Skip to main content

এক শুদ্ধ, সংস্কৃত জীবনচর্চার অন্য নাম - মনোমোহন মিশ্র


এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
 
আচমকা যেন খেয়াঘাটহয়ে ঘরেই চলে গেলেন বরাকের শিলচর শহরের বাসিন্দা বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সম্পাদক, চিত্রশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্রী মনোমোহন মিশ্র। শ্রীহট্টের বিখ্যাত মিশ্র বংশের এই বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তির তিরোধান বরাক তথা উত্তরপূর্বের সারস্বত সমাজে এক অপূরণীয় ক্ষতি। চলে গেলেন এক নিপাট ভদ্রজন যাঁর মুখের কথায় প্রস্ফুটিত হত সুবচন আর অমায়িক হাসি। ৭৪ বছর বয়সেও ছিলেন অফুরান প্রাণচাঞ্চল্যের অধিকারী।
শ্রী মনোমোহন মিশ্র মহাশয় কেন্দ্রীয় সরকারের ডিফেন্স অ্যাকাউন্টস বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে চাকরি শেষ করে অবসর জীবনে মূলত লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করে রেখেছিলেনন। কর্মদক্ষতার জন্য পেয়েছেন বিভাগীয় পুরস্কার। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সহ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন বহু দিন। এর পর শিলচর থেকে প্রকাশিত গতি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন আমৃত্যু। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছেন বহু নবীন প্রবীণ অনাবিষ্কৃত কবি, সাহিত্যিক। প্রতিটি দায়িত্বে ছিলেন আত্মনিবেদিত। তিনি ছিলেন এক সময়ের বিশিষ্ট তবলা বাদক সর্বভারতীয় স্তরের বহু বিশিষ্ট পণ্ডিত, ওস্তাদ গায়কের সঙ্গে তিনি তবলা সঙ্গত করেছেন।   
তাঁর সাহিত্যকৃতির পরিসর বহু বিস্তৃত। প্রকাশিত হয়েছে ৯টি গ্রন্থ। প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা -
শ্রীহট্টের মিশ্রবংশ কথা - ইতিহাসমূলক গবেষণা গ্রন্থ।
বেঁচে আছি আমরা কজন - কবিতা ও ছোটগল্প।
কিছু আশা ভালোবাসা - বাংলা ফিচার।
উড়ান - প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর হিন্দি কবিতার বাংলা অনুবাদ।
খেয়ালি মন - প্রবন্ধ সংকলন।
বিয়ে নিয়ে বিরাশি - রম্য প্রবন্ধ সংকলন।
মিঠে রোদ্দুর - উপন্যাস।
কুসুমলতা - উপন্যাস।
খেয়াঘাট - সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ।
সিলেটি কুট্টি মহাভারত - মাত্র ৭৫০ শব্দর মধ্যে পুরো মহাভারতের কথা ছন্দের মাধ্যমে লেখা পুস্তিকা।
এর বাইরেও বহু রসাত্মক কবিতা, সিলেটি কবিতা তিনি লিখেছেন। পেয়েছেন সিলেটি সাহিত্য রথী - ২০২৩ পুরস্কারও। হয়েছে তাঁর চারটি কবিতার চলচ্চিত্রায়ন। প্রকাশিত হয়েছে সিডি।  
অতীত থেকে বর্তমান সমাজের নানা রকম সমস্যা ও সমাজর ভিতরের কথা খুব সুন্দর করে তাঁর লেখার মধ্যে ফুটে উঠেছিল। ২৯ নভেম্বর ১৯৫০ থেকে ৮ এপ্রিল ২০২৪ - এই সারস্বত জীবনকালে ব্যক্তিগত ভাবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন। সবাইকে সম্মান করতে জানতেন। তাই সম্মান পেয়েছেনও সবার থেকে। এতটাই সহসা যে চলে যাবেন সবাইকে ছেড়ে তা কল্পনায়ও আসেনি কারো। হৃদয়টা পরিষ্কার ছিল বলেই দীর্ঘ রোগভোগ সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু সহযাত্রী, সহোদরসম যারা রয়ে গেল তাদের হৃদয়ে এই অকল্পনীয় মৃত্যু নিয়ে এল এক সাগরসম দুঃখব্যথা। যবনিকা পড়ল এক শুদ্ধ, সংস্কৃত জীবনযাত্রার।    
সমাজ ও সাহিত্যের এই মহান ব্যাক্তিত্বকে জানাই শেষ শ্রদ্ধা অক্ষয় স্বর্গধামে বিরাজ করুক তাঁর মহান আত্মা।

 

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়