Skip to main content

ভূমিকা ১


স্বাচ্ছন্দ্য ও নিমগ্নতার কবি প্রাণজি বসাকের এ যাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা সম্ভবত দুই ডজন। একের পর এক কাব্যগ্রন্থে কবি নিজেকে উদ্‌ভাসিত করে চলেছেন নতুন থেকে নতুনতর আঙ্গিকে। প্রথমেই যে কথাটি বলে নেয়া আবশ্যক তা হল কবির গ্রন্থনাম। শব্দচমকে ও দ্যোতনায় সুচয়িত গ্রন্থনাম সহজেই আকর্ষণ করে নেয় পাঠকের প্রথম ইন্দ্রিয়। এবং এটাও এক অমোঘ সত্য যে পাঠক একবার গ্রন্থের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে আদ্যন্ত পাঠের বাইরে আর গত্যন্তর থাকে না বেরিয়ে আসার। এ এক আশ্চর্য ব্যূহ বইকী।    
কী আছে প্রাণজির কবিতায় কিংবা কেমন কবিতা প্রাণজির সম্পদ এ কথার উত্তর আমার চাইতে বহু গুণ বেশি করে লিখে দিয়েছেন হাংরি আন্দোলন ও নিমসাহিত্য আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক শ্রী রবীন্দ্র গুহ। তিনি লিখছেন - ... কবি স্থা-শক্তি পালিত নয় কবি অন্ধকারে ঝুল মাপে না তার জার্নি বর্ণব্রহ্মের ভাঁজে ভাঁজে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এইরকম ছুটতরাজ মেধাব্রহ্মের কবি প্রাণজি বসাক, যার অত্যন্ত ম্যাসকুলিন ভাষাভাবনা, উত্তম চেতনাবোধপ্রাণজি তার নিজের কথা শুধু কবিতাতেই বলেছে তার কোন গ্রন্থে ব্যক্তিগত ভূমিকা নেই কবিতাতেই তার মিথ উৎসব, চিত্তজিজ্ঞাসা, আত্মরতির আলোড়নঅফুরান প্রাণশক্তির অধিকারী সে, শূন্য থেকে মহাবিশ্বের অধিকারী, প্রাণজি - যার কাছে জীবনের জ্বালা জুড়নো মলম মানেই কবিতা
‘সব ছাই কেন ওড়ে শীত মাসে’ শীর্ষক এই গ্রন্থে রবীন্দ্র গুহকে নিয়ে ‘নিমবুড়ো’ শিরোনামে একটি কবিতাও লিখেছেন প্রাণজি। এই গ্রন্থে প্রাণজি আবারও মেতে উঠেছেন আঙ্গিকের নতুনত্বে। দুটি দীর্ঘ কবিতা সহ সবগুলো কবিতাই এবার গদ্যকবিতা। আপাতমননে গদ্যকবিতা শব্দবন্ধটি চেতনাগত বোধে ‘সোনার পাথরবাটি’ গোছের এক ভাবনার জন্ম দেয় যদিও গদ্যকবিতার আছে এক ভিন্নধর্মী প্রকাশ। ছন্দহীন কবিতা কিংবা আধুনিক বা অত্যাধুনিক কবিতার পথে নয়, গদ্যকবিতার ভেতরে প্রকৃতার্থে লুকিয়ে রয়েছে এমন এক আঙ্গিক যা মূলত গদ্যনির্ভর এবং গদ্যসঞ্জাত কিন্তু অনর্নিহিতে বয়ে যায় পদ্য বা কাব্যগুণ সম্বলিত এক চোরা ছন্দলালিত্য। রবীন্দ্রনাথ পদ্য-ছন্দকে ভেঙে পদ্য বা গদ্যকবিতার সৃষ্টি করতে চাননি! তাঁর গদ্যই রূপান্তরিত হয়েছে গদ্যকবিতায় বা পদ্যে। তাঁর পদ্যের ভাষা সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণে নির্মাণ।
এ বিষয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ গদ্যকবিতা ও অবনীন্দ্রনাথপ্রবন্ধের ফুটনোটে লিখেছেন—‘সুরচিত গদ্যমাত্রেরই একটা ছন্দপ্রবাহ আছে। এর কোন পূর্বনির্দিষ্ট নিরূপিত ধরন নেই। একেই বলা যায় গদ্যের ছন্দ। গদ্যকবিতা নামে চিহ্নিত যে বিশেষ রচনা, এর নেই কোন পূর্ব-নির্ধারিত রূপ। গদ্যকে কবিতার নির্যাসে ধারণ করাই মূল কথা।’
প্রাণজির কবিতায় যখন দেখতে পাই - ‘সব কিছু কেন যেন জলে ভেসে গেছে, সব কথা কেন মনে মনে ভাসে, সব ছায়া কেন যেন পোড়ে আজ বুকে। সব ছাই কেন যেন ওড়ে শীত মাসে।’  কিংবা ‘যাকেই ডেকে শোনাই ছাই আর মাটির কাহিনি, বলে - সেটা বড় কথা নয়, সেটা বড় কথা নয়। জীবন শ্মশানমাঠ আগুন ফিরে ফিরে আসে। আমাদের ফেরা আর চলে যাওয়া যুগপৎ কিনা হাওয়া কান পাতে মাঝখানে, সেটা বড় কথা নয়......।’ - তখনই মনে হয় কবিতার নির্যাসে প্রাণজি গদ্যকে এমনই প্রাণবন্ত করে তুলতে পেরেছেন প্রথা মেনে, পাঠক-মনন মেনে, সাফল্যের দায় মেনে। শব্দপ্রয়োগেও যথারীতি ধরে রাখতে পেরেছেন তাঁর বিশেষত্ব। ইংরেজি, হিন্দি, স্থানিক শব্দকে ব্যবহার করেছেন যথার্থ চারু ও কারুময়তায়। সামগ্রিক ভাবে এক আপন জীবনবোধের কথাই ব্যক্ত করেছেন কবি তাঁর কবিতায় - দেশত্যাগ, দেশভাবনা, স্মৃতি, গরজ ও প্রত্যয়ের এক সুষম সুষমায়।
পাঠকের দরবারে সমাদৃত হবেই এ নিবেদন, এমন প্রত্যয় নিয়েই লিখে দেওয়া যায় - প্রাণজির পরবর্তী সৃষ্টির অপেক্ষায় থাকবেন পাঠককুল

 

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়