এভাবেও চলে যেতে হয় কারো ? যাঁর মন্ত্র ছিল
- জীবনের যা আছে সম্পদ তা নিয়েই জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হয়, তিনিই এভাবে ভরপুর প্রাণশক্তির অধিকারী হয়েও আচমকা পাড়ি দেবেন পরলোকে,
এ যে অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। বেশি নয়, আজ থেকে বছর পাঁচেক আগেই প্রথমবারের মতো এসেছিলাম তাঁর সান্নিধ্যে। সেই
থেকে হৃদয়ে তাঁর আসন ছিল পাতা। ঈশ্বরের মতো তাঁর ছবি রেখেছি মাথায় করে।
কবি সুশান্ত ভট্টাচার্য। যতটা না
কবি ছিলেন তার চাইতে বহু গুণ বেশি ছিলেন এক সহজ, সরল, সদালাপী,
সোজাসাপটা কথার একান্ত এক কাছের মানুষ। সাক্ষাতে শেষ হতো না
আলাপচারিতা, দূরভাষেও তাই। কথাকে বুকে ধরে রাখার মানুষ ছিলেন
না তিনি। ভালো হোক বা মন্দ - প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে হালকা করে নিতেন হৃদয়। হালকা
করে দিতেনও। অথচ এই হৃদয় রোগেই হঠাৎ করে হারিয়ে গেলেন চিরতরে। এ দুঃখব্যথা বয়ে
বেড়ানো বড় সহজ কথা নয়।
তাঁর জন্ম হয়েছিল ২৯ নভেম্বর, ১৯৫৪ ইংরেজি।
সত্তরের কোঠায় দাঁড়িয়েও এক তরতাজা যুবকের মতো চালিয়ে গেছেন সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যপ্রীতি। এমন কোনও সাহিত্যানুষ্ঠান নেই যেখানে তাঁর উচ্ছল উপস্থিতি
আপ্লুত করেনি উদ্যোক্তা বা শ্রোতা-দর্শকদের। নিমেষে অচেনাকে আপন করে নিতে জুড়ি ছিল
না তাঁর। প্রতিটি অনুষ্ঠানের লাইভ ভিডিও করে দেখার সুযোগ করে দিতেন সবাইকে। এক
আদ্যোপান্ত আড্ডাপ্রিয় ব্যক্তি অগ্রজসম সুশান্তদা এই সেদিনও গুয়াহাটি এসে চার দিনে
চারটি অনুষ্ঠানে যোগদান করে গেলেন। এর পরেই তাঁর বাংলাদেশ সফর। সেখান থেকে ফিরেই
খনিকটা অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাক্তারের দ্বারস্থ হলে জানা গেল হৃদযন্ত্রে ত্রুটির কথা।
এতটা বিশাল যাঁর হৃদয়, তাঁরও হৃদযন্ত্রে ত্রুটি হয় ? কী অসার, কী বিচিত্র এ জগৎ সংসার। এ নিয়ে আলোচনা
করেছেন বিস্তৃত। অবশেষে হার্টের অপারেশনের এগারো দিনের মাথায় নিভে গেল উজ্জ্বলিত
প্রাণপ্রদীপ। কালো দিন হয়ে রইল ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখটি।
সুশান্তদা ছিলেন জ্ঞানের প্রদীপ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হওয়ার পর শেষবারের মতো এই দু’বছর আগে তাঁর ৬৭
তম জন্মদিনের আগে প্রাপ্ত হলেন পঞ্চমবারের মতো মাস্টার্স ডিগ্রী। একে একে ইংরেজি,
বাংলা, সমাজবিদ্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। APUCNI,
Uruguye থেকে পেয়েছেন সাম্মানিক ডিপ্লোমা। দেশের বহু জায়গায় যোগদান
করেছেন সাহিত্য বিষয়ক সেমিনারে। জানার স্পৃহা তাঁর চিরদিনের। ইংরেজি কবিতার হাত
ধরে আন্তর্জাতিক কবিতা মঞ্চে তাঁর সদর্প উপস্থিতি লক্ষণীয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও
প্রচলিত ছন্দ বা ছকের ধার না ধেরে অনর্গল লিখে যেতেন কবিতা। এবং প্রতিটি কবিতাই
কবিতা হয়ে উঠত। তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠত প্রেম, ভালোবাসা,
প্রকৃতি ও বাস্তব। দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্রপত্রিকায় ও সংকলনে স্থান
পেয়েছে তার বহু কবিতা, পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। কবিতা-অন্ত
প্রাণ এই মানুষটি কবিতাকে লিখা একটি কবিতায় এভাবেই লিখছেন -
তুমি আমার প্রতিদিনের সাধনা
তোমাকে স্বপ্নে পাই - তোমাকে বাস্তবে পাই
তোমাকে ভালোবেসে জীবন কাটাই, কবিতা...
আমার চেতনায় উন্মাদনা ছড়াও তুমি
শব্দমালার উদ্দাম স্রোতের তরঙ্গে
আমি বিবশ হই; তোমার কাছে বিস্ময়ে
মননের গভীর থেকে তুমি উঠে আস
শুধু প্রেম নিয়ে
নতুন আকাঙ্ক্ষা জাগে হৃদয়ে আমার
কবিতা শুধু তোমার জন্যে...। (কবিতা - আমি তোমার জন্যে বেঁচে আছি)।
লিখেছেন ছন্দহীন কবিতা বিষয়ক দীর্ঘ প্রবন্ধও। ‘সুচেতনা’ ফেসবুক গ্রুপের কর্ণধার হয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যাওয়া সুশান্ত ভট্টাচার্য নিজে সম্পাদনাও করেছেন ‘সুচেতনা’ নামের লিটল ম্যাগাজিন। আরেকটি সংখ্যা প্রকাশের সব কাজ শেষ করে এনেছিলেন সম্প্রতি। আরেকটি কবিতার বইয়ের কাজও চলছিল। এর আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘কিছু ছড়া - কিছু কবিতা’, ‘বরাক সুরমার তীরে তীরে’, Blue Horizon. সম্পাদনা করেছেন ‘বৃষ্টিকথা - বরাকের কবিতা সংকলন’। সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে ছিলেন বৃষ্টিকথা -‘বরাকের ছোটগল্প সংকলন’-এরও। সাহিত্য, সংস্কৃতি আর সম্প্রীতির ধারক, বাহক, পূজারি হয়ে হেসে খেলে কাটিয়ে দেওয়া এই জীবন আজ অনেকের কাছেই শিক্ষণীয়।
আজ তাঁর প্রস্থানে বুকের ভেতর
সৃষ্টি হল এক অনন্ত শূন্যতা। সান্ত্বনা একটাই - হাসপাতালে অপারেশনের পর যে কয়েকটি
মুহূর্ত সামান্য সুস্থতার মধ্যে অতিবাহিত করেছিলেন সেই সময়েই তিনি দেখলেন কবি অশোক
বার্মা সম্পাদিত কাব্য সংকলন ‘তিন দম্পতির কবিতা’ বইয়ের সচিত্র
আলোচনা বেরিয়েছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে যেখানে তাঁর সস্ত্রীক ছবিও রয়েছে। রয়েছে তাঁর
কবিতার বিশ্লেষণ। দেখে, শোনে পরিতৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন।
এটুকুই আমার প্রাপ্তি হয়ে রইল। আর কোনোদিন লিখতে পারব না - ‘বাড়ি
আছেন সুশান্তদা ......?’ তিনিই ছিলেন কবিতাবিশ্বে সমকালের
একমাত্র কবি যাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছি আমি।
সুশান্তদা, আপনিই তো
লিখেছিলেন -
‘আসিব না আর
কোনোদিন তোমাদের কাছে
যদি একবার ছেড়ে চলে যাই এই রাঙা জীবন’... (কবিতা - ত্রিপদী)
তবু, আপনার মতো মানুষ
হারিয়ে গেলে পৃথিবীটা সুন্দর হতে পারে না সুশান্তদা। তাই যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন,
আবার ফিরে আসুন আপনি স্বমহিমায়। পরবর্তী প্রজন্ম একদিন অবাক হয়ে
দেখুন কোনও এক কবিতার জমজমাট অনুষ্ঠানের মঞ্চে কবিতা পাঠ করছেন এক সুঠাম, দীর্ঘদেহী, সুপুরুষ কবি সুশান্ত ভট্টাচার্য। দেখুক,
আপ্লুত হোক। আজ মনে হচ্ছে, যে যায় সে একা যায়
না, যারা রয়ে যায় তারাই হয়ে পড়ে বড্ড একাকী।
আজ আপনারই কবিতার একটি লাইন ধার
নিয়ে তাই লিখছি -
‘তবুও আমি একাকী অপেক্ষা করবো তোমার’।
তোমাকে স্বপ্নে পাই - তোমাকে বাস্তবে পাই
তোমাকে ভালোবেসে জীবন কাটাই, কবিতা...
আমার চেতনায় উন্মাদনা ছড়াও তুমি
শব্দমালার উদ্দাম স্রোতের তরঙ্গে
আমি বিবশ হই; তোমার কাছে বিস্ময়ে
শুধু প্রেম নিয়ে
নতুন আকাঙ্ক্ষা জাগে হৃদয়ে আমার
কবিতা শুধু তোমার জন্যে...। (কবিতা - আমি তোমার জন্যে বেঁচে আছি)।
লিখেছেন ছন্দহীন কবিতা বিষয়ক দীর্ঘ প্রবন্ধও। ‘সুচেতনা’ ফেসবুক গ্রুপের কর্ণধার হয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যাওয়া সুশান্ত ভট্টাচার্য নিজে সম্পাদনাও করেছেন ‘সুচেতনা’ নামের লিটল ম্যাগাজিন। আরেকটি সংখ্যা প্রকাশের সব কাজ শেষ করে এনেছিলেন সম্প্রতি। আরেকটি কবিতার বইয়ের কাজও চলছিল। এর আগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘কিছু ছড়া - কিছু কবিতা’, ‘বরাক সুরমার তীরে তীরে’, Blue Horizon. সম্পাদনা করেছেন ‘বৃষ্টিকথা - বরাকের কবিতা সংকলন’। সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে ছিলেন বৃষ্টিকথা -‘বরাকের ছোটগল্প সংকলন’-এরও। সাহিত্য, সংস্কৃতি আর সম্প্রীতির ধারক, বাহক, পূজারি হয়ে হেসে খেলে কাটিয়ে দেওয়া এই জীবন আজ অনেকের কাছেই শিক্ষণীয়।
যদি একবার ছেড়ে চলে যাই এই রাঙা জীবন’... (কবিতা - ত্রিপদী)
‘তবুও আমি একাকী অপেক্ষা করবো তোমার’।
বিদ্যুৎ
চক্রবর্তী
Comments
Post a Comment