সামনের বাস রাস্তা সংলগ্ন ব্যালকনিতে রোদ আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হওয়ার উপক্রম। শীতের সকালটা
তাই বড়োই বিরক্তিকর। উত্তর ঘেঁষা পশ্চিম দিকে ঘরের ব্যালকনি হলে যা হবার তাই হয়েছে। এতে অবশ্য দুঃখ করে লাভ নেই। ভিক্ষের চাল কাঁড়া আর
আকাঁড়া। পকেটের পরিমাপেই ঘরদোর হয়
সবার। অথচ জন্মভিটের সেই ঘরখানি
! পশ্চিম ভিটের ঘর ছিল। শীতের সকালে সারা উঠোন জুড়ে মিষ্টি রোদের সেই শুভ্র আমেজ এ জীবনে ভুলবার নয়। উপরি পাওনা ছিল উঠোনের প্রান্ত জুড়ে হলুদ অতসী ফুলের গাছে মাকড়সার সদ্য বোনা জালে জমে থাকা শিশিরকণায় বিশাল সূর্যের পরমাণু-প্রতিবিম্ব আর
ফুলে ফুলে উড়ে আসা বিচিত্র প্রজাতির সব সাদা-কালো আর
রঙিন প্রজাপতি।
সব কিছুই এখন হারিয়ে গেছে। শহরে এসব কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আসলে বিমলেন্দুবাবুর জীবনেরই এখন আর বিশেষ অবশিষ্ট কিছু নেই। রিটায়ার করবেন বছর দুয়েকের মধ্যেই। অথচ এখন থেকেই কান পাতলে যেন শুনতে পাচ্ছেন বিদায়ের সুর। আর পাঁচজনেরই মতো সাদামাঠা সংসার করেছেন, নিজের মাথার উপর থেকে এক এক করে সব ছাতা খসে পড়ার পর এখন নিজেই ছাতা হয়ে আছেন স্ত্রী পুত্রের। যেদিন শেষ ঝড় আসবে ধেয়ে সেদিন উড়ে যাবেন জগতের নিয়ম মেনে। এই তো জগৎ সংসার। এ নিয়ে বিমলেন্দুবাবু অবশ্য তেমন বিচলিত নন মোটেও। বরং যে ক’দিন আছেন সংযমের মধ্যে তাকে উপভোগ করে যেতে চান যতটা সম্ভব। চিন্তা একটাই উড়ে যাওয়ার পর যেন কেউ আঙুল না তোলে তার দিকে। এমন কোনও কাজ তিনি করেননি যাতে তাঁর চলে যাওয়ার পর দিকে দিকে তাঁর শোকসভা হবে কিংবা বছর বছর তাঁর জন্ম কিংবা মৃত্যুদিন পালন করবে জনগণ। নিতান্তই দশের এক হয়েই তাই নিজের কাজটুকু করে কাটিয়ে দিতে চান বাকি জীবন। অফিসের কাজ পুরোটা সামলে যেটুকু সময় থাকে তাতে এক আধটু লেখালেখি, খানিকটা গানবাজনার অভ্যেস বহুদিনের।
কী করে যে এই লেখালেখির ব্যাপারটা হল তা নিজেও জানেন না। আসলে প্রায় তিন কুড়ি বছরের জীবনে এত এত চরিত্ররা এসেছে তাঁর সামনে যে অবসরে এসব মানুষদের কথা ভাবতে ভাবতেই আছন্ন হয়ে পড়তেন বিমলেন্দুবাবু। সেই তাদের কথাগুলোই যাতে হারিয়ে না যায় তারই এক প্রয়াসে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতেন নিয়মিত। লিখতে লিখতে একদিন নিজেই বুঝতে পারলেন যে লেখালেখির ধার তাঁর বেড়ে গেছে অনেকটাই। তার কিছুটা অবশ্যই ভালো ভালো বইপত্র পড়ার ফল। সেই থেকে বলা যায় অনেকটাই নেশার মতো হয়ে গেছে ব্যাপারটা। এখন বয়স যত বাড়ছে ততই যেন তাঁর মনে হচ্ছে অনেক বাকি থেকে গেছে লেখার। যেখানেই যান, যাকেই সামনে থেকে দেখেন, কথা বলেন - যেন মনে হয় প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি সত্তা একে অপরের থেকে ভিন্ন। সবার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে জীবনের লুক্কায়িত গল্প সম্ভার।
আজও, এই শীতের সকালে ঘরে বসে বসে ঠাণ্ডায় জবুথবু হচ্ছিলেন বিমলেন্দুবাবু। স্ত্রী অণিমা এসে বললেন -
- বেরোবে
না ? আজ তো রোববার।
কী খাওয়া হবে আজ ?
বিষয়টি বিমলেন্দুবাবুর পছন্দের নয় মোটেও।
গিন্নি সরাসরি বলে দিলেই ভালো।
অন্যথায় এদিন কী খাওয়া হবে তা নিয়ে পছন্দ অপছন্দের পদ
নিয়ে চাপানউতোর চলবে খানিকটা সময় ধরে এবং শেষ পর্যন্ত শান্তিচুক্তিতে সই
করে তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হবে গিন্নির পছন্দের খাবারের জিনিসপত্র কিনতে। বেরিয়ে পড়তে হবে তাঁকে এমনিতেও। কারণ এখনই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকবে নমিতা।
ঘণ্টাখানেকের মতো এ ঘর আর নিজেদের হাতে থাকবে না। পুরোটাই দখল করে রাখবে সে। এ
সময় ঘরে থাকলে বিরাট এক
অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয় বিশেষ করে বিমলেন্দুবাবুকে। অণিমার তেমন অসুবিধে হয়
বলে মনে হয় না। হবার কথাও নয়। লিঙ্গগত মেলামেশার একটা ব্যাপার তো
আছেই। নমিতা গৃহ পরিচারিকা। পার্ট টাইম। বিমলেন্দুবাবু এদের পরিচারিকা বলার চাইতে সহায়িকা বলতেই স্বছন্দ বোধ করেন। কারণ এদের সহায়তা ছাড়া মধ্যবিত্ত ঘরের রোগসর্বস্ব গৃহকর্ত্রীদের পক্ষে সংসার সামলানো এক কথায় অসম্ভব। এ অবশ্য আজকের নয় শুধু।
যুগ যুগ ধরেই এটা চলে আসছে।
সেই ছোটোবেলায় বাতের ব্যথায় প্রায়শ কাতর থাকা মা যখন রাত জেগে বই পড়ে শেষ রাতে ঘুমোতেন আর দেরি করে উঠতেন তখন সেই সাতসকালেই রুনুর মা মাসি এসে ঘরদোর মায় সারাটা উঠোন ঝাড়ু দিয়ে সাফসুতরো করে উনুন ধরিয়ে চায়ের জল বসিয়ে মাকে ডেকে উঠাতো। শুরু হতো একটা সুন্দর সকাল।
সেই থেকে আজকের নমিতা অবধি বিমলেন্দুবাবুর সংসার সহায়িকা-নির্ভর। শুধু তাঁরই নয় আশপাশের দশটা বাড়িরও একই হাল। নমিতাকেও ওর নিজের সংসার সামলাতে তাই কাজ করতে হয় আরোও তিনটে বাড়িতে। সব মিলিয়ে চার ঘর। ঈশ্বর এদের দশভূজা করে এই সংসারে পাঠান নিঃস্ব অবস্থায়। এরা খেটেখুটে আরোও পাঁচ জনের পাশাপাশি নিজের সংসারেরও হালটা ধরে রাখে শক্ত হাতের মুঠোয়।
সেই যে রুনুর মা মাসি মাস ফুরোতে কিছু টাকা আর প্রতিদিন দুমুঠো অন্নের সংস্থানের বিনিময়ে হাল ধরে রাখতেন বাড়ির সেই থেকে চলে আসছে এই ট্র্যাডিশন। এখন নমিতা ঘরে এলে সমস্যা হয়ে যায় বিমলেন্দুবাবুর। নমিতা ঝড়ের মতো একোঠা ওকোঠা একবার ঝাড়ু দিয়ে আবার আসে জল ন্যাতা নিয়ে ফ্লোরটাকে মুছে দিতে। বিমলেন্দুবাবু তার অসমাপ্ত কাজ ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়েন বিছানায়। অন্যথা নমিতার দাপটে দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই সময়টা তাই বাইরে থাকাই পছন্দ করেন তিনি। অফিস খোলা দিনে চেষ্টা করেন নমিতা এসে ঢোকার আগেই যাতে বেরিয়ে পড়তে পারেন। রবিবার বা বন্ধ দিনগুলোতে হয় সমস্যা। এদিন অণিমার কথায় তাই স্বস্তি পেলেন বিমলেন্দু। অণিমার থেকে বাজারের ফর্দ নিয়ে তড়িঘড়ি বেরোতে না বেরোতেই নমিতা ঢুকল ঘরে। বিমলেন্দু কোনওক্রমে ওকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
বাইরে এসে কনকনে ঠাণ্ডা থেকে মুক্তি পেলেন নরম রোদের পরশে। ধীরে ধীরে স্টার্ট দিলেন নতুন কেনা স্কুটি। সোজা গিয়ে হাজির হলেন বাজার সংলগ্ন চায়ের দোকানের সামনেটায়। স্কুটি দাঁড় করিয়ে বাজারের থলেটা হাতে করে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলেন মাছের দিকটা থেকে থলে হাতে বেরিয়ে আসছেন সহকর্মী সুপ্রতিমবাবু। তাঁর কাছ থেকেই মাছ বাজারের হাল হকিকতটা জেনে নিয়ে এবার চায়ের দোকানে ঢুকে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। কাপটা হাতে দোকানের বাইরের ফুটপাতে যেখানে রোদ এসে পড়ছে তার যাবতীয় উষ্ণতা নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন চায়ের আস্বাদ। দেখে নিলেন চেনা চারপাশকে আবারও। পাশেই পুরোনো বটগাছকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজার বিশ্বাস নিয়ে কেউ একজন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে কয়েকটি ধুপকাঠি। ধুপের গন্ধে, রোদের আবেশে বিমলেন্দুবাবুর যেন নিমেষেই দূর হয়ে গেল ঠাণ্ডাজনিত যাবতীয় অবসাদ। এবার সবে বাজারের ভেতরে প্রবেশ করতে যাবেন তখনই পাশের দোকান থেকে বন্ধুসম দোকানদার মালিক হাঁক পাড়লেন - ‘গুড মর্ণিং স্যার। কুছ নেহি চাহিয়ে আজ ?’
বিমলেন্দুবাবু হাতের ইশারায় বললেন ‘আসছি বাজার সেরে…।’
বিহার থেকে প্রজন্মের পর
প্রজন্ম ধরে ব্যাবসা করছেন মহেশ প্রসাদরা। এতদিনে বন্ধুর
মতো হয়ে গেছেন বিমলেন্দুবাবুর। খুচরো চাই, টাকা চাই, ধারে জিনিস চাই - মহেশ প্রসাদ
জিন্দাবাদ। এই
যে সারাটা জীবন ধরে কত
কত সুজন চরিত্ররা এসে দাঁড়ায় সামনে সহায়তার হাত নিয়ে তাঁদের নিয়েই লিখতে চান বিমলেন্দুবাবু। সবাইকে
নিয়ে তো
লেখা সম্ভব নয়। কারণ এক জীবনে তা করে ওঠা মুশকিল। তাই যে ক’জনকে নিয়ে লেখা যায় তাই সই। বাজার সেরে মহেশকে দর্শন দিয়ে ঘরে এসে দেখলেন নমিতা বেরিয়ে গেছে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন। এবার খানিকটা শান্তিতে নিজের কাজকর্ম করা যাবে।
অণিমাও এখন চানটান সেরে পুজোঘরে ঢুকবে ঘণ্টাদুয়েকের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে। অণিমাদের কিছু চিন্তাভাবনা থাকে বিচিত্র ধরণের। জন্মসূত্রে এবং বাকিটা বিবাহসূত্রে লব্ধ। বিমলেন্দুবাবু এতদিনের সংসার-অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারেন সব। সব
মহিলারাই চান তাঁদের স্বামীরা যেন স্ত্রীর বাইরে অন্য মহিলার থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকেন।
তা সেই মহিলাটি যেই হোন না কেন। এমনকি কাজের মহিলাদের থেকেও দূরে সরে থাকা উচিত সব
পুরুষদের। কোনও অস্বাভাবিক নয় এমন চিন্তা। এ সংসারে
অনেক কিছুই ঘটে যায় যে
ঘটনাগুলোকে অনায়াসে দুর্ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা যায়। অণিমার আর দোষ কী ?
অথচ সাবিত্রী
দিদির কথা কী করে ভোলেন বিমলেন্দুবাবু ? তখন তিনি আর নেহাত শিশুটি
নন। এমনকি বালক বেলাও পেরিয়ে এসেছেন বেশ ক’বছর আগেই।
এখন কৈশোরে। সামনেই প্রবেশিকা পরীক্ষা। বন্ধের দিনগুলোতে ঘরেই চলছে জোর কদমে তার প্রস্তুতি। শারীরিক অসুস্থতার
জন্য রুনুর মা মাসির কাজ ছেড়ে দেওয়ার পর এসেছিল সাবিত্রী। সাবিত্রীর মতো এত রূপবতী গৃহ সহায়িকা আজ
অবধি আর
দ্বিতীয়টি দেখেননি বিমলেন্দুবাবু। গায়ের রং কিছুটা চাপা হলেও যেন সাক্ষাৎ লক্ষী প্রতিমা। বয়েস মেরেকেটে তিরিশ হবে।
অথচ বিধাতার কী অপার বিচার, সাবিত্রী দিদি ছিল বিধবা। আজ
থেকে বহু বছর আগের সে
কথা। গ্রাম্য পরিবেশ। সুতরাং প্রথা মেনে সাদা কাপড় পরত সাবিত্রী দিদি। এমন বেশে যেন তার মলিন মুখমণ্ডল বেশি করে দৃষ্টি আকর্ষণ করত সবার। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে
ছিল। নোংরা জিনিসে ঘেন্না ছিল প্রবল। কাজের ধারা সেই একই ছিল তখনও। ঝড়ের বেগে এবাড়ি ওবাড়ি।
তবু কিছুটা সময় বোধ করি বেশিই থাকত এ
বাড়িতে। মায়ের তরফে সন্তানবৎ স্নেহ যে এর মূল তা আর
বলার অপেক্ষা রাখে না। গরিবের ঘরের মেয়ে, বউ সাবিত্রী। বিমলেন্দুবাবুরাও সে অর্থে ধনী ছিলেন না তবু সাবিত্রীদের থেকে অনেকটাই বিত্তবান এতে কোনও সন্দেহ নেই। তাই প্রতিদিনই প্রায় এটা ওটা খাওয়া জুটত সাবিত্রী দিদির। তা
থেকেও এক
নৈকট্য। বাঁধা কাজের বাইরেও তাই নিজে থেকেই এটা ওটা করে দিত।
পাশের বাড়ি দুটোতেও মাঝে মাঝে গিয়ে খানিকটা সময় গল্পগুজবে অতিবাহিত করত সাবিত্রী দিদি।
একদিন কলেজে যাওয়ার আগে ভাত খেয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে মা ও সাবিত্রী দিদির কিছু কথা কানে এল বিমলেন্দুর। ভাতের থালায় তরকারি দিয়ে মাখা কিছুটা ভাত অবশিষ্ট থেকে গিয়েছিল সেদিন। বিমলেন্দুর আর খেতে ইচ্ছে করছিল না। তখন খেতে বসেছিল সাবিত্রী দিদি। বিমলেন্দুর থালার অবশিষ্ট মাখা ভাতটুকুও সে নিয়ে নিল নিজের থালায়। দেখে মা হইহই করে উঠলেন…
- অ্যাই সাবিত্রী, কী করছিস ? ওটা উচ্ছিষ্ট যে ?
তুই খাবি
?
সাবিত্রী বলল
- তাতে কী
হল মাসি
? ও তো
আমার ছোট ভাই। ওর উচ্ছিষ্টতে
ঘেন্না হবে কেন আমার ?
- তোর না সবেতেই বড্ড খুঁতখুঁত ?
- আরে, ভাই তো
ছোট। ওর
কিছুতেই ঘেন্না নেই আমার।
হয়তো কোনও এক বহু দিনের সুপ্ত ব্যথা ছলকে উঠেছিল সেদিন সাবিত্রী দিদির বুকে। এক নারীর চিরন্তন পাওয়া না পাওয়ার ব্যথা। স্বামীসঙ্গ, সন্তানসুখ। তবে বিমলেন্দুবাবু সেই যে শুনলেন সেই কথা সেই থেকে একেবারে নিজের দিদি হয়ে উঠল সাবিত্রী। এমনিতেও নিজের দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে একটা শূন্যতা এসে গ্রাস করেছিল বিমলেন্দুর অন্তরে। সেই থেকে আজও, এই প্রায় দুকুড়ি বছর পরেও প্রায়শ মনে পড়ে যায় সাবিত্রী দিদির কথা।
সেদিনের পর কিছুদিনের মধ্যেই বিমলেন্দু প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হতে পাড়ি দিয়েছিলেন দূরে। তখন ফোন ছিল না। চিঠিচাপাটি হতো। ভালোমন্দ খবর আদানপ্রদান হলেও সাবিত্রী দিদির ব্যাপারে আলাদা করে আর কিছু জানা হয়নি বহু দিন। প্রায় মাস ছয়েক পর বাড়ি ফিরে সাবিত্রী দিদিকে দেখতে না পেয়ে জানতে পেরেছিলেন ওকে নাকি বিমলেন্দুর বাইরে যাওয়ার কয়েকদিন পরই কাজ থেকে বিদেয় দেওয়া হয়েছে। কী ছিল ওর অপরাধ ? তাকে নাকি কেউ দেখে ফেলেছিল পাশের ঘরের অবিবাহিত অতনুকাকার সাথে দাঁড়িয়ে নিভৃতে কথা বলতে। জল বেশিদূর গড়াতে না দিয়ে তাই ছুটি হল সাবিত্রী দিদির। ওবাড়ির অতনুকাকা যিনি ছিলেন বিমলেন্দুর খুব প্রিয় একজন ব্যক্তি, তাঁকেও নাকি অনুশাসন ভঙ্গের জেরে মাসকয়েকের জন্য পাঠানো হয়েছে বাইরে। গ্রাম্য পরিবেশে তখনকার দিনে অভ্যন্তরীণ নিয়ম নীতি, আচার বিচার খুব কড়া ছিল কিনা। সেই থেকে যতবার বিমলেন্দু বাড়ি গেছেন ততবারই খবর নিয়েছেন সাবিত্রী দিদির যদিও দেখা হয়নি আর। শেষটায় বাড়ি ছেড়ে শেষবারের মতো চলে আসার পর আর খবর পাওয়া যায়নি তাঁর।
আজ দীর্ঘ দিনের শেষে হয়তো বৃদ্ধা হয়ে গেছেন সেদিনের সুন্দরী সাবিত্রী দিদি। যাঁর নামটাই ছিল এক প্রহসন। বিবাহোত্তর প্রায় সারাটা জীবন সাদা কাপড় পরেই যিনি কাটিয়ে দিলেন যাপনকাল। কিংবা আজ হয়তো ছেড়ে চলে গেছেন এই পৃথিবী - ভালোবাসায় একের পর এক বঞ্চনার দুঃখ সয়ে সয়ে। তাঁর কথা মনে এলেই আনমনা হয়ে পড়েন বিমলেন্দু। ভেতর থেকে প্রতিবারই স্বগতোক্তির মতো বেরিয়ে আসে -
- যে তোমাকে যাই ভাবুক সাবিত্রী দিদি, তোমার এই ভাইটি কিন্তু তোমাকে ভোলেনি কোনোদিন। সেদিনের সেই ভালোবাসাটুকু বুকে ধরে দিদির মর্যাদায় তোমাকে স্মরণ করি আজও। তোমার কথা মনে এলে আজও বুকচাপা আবেগে রুদ্ধ হয় কণ্ঠ, চোখে আসে জল।
সব কিছুই এখন হারিয়ে গেছে। শহরে এসব কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। আসলে বিমলেন্দুবাবুর জীবনেরই এখন আর বিশেষ অবশিষ্ট কিছু নেই। রিটায়ার করবেন বছর দুয়েকের মধ্যেই। অথচ এখন থেকেই কান পাতলে যেন শুনতে পাচ্ছেন বিদায়ের সুর। আর পাঁচজনেরই মতো সাদামাঠা সংসার করেছেন, নিজের মাথার উপর থেকে এক এক করে সব ছাতা খসে পড়ার পর এখন নিজেই ছাতা হয়ে আছেন স্ত্রী পুত্রের। যেদিন শেষ ঝড় আসবে ধেয়ে সেদিন উড়ে যাবেন জগতের নিয়ম মেনে। এই তো জগৎ সংসার। এ নিয়ে বিমলেন্দুবাবু অবশ্য তেমন বিচলিত নন মোটেও। বরং যে ক’দিন আছেন সংযমের মধ্যে তাকে উপভোগ করে যেতে চান যতটা সম্ভব। চিন্তা একটাই উড়ে যাওয়ার পর যেন কেউ আঙুল না তোলে তার দিকে। এমন কোনও কাজ তিনি করেননি যাতে তাঁর চলে যাওয়ার পর দিকে দিকে তাঁর শোকসভা হবে কিংবা বছর বছর তাঁর জন্ম কিংবা মৃত্যুদিন পালন করবে জনগণ। নিতান্তই দশের এক হয়েই তাই নিজের কাজটুকু করে কাটিয়ে দিতে চান বাকি জীবন। অফিসের কাজ পুরোটা সামলে যেটুকু সময় থাকে তাতে এক আধটু লেখালেখি, খানিকটা গানবাজনার অভ্যেস বহুদিনের।
কী করে যে এই লেখালেখির ব্যাপারটা হল তা নিজেও জানেন না। আসলে প্রায় তিন কুড়ি বছরের জীবনে এত এত চরিত্ররা এসেছে তাঁর সামনে যে অবসরে এসব মানুষদের কথা ভাবতে ভাবতেই আছন্ন হয়ে পড়তেন বিমলেন্দুবাবু। সেই তাদের কথাগুলোই যাতে হারিয়ে না যায় তারই এক প্রয়াসে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতেন নিয়মিত। লিখতে লিখতে একদিন নিজেই বুঝতে পারলেন যে লেখালেখির ধার তাঁর বেড়ে গেছে অনেকটাই। তার কিছুটা অবশ্যই ভালো ভালো বইপত্র পড়ার ফল। সেই থেকে বলা যায় অনেকটাই নেশার মতো হয়ে গেছে ব্যাপারটা। এখন বয়স যত বাড়ছে ততই যেন তাঁর মনে হচ্ছে অনেক বাকি থেকে গেছে লেখার। যেখানেই যান, যাকেই সামনে থেকে দেখেন, কথা বলেন - যেন মনে হয় প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি সত্তা একে অপরের থেকে ভিন্ন। সবার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে জীবনের লুক্কায়িত গল্প সম্ভার।
আজও, এই শীতের সকালে ঘরে বসে বসে ঠাণ্ডায় জবুথবু হচ্ছিলেন বিমলেন্দুবাবু। স্ত্রী অণিমা এসে বললেন -
সেই ছোটোবেলায় বাতের ব্যথায় প্রায়শ কাতর থাকা মা যখন রাত জেগে বই পড়ে শেষ রাতে ঘুমোতেন আর দেরি করে উঠতেন তখন সেই সাতসকালেই রুনুর মা মাসি এসে ঘরদোর মায় সারাটা উঠোন ঝাড়ু দিয়ে সাফসুতরো করে উনুন ধরিয়ে চায়ের জল বসিয়ে মাকে ডেকে উঠাতো। শুরু হতো একটা সুন্দর সকাল।
সেই থেকে আজকের নমিতা অবধি বিমলেন্দুবাবুর সংসার সহায়িকা-নির্ভর। শুধু তাঁরই নয় আশপাশের দশটা বাড়িরও একই হাল। নমিতাকেও ওর নিজের সংসার সামলাতে তাই কাজ করতে হয় আরোও তিনটে বাড়িতে। সব মিলিয়ে চার ঘর। ঈশ্বর এদের দশভূজা করে এই সংসারে পাঠান নিঃস্ব অবস্থায়। এরা খেটেখুটে আরোও পাঁচ জনের পাশাপাশি নিজের সংসারেরও হালটা ধরে রাখে শক্ত হাতের মুঠোয়।
সেই যে রুনুর মা মাসি মাস ফুরোতে কিছু টাকা আর প্রতিদিন দুমুঠো অন্নের সংস্থানের বিনিময়ে হাল ধরে রাখতেন বাড়ির সেই থেকে চলে আসছে এই ট্র্যাডিশন। এখন নমিতা ঘরে এলে সমস্যা হয়ে যায় বিমলেন্দুবাবুর। নমিতা ঝড়ের মতো একোঠা ওকোঠা একবার ঝাড়ু দিয়ে আবার আসে জল ন্যাতা নিয়ে ফ্লোরটাকে মুছে দিতে। বিমলেন্দুবাবু তার অসমাপ্ত কাজ ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়েন বিছানায়। অন্যথা নমিতার দাপটে দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই সময়টা তাই বাইরে থাকাই পছন্দ করেন তিনি। অফিস খোলা দিনে চেষ্টা করেন নমিতা এসে ঢোকার আগেই যাতে বেরিয়ে পড়তে পারেন। রবিবার বা বন্ধ দিনগুলোতে হয় সমস্যা। এদিন অণিমার কথায় তাই স্বস্তি পেলেন বিমলেন্দু। অণিমার থেকে বাজারের ফর্দ নিয়ে তড়িঘড়ি বেরোতে না বেরোতেই নমিতা ঢুকল ঘরে। বিমলেন্দু কোনওক্রমে ওকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
বাইরে এসে কনকনে ঠাণ্ডা থেকে মুক্তি পেলেন নরম রোদের পরশে। ধীরে ধীরে স্টার্ট দিলেন নতুন কেনা স্কুটি। সোজা গিয়ে হাজির হলেন বাজার সংলগ্ন চায়ের দোকানের সামনেটায়। স্কুটি দাঁড় করিয়ে বাজারের থলেটা হাতে করে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলেন মাছের দিকটা থেকে থলে হাতে বেরিয়ে আসছেন সহকর্মী সুপ্রতিমবাবু। তাঁর কাছ থেকেই মাছ বাজারের হাল হকিকতটা জেনে নিয়ে এবার চায়ের দোকানে ঢুকে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। কাপটা হাতে দোকানের বাইরের ফুটপাতে যেখানে রোদ এসে পড়ছে তার যাবতীয় উষ্ণতা নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন চায়ের আস্বাদ। দেখে নিলেন চেনা চারপাশকে আবারও। পাশেই পুরোনো বটগাছকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজার বিশ্বাস নিয়ে কেউ একজন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে কয়েকটি ধুপকাঠি। ধুপের গন্ধে, রোদের আবেশে বিমলেন্দুবাবুর যেন নিমেষেই দূর হয়ে গেল ঠাণ্ডাজনিত যাবতীয় অবসাদ। এবার সবে বাজারের ভেতরে প্রবেশ করতে যাবেন তখনই পাশের দোকান থেকে বন্ধুসম দোকানদার মালিক হাঁক পাড়লেন - ‘গুড মর্ণিং স্যার। কুছ নেহি চাহিয়ে আজ ?’
একদিন কলেজে যাওয়ার আগে ভাত খেয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে মা ও সাবিত্রী দিদির কিছু কথা কানে এল বিমলেন্দুর। ভাতের থালায় তরকারি দিয়ে মাখা কিছুটা ভাত অবশিষ্ট থেকে গিয়েছিল সেদিন। বিমলেন্দুর আর খেতে ইচ্ছে করছিল না। তখন খেতে বসেছিল সাবিত্রী দিদি। বিমলেন্দুর থালার অবশিষ্ট মাখা ভাতটুকুও সে নিয়ে নিল নিজের থালায়। দেখে মা হইহই করে উঠলেন…
হয়তো কোনও এক বহু দিনের সুপ্ত ব্যথা ছলকে উঠেছিল সেদিন সাবিত্রী দিদির বুকে। এক নারীর চিরন্তন পাওয়া না পাওয়ার ব্যথা। স্বামীসঙ্গ, সন্তানসুখ। তবে বিমলেন্দুবাবু সেই যে শুনলেন সেই কথা সেই থেকে একেবারে নিজের দিদি হয়ে উঠল সাবিত্রী। এমনিতেও নিজের দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে একটা শূন্যতা এসে গ্রাস করেছিল বিমলেন্দুর অন্তরে। সেই থেকে আজও, এই প্রায় দুকুড়ি বছর পরেও প্রায়শ মনে পড়ে যায় সাবিত্রী দিদির কথা।
সেদিনের পর কিছুদিনের মধ্যেই বিমলেন্দু প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হতে পাড়ি দিয়েছিলেন দূরে। তখন ফোন ছিল না। চিঠিচাপাটি হতো। ভালোমন্দ খবর আদানপ্রদান হলেও সাবিত্রী দিদির ব্যাপারে আলাদা করে আর কিছু জানা হয়নি বহু দিন। প্রায় মাস ছয়েক পর বাড়ি ফিরে সাবিত্রী দিদিকে দেখতে না পেয়ে জানতে পেরেছিলেন ওকে নাকি বিমলেন্দুর বাইরে যাওয়ার কয়েকদিন পরই কাজ থেকে বিদেয় দেওয়া হয়েছে। কী ছিল ওর অপরাধ ? তাকে নাকি কেউ দেখে ফেলেছিল পাশের ঘরের অবিবাহিত অতনুকাকার সাথে দাঁড়িয়ে নিভৃতে কথা বলতে। জল বেশিদূর গড়াতে না দিয়ে তাই ছুটি হল সাবিত্রী দিদির। ওবাড়ির অতনুকাকা যিনি ছিলেন বিমলেন্দুর খুব প্রিয় একজন ব্যক্তি, তাঁকেও নাকি অনুশাসন ভঙ্গের জেরে মাসকয়েকের জন্য পাঠানো হয়েছে বাইরে। গ্রাম্য পরিবেশে তখনকার দিনে অভ্যন্তরীণ নিয়ম নীতি, আচার বিচার খুব কড়া ছিল কিনা। সেই থেকে যতবার বিমলেন্দু বাড়ি গেছেন ততবারই খবর নিয়েছেন সাবিত্রী দিদির যদিও দেখা হয়নি আর। শেষটায় বাড়ি ছেড়ে শেষবারের মতো চলে আসার পর আর খবর পাওয়া যায়নি তাঁর।
আজ দীর্ঘ দিনের শেষে হয়তো বৃদ্ধা হয়ে গেছেন সেদিনের সুন্দরী সাবিত্রী দিদি। যাঁর নামটাই ছিল এক প্রহসন। বিবাহোত্তর প্রায় সারাটা জীবন সাদা কাপড় পরেই যিনি কাটিয়ে দিলেন যাপনকাল। কিংবা আজ হয়তো ছেড়ে চলে গেছেন এই পৃথিবী - ভালোবাসায় একের পর এক বঞ্চনার দুঃখ সয়ে সয়ে। তাঁর কথা মনে এলেই আনমনা হয়ে পড়েন বিমলেন্দু। ভেতর থেকে প্রতিবারই স্বগতোক্তির মতো বেরিয়ে আসে -
ভাল লাগল পড়ে,বিদ্যুত।
ReplyDeleteধন্যবাদ অনেক অনেক
Deleteঅপূর্ব
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete