনুচ্চারিত থেকে যায় খেলাপি কথার কথামালা। খেই হারিয়ে যায় বহু কথার। গোলাপ আর রজনীগন্ধায় বিভ্রম জাগে হৃদয়কুঠুরিতে। উদভ্রান্ত যাপনে উথলে ওঠা কথারা জায়গা করে নেয় কবি মধুমিতা সেনগুপ্তের কবিতায় গভীর সন্তাপে। দমকা হাওয়ার উর্মিমালায় রচিত হয় বসন্ত-কথা......
বসন্ত কথা
মধুমিতা সেনগুপ্ত
সেদিনও ছিল সেই বসন্ত।
যেদিন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা না গোলাপ ?
বিষয়টা জড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার।
কিংবা পাতাঝরা অজস্র দমকা হাওয়ায়
এ কথা না ও-কথা ? সব কথারা
তরঙ্গে ছিল ভাসমান।
আরো অনেক বসন্তে হেঁটেছি পথ
এভাবেই। অর্থহীন শব্দের পিছু পিছু
বারবার। কত শ্রম, যুদ্ধ, রক্তে ভেসে গেছে
যে পথ, সে পথেই এক অলীক বসন্ত
খুঁজি।
সেদিনও সেই বসন্ত ছিল,
যেদিন এক নতুন বসন্তে
কোথাও দূর তেপান্তরে
দেখা হবার কথা ছিল।
কথা ছিল, সব কথা ফেলে
এক নতুন কথার বুনোনে
বাঁধা পড়ার, গভীর সন্তাপে।
নীড়হারা পাখির আগমনের প্রতীক্ষায় প্রেমিক পক্ষী, সোহাগের দিব্যি দিয়ে তাকিয়ে থাকে পলাশপথে। বিরহে কবিমন জুড়ে লেখা হয় ইতিহাস, সুখদিনের কড়চা। কবি অতীন্দ্রবিজয় চৌধুরীর কলমে জীবন্ত হয়ে ওঠে বিরহে আকুল হয়ে প্রেমিকের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা অনন্ত কালের সাতকাহন।
পলাশমন
অতীন্দ্রবিজয় চৌধুরী
একবুক কৃষ্ণচূড়া নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছি অনন্ত ।
ফিরে গেছে পাখিদের ঝাঁক
তোমার সুখের আশ্রয়ে।
ঝরে যারা পড়েছিল
তোমার এলোচুল বেয়ে
আলতো চুম্বনে বাতাস
দিয়ে যায় -
কালকের সোহাগের দিব্যি।
আমি তো তাদেরই দলে।
পলাশ মাখা বিকেল
চেয়ে থাকি -
যদি ভরে দিয়ে যায়
আকাশের গল্পে আর গানে।
তোমায় শেষ দেখার পরে
বদলে বদলে গেছে আশপাশ।
ফিরে যদি আস -
জেনো তোমারই জন্য
দাঁড়িয়ে ছিলাম অনন্ত।
উদাসী বাউল-বাতাসে কবির অন্তরের যাবতীয় ইচ্ছেরা ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় যত্রতত্র। কবিমন বাসন্তী হয়ে ওঠে, যখন পাথর-ভাঙা মেয়েটি হলুদ শাড়িতে নেচে ওঠে। পাখিদের গল্প-বিলাসী গোধূলিতে আর প্রতিবাদী মিছিলে কবি মুন চক্রবর্তী লিখে রাখেন শপথের গান - আজি এ বসন্তে......
আজি এ বসন্তে
মুন চক্রবর্তী
জরাজীর্ণ ঝরে যাওয়া হলুদ পাতায় ইচ্ছে গুলোকে লিখে দিলাম
বসন্তের ফাগুন বাতাসে পলাশের রঙে রাঙানো ঋতুরাজ
আমি আমের মকুলের কাছে হাত পেতে চেয়ে নেই জীবন
শুকিয়ে যাওয়া নদী সরোবরে উড়িয়ে বেড়াই ফসলের সুগন্ধ
পাথর ভাঙা মেয়েটি যখন হলুদ শাড়িতে নেচে উঠে
আমি বাসন্তী হয়ে উঠি।
অশত্থ গাছের ছায়ায় রাগ রাগিনী করে মন আনন্দে
প্রতিবাদী মিছিলে আবির ছড়িয়ে শপথের গান শুনি
পাখির গল্প বিলাসী গোধূলিতে হলুদ পাতায় প্রেম উপখ্যান লিখে রাখি
উদাসী বাউল বাতাসে একতারায় শুনি
‘আজি এ বসন্তে’ - চৈতি আনন্দে।
ফাগুন এলেই বসন্ত আসে ঝেঁপে। তাই উতলা হয় কবির অন্তর। বসন্ত আর ফাগুন বন্দনায় মন হয় উদ্বেল। কবি লিপি চক্রবর্তীর কবিতায় ফাগুন আসে, পুরো বসন্ত উঠে আসে পলাশ, শিমূল, কেতকী, কিংশুকের আবহে, রঙে রঙিন হয়ে -
এসেছে ফাগুন
লিপি চক্রবর্তী
এসেছে ফাগুন, রঙের আগুন
ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে দ্বারে,
একমুঠো রঙ ছড়িয়ে দিয়ে
পলাশ শিমুল কৃষ্ণচূড়ায় বাহারি রং ধরে।
রক্তিম সাজে পলাশ শিমুল ডাক দেয় আবেশে
অশোক, কিংশুকে ভরা যৌবন
ফাগুনের রঙ মেখেছে।
ভ্রমর গুঞ্জনে কেতকী আড়ালে
অনুরাগের ছোঁয়া লাগে
দখিনা হাওয়ার মর্মর ধ্বনি
বসন্ত বাহার জাগে।
কোকিলের কুহু তানে পঞ্চম সুর
নব কিশলয়ে বসন্ত এসেছে
বলে দ্বার খোল দ্বার খোল।
পলাশের রঙে রেঙেছে হৃদয়
অন্তরে কলরব
ছোটদের সাথে পিচকারি হাতে
ডাক দেয় শৈশব।
মিলনের বাঁশি সুরের আকাশে
উচ্চ সপ্তকে বহমান
দিগন্ত রেখায় অধীর প্রতীক্ষা
ঋতুরাজ বসন্তে হোক তবে অবসান।
সমাপ্তিরেখায় যখন পৌঁছে যায় বসন্ত, ফাগুন পেরিয়ে তখন চৈত্রবনে লাগে নতুন আর পুরাতনের টালমাটাল হাওয়া। বিগত বসন্তের শপথ আর বৈশাখী ঝড়ে ছিন্নভিন্ন অঙ্গীকার যাপন শেষে আবারও এক বিকেলে পাতাঝরা পথের পাশে মাথা তুলে দাঁড়ায় নাম না জানা পত্রবাহার। তখনই মনে হয় বসন্ত শুধুই ফাগুন নয়। এমনই চৈতি বসন্তে চরাচর জুড়ে লেখা হয় বসন্তগান। কবি বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কবিতায় ধরা থাকে চৈতি গাথা আর বাসন্তী কথা।
হাজার বসন্ত শেষে
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
সেদিনও তো ছিল চৈত্র মাস
চোখে চোখে কথায় কথায়
হাজারজনের অথই সর্বনাশ।
বসন্ত বাতাসে ওড়ে স্বপ্নতরীর পাল
ঝরা পাতার ফিসফিস কথামালা
একবুক ধুকপুক পা টালমাটাল।
কবে কোন বসন্তশেষের বেলা
শিমূল পলাশে জেগেছিল চরাচর
নভোনীলে ছিল সুখপাখির মেলা।
এরপর এক বৈশাখে মন-বাতায়ন জুড়ে
অকালবোশেখির দাপাদাপি।
বৈশাখী দামাল ঝড়ে কোথা গেল উড়ে উড়ে
রয়ে গেল শুধু মনখারাপি।
এই পৃথিবীর বুকে হাজার বসন্ত শেষে
আছে শুধু বৈশাখী কথার খেলাপি।
নতুনের আহ্বানে নিজেকে যে করে নিঃশেষ
ডেকে আনে নিজেরই বিনাশ
সে-ই তো বসন্ত, সে-ই তো চৈত্র মাস।
সবাকার একান্ত নিজস্ব অনুভবে, ছন্দে - কথায় বসন্তের এই দোলা, এই আনন্দের বার্তাটুকুই এসে আজ ধরা দিয়েছে কবিমানসে - স্বতঃস্ফুর্ততায়। ধরা দিয়েছে কবি নিশুতি মজুমদারের ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ কবিতায় -
বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
নিশুতি মজুমদার
বসন্ত এসেছে আজ উন্মনা মন
চারিদিকে প্রকৃতির নব জাগরণ,
কিশলয় গাছে গাছে ভ্রমরের সাথে।
ফুলে ফুলে ভরে আছে বৃক্ষলতা যত
মন যেন উড়ু উড়ু সদা অবিরত।
সব কিছু ঠিকঠাক, তবু মনে হয়
চারিদিকে মানুষের হীন আগ্রাসন
সুন্দরতা হারিয়েছে বন উপবন।
চৈতন্যের দ্বার খুলে দাও ভগবান
আনন্দে প্লাবিত হোক সকলের প্রাণ।
বসন্ত মানেই ফাগুন। চৈতি হাওয়ায় উড়ু উড়ু মন। ফাগুন মানেই আবির গুলাল। যে কবি-মন বসেই থাকে পথ চেয়ে আর কাল গুনে, সেই কবির সামনেই অধরা এসে ধরা দেয় ফাল্গুনে। আর সেই আবেশেই পরান ছুটে যায় নেশায় নেশায়, রঙের ছোঁয়ায় - কবি মধুমিতা দত্তের কবিতা ‘ফাগুন দোলা’য়...
ফাগুন দোলা
মধুমিতা দত্ত
আয়রে সবাই আয় ধেয়ে
পলাশ ফুলের রঙ ছেয়ে,
চল না সবাই করবো খেলা।
রঙের নেশায় মন মেতেছে
পলাশ ফুলে রঙ লেগেছে,
কোকিল ডাকছে ওই সুরে।
আগুন রাঙা ওই আকাশে
আবির গুলাল মন তিয়াসে,
চল না ছুটে ওই নেশায়।
এমন দিনে মনের কোণে
থাকব না তো বসে,
সাতরঙা ওই দেশে ।
ধূসর মলিন জীবনটাকে
পরাই রঙের সাজ,
খেলব হোলি আজ।
হে বসন্ত, হে ঋতুরাজ - কবিমন আজ তোমার আবাহনে আনমনা। এই প্রকৃতি, এই ধরাধাম তোমারই আগমন বার্তায় আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেয় রং আর খুশির সুরেলা বাহার। তোমারই আবাহনে দিকে দিকে ধ্বনিত হয় কুহুরব, তরুশাখে পল্লবিত হয় নবকিশলয় বৃন্ত। ঝরা পাতার আবহেও নবরূপে সেজে ওঠে বনানী। তোমাকে স্বাগত জানাতে নিবেদন কবি সুস্মিতা মজুমদারের আগমনি কবিতা - ‘ঋতুরাজ’
ঋতুরাজ
সুস্মিতা মজুমদার
ঋতুরাজ তুমি চিরযৌবনের প্রতীক।
পলাশ শিমূল রক্তরাঙা সাজে
তোমায় বরণ করে,
কোকিল সুমধুর গান গেয়ে
তোমায় আনন্দিত করে।
আবিরের রঙে ধরাতল রঙিন হয়ে ওঠে,
বৃক্ষ তরুলতাও পুরাতন সাজ ছেড়ে
নতুন সাজে সেজে ওঠে।
বাতাসও বাঁধনছাড়া পাগলপারা উল্লাসে মাতে,
ফাগুনের উদাসী হাওয়ায় -
আপনজনকে কাছে পেতে
মন আকুলিবিকুলি করে।
ঋতুরাজ বসন্তের এই অনাবিল স্নিগ্ধ, শান্ত রূপের গভীরতায় কবি মন খুঁজে ফেরে শান্তির অনন্ত আবহ। মোহন বাঁশির ফাল্গুনি সুরে দূর হোক যত বিষণ্ণতা, যুদ্ধক্ষেত্র জুড়ে স্নিগ্ধ বসন্ত আসুক ঝেঁপে। সৃষ্টিমগ্নতায় কবি সপ্তমিতা নাথ তাই তো আঁকেন বসন্তের আলপনা।
এল ফাগুন
সপ্তমিতা নাথ
আঁকড়ে ধরা জড়সড় শীত শেষে,
দক্ষিণা হাওয়ায় বাজে মোহন বাঁশির সুর,
এ যে, বসন্ত আজি রঙিন কথা বলে।
রঙিন ফুলতটে বসন্ত আজি গায় গান,
বসন্ত মানেই নিত্য নতুন উদঘাটন। কিছু আনমমা ভুল, পেয়ে হারানোর কিছু অকারণ ভয়, আর গোলাপি খামের চিঠি। কবি ঋতা চন্দের উদঘাটনে আদ্যোপান্ত মধুময় হয়ে ওঠে এই আনচান বসন্ত, এই মধুমাস …।
মধুমাস
ঋতা চন্দ
বসন্ত মানেই অকারণ শিহরণ
বুকের ভেতর ভ্রমরের গুঞ্জন
শিমূল-পলাশ আর মাতাল হাওয়া
বসন্ত মানে চাঁদ, ফুল আর কিছু ভুল
বসন্ত এলে জীবনে আসে জোয়ার
অকারণ ভয়, পেয়ে হারাবার।
বসন্ত আনে যৌবনের চিঠি গোলাপি খামে
ফাগুয়ার রঙে ভালোবাসার বৃষ্টি নামে।
আকুল প্রাণ ব্যাকুল করে কোকিলের কুহু
মধুমাস কাল হয়, পরানটা করে হু হু।
বসন্তে জীবন খুঁজে পায় জীবনের মানে
মধুমাস মধুময় হয় মহুয়ার টানে।
নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ার পরশে একদিকে যেমন বুকের ভেতর বয়ে যায় দমকা দমকা বাউল বাতাস, অন্যদিকে আবার বনে বনে জেগে ওঠে শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া। পাশাপাশি আবার আবিরসিক্ত মনোবনে কুহু রবে অকারণে কবি মীনাক্ষি চক্রবর্তীর কবিতায় ফিরে ফিরে আসে মন-উচাটন।
আবিরসিক্ত বসন্তোচ্ছ্বাস
মীনাক্ষি চক্রবর্তী
অষ্টাদশী প্রকৃতি জুড়ে মুখর বসন্তের সঘন আন্দোলন
ফাগুন হাওয়ায় মন উতলা
বুকের ভিতর বাউল বাতাস,
ফল্গুধারায় প্রেম বয়ে যায় দুর্দম।
আবিরসিক্ত অলিন্দ ঘিরে বসন্তোচ্ছ্বাস টালমাটাল
প্রেমের ফাঁদ পেতেছে ঋতুরাজ ঘোর ফাল্গুনে
দিকে দিকান্তরে জ্বলে রংমশাল, হৃদয় ভাসে প্লাবনে
কবি, কবিতা ও বসন্ত। ফাগুন দোলায়, চৈতি হাওয়ায় শুধুই কি প্রেমের জয়জয়কার, ভালোবাসারই সংসার ? নিশ্চিতভাবেই নয়। প্রেমেরই অনুষঙ্গ হয়ে সমান গরজে, সমান বিস্তৃতি, বিশালতা নিয়ে আসে বিরহ। কুহু রবের আর্তি নিয়ে, পথ চেয়ে বিরহে আকুল হয় প্রেমিক মন। কবি বিমলেন্দু চক্রবর্তীর কবিতার ক্যানভাসে উদভাসিত হয় পূর্ণিমার চাঁদ।
বিরহে আকুল
বিমলেন্দু চক্রবর্তী
তুমি আসবে, তাইতো এত আয়োজন
বহু না-বলা কথারা এসে সঙ্গোপনে বাসা বাঁধে এই পাতাঝরা বসন্তে। অনুচ্চারিত থেকে যায় খেলাপি কথার কথামালা। খেই হারিয়ে যায় বহু কথার। গোলাপ আর রজনীগন্ধায় বিভ্রম জাগে হৃদয়কুঠুরিতে। উদভ্রান্ত যাপনে উথলে ওঠা কথারা জায়গা করে নেয় কবি মধুমিতা সেনগুপ্তের কবিতায় গভীর সন্তাপে। দমকা হাওয়ার উর্মিমালায় রচিত হয় বসন্ত-কথা......
বসন্ত কথা
মধুমিতা সেনগুপ্ত
সেদিনও ছিল সেই বসন্ত।
যেদিন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা না গোলাপ ?
কিংবা পাতাঝরা অজস্র দমকা হাওয়ায়
এ কথা না ও-কথা ? সব কথারা
আরো অনেক বসন্তে হেঁটেছি পথ
এভাবেই। অর্থহীন শব্দের পিছু পিছু
বারবার। কত শ্রম, যুদ্ধ, রক্তে ভেসে গেছে
সেদিনও সেই বসন্ত ছিল,
কোথাও দূর তেপান্তরে
দেখা হবার কথা ছিল।
কথা ছিল, সব কথা ফেলে
বাঁধা পড়ার, গভীর সন্তাপে।
নীড়হারা পাখির আগমনের প্রতীক্ষায় প্রেমিক পক্ষী, সোহাগের দিব্যি দিয়ে তাকিয়ে থাকে পলাশপথে। বিরহে কবিমন জুড়ে লেখা হয় ইতিহাস, সুখদিনের কড়চা। কবি অতীন্দ্রবিজয় চৌধুরীর কলমে জীবন্ত হয়ে ওঠে বিরহে আকুল হয়ে প্রেমিকের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা অনন্ত কালের সাতকাহন।
পলাশমন
অতীন্দ্রবিজয় চৌধুরী
একবুক কৃষ্ণচূড়া নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছি অনন্ত ।
ফিরে গেছে পাখিদের ঝাঁক
তোমার সুখের আশ্রয়ে।
ঝরে যারা পড়েছিল
তোমার এলোচুল বেয়ে
আলতো চুম্বনে বাতাস
দিয়ে যায় -
আমি তো তাদেরই দলে।
পলাশ মাখা বিকেল
চেয়ে থাকি -
আকাশের গল্পে আর গানে।
তোমায় শেষ দেখার পরে
বদলে বদলে গেছে আশপাশ।
ফিরে যদি আস -
দাঁড়িয়ে ছিলাম অনন্ত।
উদাসী বাউল-বাতাসে কবির অন্তরের যাবতীয় ইচ্ছেরা ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় যত্রতত্র। কবিমন বাসন্তী হয়ে ওঠে, যখন পাথর-ভাঙা মেয়েটি হলুদ শাড়িতে নেচে ওঠে। পাখিদের গল্প-বিলাসী গোধূলিতে আর প্রতিবাদী মিছিলে কবি মুন চক্রবর্তী লিখে রাখেন শপথের গান - আজি এ বসন্তে......
আজি এ বসন্তে
মুন চক্রবর্তী
জরাজীর্ণ ঝরে যাওয়া হলুদ পাতায় ইচ্ছে গুলোকে লিখে দিলাম
বসন্তের ফাগুন বাতাসে পলাশের রঙে রাঙানো ঋতুরাজ
আমি আমের মকুলের কাছে হাত পেতে চেয়ে নেই জীবন
শুকিয়ে যাওয়া নদী সরোবরে উড়িয়ে বেড়াই ফসলের সুগন্ধ
পাথর ভাঙা মেয়েটি যখন হলুদ শাড়িতে নেচে উঠে
আমি বাসন্তী হয়ে উঠি।
অশত্থ গাছের ছায়ায় রাগ রাগিনী করে মন আনন্দে
প্রতিবাদী মিছিলে আবির ছড়িয়ে শপথের গান শুনি
পাখির গল্প বিলাসী গোধূলিতে হলুদ পাতায় প্রেম উপখ্যান লিখে রাখি
উদাসী বাউল বাতাসে একতারায় শুনি
‘আজি এ বসন্তে’ - চৈতি আনন্দে।
ফাগুন এলেই বসন্ত আসে ঝেঁপে। তাই উতলা হয় কবির অন্তর। বসন্ত আর ফাগুন বন্দনায় মন হয় উদ্বেল। কবি লিপি চক্রবর্তীর কবিতায় ফাগুন আসে, পুরো বসন্ত উঠে আসে পলাশ, শিমূল, কেতকী, কিংশুকের আবহে, রঙে রঙিন হয়ে -
এসেছে ফাগুন
লিপি চক্রবর্তী
এসেছে ফাগুন, রঙের আগুন
পলাশ শিমুল কৃষ্ণচূড়ায় বাহারি রং ধরে।
রক্তিম সাজে পলাশ শিমুল ডাক দেয় আবেশে
অশোক, কিংশুকে ভরা যৌবন
ভ্রমর গুঞ্জনে কেতকী আড়ালে
অনুরাগের ছোঁয়া লাগে
দখিনা হাওয়ার মর্মর ধ্বনি
বসন্ত বাহার জাগে।
কোকিলের কুহু তানে পঞ্চম সুর
নব কিশলয়ে বসন্ত এসেছে
বলে দ্বার খোল দ্বার খোল।
পলাশের রঙে রেঙেছে হৃদয়
অন্তরে কলরব
ছোটদের সাথে পিচকারি হাতে
ডাক দেয় শৈশব।
মিলনের বাঁশি সুরের আকাশে
উচ্চ সপ্তকে বহমান
দিগন্ত রেখায় অধীর প্রতীক্ষা
ঋতুরাজ বসন্তে হোক তবে অবসান।
সমাপ্তিরেখায় যখন পৌঁছে যায় বসন্ত, ফাগুন পেরিয়ে তখন চৈত্রবনে লাগে নতুন আর পুরাতনের টালমাটাল হাওয়া। বিগত বসন্তের শপথ আর বৈশাখী ঝড়ে ছিন্নভিন্ন অঙ্গীকার যাপন শেষে আবারও এক বিকেলে পাতাঝরা পথের পাশে মাথা তুলে দাঁড়ায় নাম না জানা পত্রবাহার। তখনই মনে হয় বসন্ত শুধুই ফাগুন নয়। এমনই চৈতি বসন্তে চরাচর জুড়ে লেখা হয় বসন্তগান। কবি বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর কবিতায় ধরা থাকে চৈতি গাথা আর বাসন্তী কথা।
হাজার বসন্ত শেষে
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
সেদিনও তো ছিল চৈত্র মাস
চোখে চোখে কথায় কথায়
হাজারজনের অথই সর্বনাশ।
বসন্ত বাতাসে ওড়ে স্বপ্নতরীর পাল
ঝরা পাতার ফিসফিস কথামালা
একবুক ধুকপুক পা টালমাটাল।
কবে কোন বসন্তশেষের বেলা
শিমূল পলাশে জেগেছিল চরাচর
নভোনীলে ছিল সুখপাখির মেলা।
এরপর এক বৈশাখে মন-বাতায়ন জুড়ে
বৈশাখী দামাল ঝড়ে কোথা গেল উড়ে উড়ে
রয়ে গেল শুধু মনখারাপি।
এই পৃথিবীর বুকে হাজার বসন্ত শেষে
আছে শুধু বৈশাখী কথার খেলাপি।
নতুনের আহ্বানে নিজেকে যে করে নিঃশেষ
ডেকে আনে নিজেরই বিনাশ
সে-ই তো বসন্ত, সে-ই তো চৈত্র মাস।
বিদ্যুৎ
চক্রবর্তী
Comments
Post a Comment