উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে
একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত
প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি
‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড়
গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক
উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল
পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’।
২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস, কাহিনির জমজমাট বুনোট, মানানসই চরিত্র সৃষ্টি, মনোমুগ্ধকর বর্ণনাভঙ্গি, বিস্তৃত আকৃতি, সাবলীল সংলাপ ইত্যাদির উপস্থিতির সূত্র ধরেই বলা হচ্ছে। এবং বিস্ময়করভাবে এই উপাদানসমূহের সবক’টিই যথাযথভাবে খুঁজে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। কোনও আঞ্চলিক দুর্বলতার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, এক নিরপেক্ষ পাঠকের/বিশ্লেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলেও নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই উপন্যাস অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট উপন্যাসগুলোর তালিকায়।
গ্রন্থের ভূমিকায় বলতে গেলে পুরো উপন্যাসটির নির্যাস তথা কাহিনিকে পাঠকের দরবারে তুলে দিয়ে কৃতী সাহিত্যিক তুষারকান্তি সাহা লিখছেন - ‘হাজার কণ্ঠে মা’ লেখকের প্রথম উপন্যাস হলেও লেখকের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ও সংলাপের যথাযথ ব্যবহারে কোথাও গতি শ্লথ হয়নি। একবার পড়তে শুরু করলে বেশ তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায়...।’ একটি উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই ‘গতি’ বিষয়টির প্রাধান্য কিংবা যৈক্তিকতাই হয়তো সবচেয়ে বেশি। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথার অবতারণা করে এই প্রশ্ন রাখা যায় যে যেহেতু মূল গ্রন্থের আগেই ভূমিকা থাকে সেখানে ভূমিকায় সমাপ্তি সহ পুরো কাহিনিকে সংক্ষেপে হলেও তুলে ধরা কি যুক্তিযুক্ত ? এতে পাঠকের পাঠক্ষুধা কি পাঠের আগেই বিনষ্ট হয়ে যায় না ? এই ব্যাপারটি শুধু এই গ্রন্থেই নয়, এ অঞ্চলের আরোও বেশ কিছু গ্রন্থেও পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রশ্নটি তোলা থাক ভূমিকাকার, পাঠক, লেখক ও বিশ্লেষকদের জন্য।
প্রায় তিন দশক আগের প্রেক্ষাপটে লিখা ‘হাজার কণ্ঠে মা’ উপন্যাসের মূল চরিত্র মনীশ কোলকাতার ছেলে। চাকরিসূত্রে এসে যোগদান করেছে বরাক উপত্যকার পাঁচগ্রামের তৎকালীন কাছাড় কাগজ কলে। সাংস্কৃতিক জগতের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মনীশ সহজেই কাছে এসে যায় কাগজ কল এলাকার কর্মী সোমেশের নিঃসন্তান স্ত্রী তথা উচ্চ মানের গায়িকা মিত্রার। সঘন মেলামেশার সূত্রে উভয়েরই অন্তরে গড়ে ওঠে এক ভালোলাগা আবেশের। দিন যেতে থাকে সাংস্কৃতিক আবহে। সৃষ্টি হয় এক পারস্পরিক বোঝাপড়া, অলিখিত এক বিচিত্র প্রেমভাব, যে প্রেমে ছিল না কোনও তথাকথিত ভালোবাসার উচ্ছৃঙ্খলতা। তবু এরই মধ্যে কোনও এক ব্যতিক্রমী ঘটনার জেরে বিধ্বস্ত হয় মনীশ। এর পরের ঘটনাক্রম বইতে থাকে ততোধিক বিচিত্র ধারায়। কাহিনির মূল চরিত্র পাঁচটি। মনীশ, সোমেশ, মিত্রা, মনীশের বন্ধু ডাক্তার শুভঙ্কর ও মনীশের স্ত্রী মাধুরিমা। প্রতিটি চরিত্র এতটাই জীবন্ত যে কোথাও কোনো ছন্দপতন ঘটেনি উপন্যাস জুড়ে। বস্তুত একটি চরিত্রও বাহুল্য বলে মনে হয়নি গোটা উপন্যাস জুড়ে। শেষের চমকটুকু তোলা থাকুক পাঠকের জন্য।
উপন্যাসে মোট ১৬টি অধ্যায় আছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরু এবং শেষটা এতটাই সুচিন্তিত এবং সুলিখিত যে পাঠকের থেমে থাকার জো নেই। সংলাপের পারিপাট্যে, কাহিনির বুনোটে এবং ঘটনার ঘনঘটায় তরতরিয়ে চলে পঠন। শেষ পর্বে আবার প্রথম পর্বের খেইটিও দক্ষতার সঙ্গে ফিরিয়ে এনেছেন লেখক। উপন্যাসের শেষ পরিণতি একটি উপন্যাসের যাথার্থ্য নিরূপণে যথেষ্ট অবদান রাখে। এখানে যদিও মূল কাহিনির শেষটা চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে চমকের পর চমক সৃষ্টি হয়েছে তবে একেবারেই শেষে নায়কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে পথটি নেওয়া হয়েছে তার বাইরেও কিছু পথ হয়তো খোলা ছিল। এখানে লেখক কাহিনির ক্ষেত্রে কতটা মুনশিয়ানা দেখাতে পেরেছেন তা পাঠকের বিবেচনার জন্যই তোলা থাক।
ছাপাই, বাঁধাই উন্নত মানের, স্বচ্ছ। ঔপন্যাসিক সজল পাল ব্যতিক্রমীভাবে গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘সন্তানহীনাদের উদ্দেশে’। গ্রন্থের শুরুতে আছে বিশিষ্ট সমাজকর্মী তথা লেখিকা অপর্ণা দেব-এর একটি ‘প্রাসঙ্গিক’ শুভেচ্ছাবার্তা এবং লেখকের ‘আত্মকথন’। অনবধানতায় কিছু বানান ভুল রয়েই গেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে কিছু বানান কোথাও শুদ্ধ আবার কোথাও ভুল লিখা হয়েছে। প্রুফ রিডিং-এও এড়িয়ে গেছে চোখ। নান্দনিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে উদয়ন বিশ্বাস।
সব মিলিয়ে আদ্যোপান্ত একটি উন্নত মানের উপন্যাস। সর্ব স্তরের, সব জায়গার পাঠকের কাছে যে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে তা নিশ্চিত।
২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস, কাহিনির জমজমাট বুনোট, মানানসই চরিত্র সৃষ্টি, মনোমুগ্ধকর বর্ণনাভঙ্গি, বিস্তৃত আকৃতি, সাবলীল সংলাপ ইত্যাদির উপস্থিতির সূত্র ধরেই বলা হচ্ছে। এবং বিস্ময়করভাবে এই উপাদানসমূহের সবক’টিই যথাযথভাবে খুঁজে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। কোনও আঞ্চলিক দুর্বলতার দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, এক নিরপেক্ষ পাঠকের/বিশ্লেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলেও নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই উপন্যাস অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট উপন্যাসগুলোর তালিকায়।
গ্রন্থের ভূমিকায় বলতে গেলে পুরো উপন্যাসটির নির্যাস তথা কাহিনিকে পাঠকের দরবারে তুলে দিয়ে কৃতী সাহিত্যিক তুষারকান্তি সাহা লিখছেন - ‘হাজার কণ্ঠে মা’ লেখকের প্রথম উপন্যাস হলেও লেখকের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ও সংলাপের যথাযথ ব্যবহারে কোথাও গতি শ্লথ হয়নি। একবার পড়তে শুরু করলে বেশ তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায়...।’ একটি উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই ‘গতি’ বিষয়টির প্রাধান্য কিংবা যৈক্তিকতাই হয়তো সবচেয়ে বেশি। প্রসঙ্গক্রমে একটি কথার অবতারণা করে এই প্রশ্ন রাখা যায় যে যেহেতু মূল গ্রন্থের আগেই ভূমিকা থাকে সেখানে ভূমিকায় সমাপ্তি সহ পুরো কাহিনিকে সংক্ষেপে হলেও তুলে ধরা কি যুক্তিযুক্ত ? এতে পাঠকের পাঠক্ষুধা কি পাঠের আগেই বিনষ্ট হয়ে যায় না ? এই ব্যাপারটি শুধু এই গ্রন্থেই নয়, এ অঞ্চলের আরোও বেশ কিছু গ্রন্থেও পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রশ্নটি তোলা থাক ভূমিকাকার, পাঠক, লেখক ও বিশ্লেষকদের জন্য।
প্রায় তিন দশক আগের প্রেক্ষাপটে লিখা ‘হাজার কণ্ঠে মা’ উপন্যাসের মূল চরিত্র মনীশ কোলকাতার ছেলে। চাকরিসূত্রে এসে যোগদান করেছে বরাক উপত্যকার পাঁচগ্রামের তৎকালীন কাছাড় কাগজ কলে। সাংস্কৃতিক জগতের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মনীশ সহজেই কাছে এসে যায় কাগজ কল এলাকার কর্মী সোমেশের নিঃসন্তান স্ত্রী তথা উচ্চ মানের গায়িকা মিত্রার। সঘন মেলামেশার সূত্রে উভয়েরই অন্তরে গড়ে ওঠে এক ভালোলাগা আবেশের। দিন যেতে থাকে সাংস্কৃতিক আবহে। সৃষ্টি হয় এক পারস্পরিক বোঝাপড়া, অলিখিত এক বিচিত্র প্রেমভাব, যে প্রেমে ছিল না কোনও তথাকথিত ভালোবাসার উচ্ছৃঙ্খলতা। তবু এরই মধ্যে কোনও এক ব্যতিক্রমী ঘটনার জেরে বিধ্বস্ত হয় মনীশ। এর পরের ঘটনাক্রম বইতে থাকে ততোধিক বিচিত্র ধারায়। কাহিনির মূল চরিত্র পাঁচটি। মনীশ, সোমেশ, মিত্রা, মনীশের বন্ধু ডাক্তার শুভঙ্কর ও মনীশের স্ত্রী মাধুরিমা। প্রতিটি চরিত্র এতটাই জীবন্ত যে কোথাও কোনো ছন্দপতন ঘটেনি উপন্যাস জুড়ে। বস্তুত একটি চরিত্রও বাহুল্য বলে মনে হয়নি গোটা উপন্যাস জুড়ে। শেষের চমকটুকু তোলা থাকুক পাঠকের জন্য।
উপন্যাসে মোট ১৬টি অধ্যায় আছে। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরু এবং শেষটা এতটাই সুচিন্তিত এবং সুলিখিত যে পাঠকের থেমে থাকার জো নেই। সংলাপের পারিপাট্যে, কাহিনির বুনোটে এবং ঘটনার ঘনঘটায় তরতরিয়ে চলে পঠন। শেষ পর্বে আবার প্রথম পর্বের খেইটিও দক্ষতার সঙ্গে ফিরিয়ে এনেছেন লেখক। উপন্যাসের শেষ পরিণতি একটি উপন্যাসের যাথার্থ্য নিরূপণে যথেষ্ট অবদান রাখে। এখানে যদিও মূল কাহিনির শেষটা চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে চমকের পর চমক সৃষ্টি হয়েছে তবে একেবারেই শেষে নায়কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে পথটি নেওয়া হয়েছে তার বাইরেও কিছু পথ হয়তো খোলা ছিল। এখানে লেখক কাহিনির ক্ষেত্রে কতটা মুনশিয়ানা দেখাতে পেরেছেন তা পাঠকের বিবেচনার জন্যই তোলা থাক।
ছাপাই, বাঁধাই উন্নত মানের, স্বচ্ছ। ঔপন্যাসিক সজল পাল ব্যতিক্রমীভাবে গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘সন্তানহীনাদের উদ্দেশে’। গ্রন্থের শুরুতে আছে বিশিষ্ট সমাজকর্মী তথা লেখিকা অপর্ণা দেব-এর একটি ‘প্রাসঙ্গিক’ শুভেচ্ছাবার্তা এবং লেখকের ‘আত্মকথন’। অনবধানতায় কিছু বানান ভুল রয়েই গেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে কিছু বানান কোথাও শুদ্ধ আবার কোথাও ভুল লিখা হয়েছে। প্রুফ রিডিং-এও এড়িয়ে গেছে চোখ। নান্দনিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে উদয়ন বিশ্বাস।
সব মিলিয়ে আদ্যোপান্ত একটি উন্নত মানের উপন্যাস। সর্ব স্তরের, সব জায়গার পাঠকের কাছে যে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে তা নিশ্চিত।
- বিদ্যুৎ
চক্রবর্তী।
‘হাজার কণ্ঠে মা’
সজল পাল
মূল্য - ২৯৫ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮৭৬৮৩৬১৮৩
সজল পাল
মূল্য - ২৯৫ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮৭৬৮৩৬১৮৩
Sahitya jagate Lekhok uchcha shikhore pouchhe jak, setai aami aamar hriday theke kamona kori
ReplyDeleteলেখকের প্রায় প্রতিটি বই আমাকে বারবার পড়তে আকৃষ্ট করে। পড়তে পড়তে মাঝেমধ্যেই কিছু চরিত্রের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই। লেখকের সর্বাঙ্গীন উন্নতি হোক এটা আমার একান্ত কাম্য। শুভেচ্ছা রইলো অফুরন্ত।
ReplyDelete