Skip to main content

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'



তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি।
তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে
প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।
 
তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য,
আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)
 
গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন।
তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি।
‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ় বাস্তবতার সাথে, তুলে ধরবে বহুবিধ জটিল সমস্যাকে। … জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আমরা উপলব্ধি করি নিজের বা অন্য কিছু মানুষের মাঝে মিল আছে কিংবা সেই উপলব্ধিগুলো নিত্যদিনের চলার পথে জীবনসঙ্গী হয়ে তাড়া করছে।
এই গ্রন্থে কিছু ভালোবাসার কবিতার মাঝে না-বলা কথাগুলো সামনে আনার চেষ্টা করেছি মাত্র। প্রবুদ্ধ পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন যে কবিতাগুলিকে নিছক রসালো করার অভিপ্রায়ে কোনও সস্তা পন্থা অবলম্বিত হয়নি, বাস্তবকে উদভাসিত করার অকপট প্রচেষ্টা করা হয়েছে।’
এই ভূমিকার সারসত্য হিসেবে তাই বাস্তবমুখী হয়ে উঠেছে কবির কবিতা। কবিতায় স্বভাবতই কাব্যশৈলীর তুলনায় কথা ও ভাবনা উঠে এসেছে বহুলভাবে। কবিমনের নিভৃত ভাবনা সরাসরি ব্যক্ত হয়েছে কবিতায় -
চলে যেতে হবে আমাদের।
স্মৃতির জানালা দিয়ে অতীত সত্য
রোমন্থনের পথে যখন ফেলে আসা
দিনগুলোকে দেখি,
তখন মনে হয় -
অনাগত প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাবো ? … (কবিতা - স্লোগান)
সহজ কথায় ভাবনার প্রকাশ কবিতায় এনে দেয় সহজ পাঠের সারল্য। তারই প্রকাশ উঠে এসেছে ত্রিপুরার বিশিষ্ট কবি ও নাট্যকার নিবারণ নাথের ‘কথামুখ’-এ।
‘…… মানুষের জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা সৌন্দর্যবোধ বাস্তবতার নিরিখে সৃষ্টি হয় কবিতার শরীর, যা উপলব্ধির বিষয়। আজকালকার অনেক কবিতাই শব্দের দুর্বোধ্যতার প্রাচীরে আগলে থাকে। কবিতা হয়ে উঠে অতীব বুদ্ধিজীবী মহলের জন্য। কিন্তু ব্যাপক সাধারণ থেকে অতি সাধারণ পাঠকবর্গকে বঞ্চিত রাখেন। সেদিক থেকে বরাক উপত্যকার অন্যতম কবি পরিমল কর্মকার সাবলীল শব্দের কারুকার্যে প্রকাশ করেন সুপ্তধন। প্রেম, অপ্রেম, সামাজিক অবক্ষয়, যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রণা, বাদ-প্রতিবাদ, স্বাদ-আহ্লাদে কাব্য ভাবনায় সদা নিমগ্ন শব্দ চয়নে সারল্য মাখা উচ্চারণে কবি সিদ্ধহস্ত।’……
৭২ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৬৪ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ন্যূনতম ছয় লাইন থেকে শুরু করে আড়াই পৃষ্ঠা পর্যন্ত ব্যাপ্ত ৬৪টি কবিতা। দীর্ঘ কবিতাগুলো অবশ্য মূলত গদ্য আঙ্গিকে লিখা। এখানে কাব্যময়তার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। ‘স্বাধীনতা তুমি কী ভাবছ’ গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। যেখানে মান, অভিমান, প্রশ্ন, দুঃখবোধ, প্রতিবাদ আর স্বপ্ন ঘিরে বর্ণিত হয়েছে স্বাধীনতা ও তার আজকের প্রাসঙ্গিকতা। তেমনি উল্লেখযোগ্য কিছু কবিতার মধ্যে রয়েছে - মায়াহীন শূন্যতায়, সীমাহীন আনন্দে, জীবন খাতা, স্বচ্ছ ভালোবাসা, আমি প্রকৃতি, ভাবনা, পিউমা-১ ও ২, বসন্ত এসে গেছে, ভালোবাসা ফিরিয়ে দাও, সায়ন্তিকা, প্রতীক্ষায়, আমি বসন্ত, প্রতিশ্রুতি, মন মন্দিরে, সবুজ শ্যামল ভালোবাসা, সৃষ্টির চেতনায়, তুমি এসো রবিঠাকুর, ভুলে যাওয়া ভালোবাসা, চোখ কথা বলে, আত্মাভিমান, সমাপন, মাইলস্টোন ইত্যাদি।
ভালোবাসার কবিতায় অধিক সফল ও সাবলীল কবির কিছু সপাট পঙক্তি উল্লেখনীয় -
‘ষোলো বছর বয়সে আমি প্রেমে আবদ্ধ হয়েছিলাম।
অনেকটা বসন্ত আজ অতীত।……
তবুও প্রথম ভালোবাসা আমাকে
শয়নে স্বপনে শব্দ চয়নে ছন্দে ছন্দে
মাতোয়ারা করে তোলে। … (কবিতা - সৃষ্টির চেতনায়)।
 
আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ভালোবাসি হৃদয়ের গভীর থেকে।
তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি
মাঘ রাতের সুশীতল জল বক্ষ থেকে
আনতে পারি জলপদ্ম।
তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে গভীর রাতে
মাইনাস ডিগ্রী জমাট বাঁধা
বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে পারি।
তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে
জন্মসূত্রের ভালোবাসা ছেড়ে আসতে পারি।
এ আমার অহংকারী ভালোবাসা।
এ আমার ভালোবাসার আত্মাভিমান।…… (কবিতা - আত্মাভিমান)
ভালোবাসার কবিতায় এমন সাহসী উচ্চারণ, এমন অমোঘ শব্দের প্রক্ষেপন এক বিরল উদাহরণ হিসেবে চিহ্নায়িত হতেই পারে। বানান ভুলের আধিক্য রয়েছে সংকলনটিতে। এ ব্যাপারে অধিক সচেতন ও যত্নবান হতে হবে পরবর্তী পর্যায়ে। এছাড়া একই কবিতা দু’বার দুই ভিন্ন শিরোনামে (‘অস্তাচলে ভালোবাসা’ ও ‘না বলা কথাগুলো’) ছাপা হয়ে গেছে অনবধানতায়।  
এর বাইরে একের পর এক সহজ, সপাট কবিতার সম্ভার ‘স্বর্ণআভা’। ছাপা, বাঁধাই, অক্ষর বিন্যাস যথাযথ। প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে শুভম চক্রবর্তী। ধর্মনগরের দিগন্ত প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর মাকে। সব মিলিয়ে ভালোবাসার সোনালি আলোয় আলোকিত এক সহজ পাঠের কাব্যগ্রন্থ ‘স্বর্ণআভা’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

মূল্য - ২২৫ টাকা
যোগাযোগ - ৬০০৯৯৫৩২০১

Comments

  1. ব‌ইটি শান্তনুদার কাছ থেকে পেয়েছি উপহার হিসেবে।পড়ছি.......

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র