Skip to main content

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’


‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’-এর
সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি। ৬০ পৃষ্ঠার সংখ্যাটিতে রয়েছে ৮টি নিবন্ধ, ৫টি ছোটোগল্প, ১টি সাক্ষাৎকার, শাখা সংবাদ এবং একগুচ্ছ কবিতা। লেখা সংগ্রহ ও নির্বাচনে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সম্পাদক মনোজকান্তি ধর। রতীশ দাস-এর সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ ‘মনরে কৃষি কাজ জানো না’ প্রথমেই পুরো পত্রিকার মান বাড়িয়ে দিয়েছে বলা যায়। সুললিত শব্দাবলি ও ভাষানৈপুণ্যে এক গভীর মননসঞ্জেত নিবন্ধ। বইপত্র পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও নিয়মিত পঠনের এক আবেগিক আহ্বান। নিবন্ধ ‘জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ - একটি অবলোকন’ লিখেছেন নিত্যানন্দ দাস। শিরোনামভিত্তিক বিষয়ের উপর গভীর অনুসন্ধান ও অবলোকন প্রত্যক্ষ করা যায় এই নিবন্ধে। ড. সাথী দে লিখেছেন ‘সাহিত্য-সাধনায় অসমের দুই ব্যক্তিত্ব - শঙ্করদেব ও লক্ষ্মীনাথ’। দুই কৃতী ব্যক্তিত্বের সাহিত্য সাধনা নিয়ে এক ব্যতিক্রমী ও বিস্তৃত প্রতিবেদন। এক অনালোচিত দিগন্তের সন্ধান। ফলত অবশ্যপাঠ্য এক নিবন্ধ। শিরোনামভিত্তিক নিবন্ধ ‘বই নিয়ে হইচই’ - লিখেছেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। এই বিভাগে পত্রিকার তরফে সন্নিবিষ্ট হয়েছে বই নিয়ে মনীষীদের একগুচ্ছ উক্তি। খুবই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়।
‘নেপালী ভাষা সাহিত্যিক ডম্বরু দাহালের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাখা সম্পাদক মনোজকান্তি ধর ও সভাপতি রতীশ দাস। উন্মোচিত হয়েছে শ্রী দাহালের সাহিত্যকৃতি ও জীবনচর্যার অপ্রকাশিত দিগন্ত। সুখপাঠ্য প্রতিবেদন।
পাঁচটি গল্পের সব ক’টিই বৈচিত্রে ভিন্ন, আঙ্গিকে ভিন্ন। আদিমা মজুমদারের গল্প ‘লিভ-ইন’। সংকীর্ণতায় ভরপুর সমাজের অভ্যন্তর থেকে উত্তরণের এক সাবলীল গল্প। সাহসী উচ্চারণ - আদিমা-সুলভ। মনোজকান্তি ধরের গল্প ‘পার্শ্ব পদধ্বনি’। মনস্তত্ত্ব বিষয়ক একটি চমৎকার গল্প। গল্পের প্রথম দিকে কিছু অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার কিংবা চরিত্রনাম দেখে বিদেশি বা ভিনভাষী গল্পের অনুবাদ বলে মনে হতেই পারে। তবে শেষটায় দেশি আবহ খুঁজে পাওয়া যায়। এবং অনুবাদ বিষয়ক কোনো উল্লেখও নেই। সেই হিসেবে মনোজের গল্প এক কথায় ব্যতিক্রমী। গল্পকার সুব্রত দত্ত স্বভাবসিদ্ধ লিখনশৈলীতে লিখেছেন গল্প ‘উজান গাঙের নাও’। না কোনও গ্রাম্য জীবনের চরিত্রচিত্রণ নয়, সবদিক সামলে সাহিত্যে দেশভাগ কিংবা বলা যায় দেশভাগের উপর লেখা সাহিত্যকে বিষয় করে লিখেছেন একটি গল্প যা ভাবায় পাঠককে। নিবন্ধের বিষয়কে গল্পে উপস্থাপন বড় সহজ কথা নয়। করে দেখালেন সুব্রত। তরতরিয়ে এগোচ্ছিল রমা মজুমদারের গল্প ‘চেতনা’। শেষটায় এসে যেন কোথায় হারিয়ে গেল গল্প। রয়ে গেল শুধু এক প্রত্যয়ের বার্তা। তবে গল্পের গঠন যাই হোক, বহুচর্চিত হলেও এক জ্বলন্ত সমস্যাকেই বিষয় করে নিয়েছেন গল্পকার। ‘পরিণতি’ শিরোনামে খেতখামারে রাসায়নিক দ্রব্যের বিষক্রিয়ার ক্ষতিকর দিকগুলি গল্পচ্ছলে লিখলেন মোহিত চন্দ।
কবিতা বিভাগে রয়েছে সাতটি কবিতা ও একটি ছড়া। কবিরা হলেন বিশ্বজিৎ দেব, অপূর্ব দেব, মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম, রুবী গুপ্তা, শিল্পী দাস ও কল্পনা দে। কবি রতীশ দাস অনুবাদ করেছেন কবি লাইরেনলাকপম শ্রুতিকুমারের মণিপুরি কবিতা। শিরোনাম ‘পৃথিবী তুমি যখন শিশু ছিলে’। চার লাইনের ১৫টি ছড়ার সমাহার ‘ছড়ায় ছড়ায় খোঁজাখুঁজি’। লিখেছেন হরিপদ চন্দ। হারিয়ে যাওয়া দিন আর শব্দাবলির স্মৃতিচারণ।
স্পষ্ট ছাপা ও কাগজ, অক্ষর ও শব্দের যথাযথ বিন্যাস, অক্ষর-আকার, পৃষ্ঠা বিব্যাস, শুদ্ধ বানান পত্রিকাটির সম্পদ হয়ে রইল। কবিতা বিভাগের শৈল্পিক অলংকরণ লক্ষণীয় হলেও কবিতার সংখ্যা অপ্রতুল মনে হয়েছে। কবিতার উৎসাহী পাঠক কিছুটা হলেও বঞ্চিত। সব মিলিয়ে এক সার্বিক উৎকর্ষ ও গরজের পত্রিকা ‘সম্পর্ক’ - বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২৫৩৮১৪২ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়