Skip to main content

সত্য ও সুন্দরের সন্ধান ‘চিরন্তন অক্ষর’


শাস্ত্রে আছে ঈশ্বর নিজে নাকি একজন কবি আবার প্রত্যেক কবিই নাকি এক একজন ঈশ্বর কেউ কেউ বলেন সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। তবে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কবিতা লিখতে পারা মানুষের সংখ্যা এতটাই সীমিত যে তাঁদের সবাইকেই কবি হিসেবে ধরে নিলেও মহাভারত যে অশুদ্ধ হয়ে পড়বে তেমন নয় প্রতিষ্ঠিত কবিদের অবশ্য এতে আপত্তি থাকারই কথা তবে বাকিদের কাছে এটা এমন কোনও দোষণীয় ব্যাপার নয়
কবি অমিতাভ সেনগুপ্ত সেই অর্থে ঈশ্বরই বটে তাঁর কবিতায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ঈশ্বরের প্রতি দায়বদ্ধতা, সমর্পণ, অভিযোগ ইত্যাদি প্রতিটি আঙ্গিকের উপস্থিতি অনুভব করা যায়। ঈশ্বরকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে যাঁরা উপস্থাপন করেন, বলা ভালো বিনির্মাণ করেন তাঁদের কৃতকর্মকেও খুঁজে পাওয়া যায় অমিতাভের কবিতায়। সেই অর্থে তিনিও একজন প্রতিষ্ঠিত কবি।
এই কবির অন্যতম সদ্য-প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘চিরন্তন অক্ষর’। নানা অনুষঙ্গে জীবনের সত্য ও সুন্দরের পাশাপাশি মৃত্যুর সত্য-সুন্দর আবহকে। তাই তো কবির জীবনবোধ যেন ঠিকরে বেরোয় একের পর এক পঙ্‌ক্তির শরীর বেয়ে -
প্রতিদিনই আমি জ্বলে যাই নিজস্ব আগুনে
তোমরা যারা তাকে নক্ষত্রের নীলাভ আলোক
বলে জানো, আসলে সে আমার
নিজেরই পুড়ে যাওয়া নিজের ভেতর। (চিরন্তন অক্ষর - ৭)
এমনকি জীবনানন্দের দুঃসহ মৃত্যুর আবহকেও কবি ধরে রেখেছেন জীবনানন্দীয় ধারায় - সমকালের আঙ্গিকে, বাস্তবতায় -
এখানে কোনো ট্রামগাড়ি নেই -
তবে অনেক চলমান লরি বাস আছে,
জীবনের আনন্দে উদাস হেঁটে গেলে
হয়তো কোনোদিন চলেও যেতে পারি
কোনও এক দুরন্ত ট্রাকের নীচে।
আমার থেঁতলানো হাড়গোড় মাংস মজ্জা
থেকে, হয়তো কয়েকগাছা চুলের মতো -
খুঁজেও পেতে পারো আমার কিছু চূর্ণকবিতা।
আগুন ছুঁড়ে দেবার আগে -
আমার না বলা কবিতাগুলি বাতাসে ভাসিয়ে দিও। (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৪)।
বিশিষ্ট গল্পকার মিথিলেশ ভট্টাচার্য কবির অতি আপন গুরুসম, বন্ধুসম ব্যক্তি। কবির প্রেরণার শক্তি হিসেবে তিনি উদাত্ত চিত্তে স্বীকার করেন এই তথ্য। বেশ কিছু কবিতায় আমরা পাই মিথিলেশের প্রতি কবির দুর্বলতা, সম্মান, অভিযোগ আবদারের আবহ। এই সুযোগে জীবনানন্দেরই উল্লেখ সহ কবি অমিতাভের কবিতা নিয়ে মিথিলেশ ভট্টাচার্যের মূল্যায়ন সব চাইতে বেশি প্রাসঙ্গিক হবে। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের ব্লার্বে আছে মিথিলেশের বয়ান - ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইয়ের ভূমিকায় জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন - কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস - শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়। অমিতাভ সেনগুপ্তের কবিতাগুলো পাঠ করতে বসলে উপরের কথাগুলি মনে পড়ে। কবিতার বহিরঙ্গ রূপের পরিবর্তে অমিতাভ’র সবিশেষ ঝোঁক অন্তরঙ্গ রূপের দিকে। তাঁর রচিত কবিতায় মানব জীবনের অতলান্ত ব্যপ্ততার ছবি ফুটে ওঠে। এক জীবনের পরতে আরও বহু জীবনের সন্ধান তাঁর কবিতাকে সত্যিকার অর্থে করে তোলে রহস্যময়। চেতনার গভীরতম স্তর থেকে উঠে আসে তাঁর জীবন অভিজ্ঞতার উপলব্ধির কথা। আজকের সময়ে অমিতাভ সেনগুপ্ত এক স্বতন্ত্র কবি হিসাবে উপস্থিত হন মনোযোগী পাঠকের কাছে...।’  
কবিতায় কবি অমিতাভ মিথিলেশের প্রতি লিখেন -
বড় কষ্টে বেঁচে আছি মিথিলেশ,
বড় কষ্টে বেঁচে আছি।
ম্লান মুখে শুধুই কি দেখে যাবে,
দেখো জীবন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আমাকে ডাক্তার দেখাবে না ?
কোথায় ডুবে আছো নিজের ভিতর
আর দেখে যাচ্ছো একটা জীবনের পতন -
বিষে বিষে জর্জরিত হয়ে পড়েছি
অথচ নীলকণ্ঠ হবার মারকোচ
আমি শিখিনি, মিথিলেশ...। (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৩২)।
এখানে কবিকে আমরা বাস্তবের গভীর সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। এই কষ্ট, এই অ-সুখ পাঠক হৃদয়ে ঝড় তোলে। এই গ্রন্থের অন্তর্গত কবিতায় স্পষ্ট ধরা দেয় এক পথক্লান্তি। এখানে এসে কবি যেন ঘোর থেকে বেরিয়ে কোনও এক হিসেবনিকেশের কথায় মজেছেন। পাততাড়ি গোটানোর ভঙ্গিমায় জীবনকে যেন কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে চাইছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এক ঘোর সমর্পণে নিজেকে করেছেন নিবেদন -
আমি বাঁচতে পারিনি কোনোদিন তোমাদের মতো
শান্তি নেই, স্বস্তি নেই...
কী এক অসুখের মতো লেগে আছে ঘোর
কবিতার অক্ষরে লিখে রেখেছি তাহা... (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৪৪),
তুমি তো আসবেই জানি,
এই শরীরে রেখেছি তার আয়োজন
পালিয়ে যাবো তোমার হাত ধরে
কোনও এক অজানার দেশে।
তুমি তো আসবেই জানি
শরীরে জাগে অনেক গোপন ইশারা ...। (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৭৩)।
এ কীসের ঈশারা কবিই তা বলতে পারবেন। এই আবহে তাঁর সৃষ্ট কবিতাকে নিয়েও ঝরে পড়ে কবির উদ্‌বেগ - সমর্পণে সমর্পণে -
...তুমি আছো জানি আমারই চারিপাশে
এতো লুকোচুরি খেলো না আমার সাথে
শুনি আমার ভাঙাপথের ধুলায় ধুলায়
চরণধ্বনি তোমার রুনু ঝুনু বেজে যায়।
আমার ব্যর্থ কবিতারা কান পেতে থাকে
শুনি কী এক বিস্তার
উঠোনে প্রাঙ্গণে মাঠে ঘাটে আকাশে
ভেসে যায়, ভিজে যায়,
আমার চিরন্তন অক্ষর। (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৬৭)।
কলকাতার চিন্তা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ৭৭ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ৭১টি শিরোনামবিহীন কবিতা। ছাপার স্পষ্টতা ব্যাহত হলেও বাঁধাই, শব্দবিন্যাস আদি যথাযথ। বিন্যস্ত পঙ্‌ক্তিসম্বলিত গ্রন্থটির মনোময় প্রচ্ছদের সৌজন্যে রাজীব চক্রবর্তী। গ্রন্থের সার্বিক মূল্যায়ন নিয়ে প্রথম ব্লার্বের কথা ক’টি উদ্ধৃত না করলে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে আলোচনা - ‘আবহমানকাল থেকে সকল রকম শিল্প সৃষ্টিতে যে সর্বজনীন সত্য ও সুন্দরের সন্ধান চলেছে সেই পথের পথিক এই কাব্যগ্রন্থের কবিও। চিরন্তন অক্ষরের আভাস তাঁকে বালকবেলা থেকে আজও তাড়িয়ে ফিরছে। সেই অধরা, অরূপকে দু’হাতের ভিতর ধরার ব্যগ্রতাই তাঁকে দিয়ে শব্দ সাজানোর অক্লান্ত কাজে মগ্ন রেখেছে, লাইনের পর লাইন লিখে যেতে বাধ্য করেছে…।’

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ৩০০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২২৩০৪৩০

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি