Skip to main content

পূজা ও তর্পণ - অভয়া তৃপ্যতু

পুজো এসে গেল ফের। পুজো মানে দুর্গা পূজা। সাত্ত্বিক ভাবে পূজার উৎপত্তি যদিও ক্রমে বড়লোকের পুজোয় রাজসিক ভাব চলে এল এবং যুগের তাগিদে তামসিকও। অর্থাৎ তিনটি ভাবের সংমিশ্রণে পুজো এখন আর শুধু পূজাতে সীমাবদ্ধ নয়। এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে গেছে বহু দূর। রাজসিক ও তামসিক ভাব যুক্ত হওয়ায় পুজো এখন রূপান্তরিত হয়েছে উৎসবে। এই উৎসব এখন নয় শুরু হয়েছে বহুকাল আগে থেকেই। ইতিমধ্যে তা বাংলা তথা বাঙালির সর্ববৃহৎ উৎসব হিসেবে পরিগণিত ও মান্য হয়েছে। এবং তখন থেকেই সমাজে শুরু হয়েছে মিথ্যাচার ও তামসিকতার বাড়বাড়ন্ত। ধর্মনিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে এক শ্রেণির স্বধর্মবিরোধী লোকেরা ছড়াতে শুরু করলেন এই বলে যে এটা পুজো নয় এটা উৎসব। বিশেষ এই শ্রেণির মানুষ যারা পূজাআচ্চা মানেন না তারা মরিয়া হয়ে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে লাগলেন সমাজে। সেই থেকে আজ অবধি সাত্ত্বিকতার বড্ড অভাব বোধ হয় এই পূজায়। প্যান্ডেল, লাইটিং, মূর্তির উচ্চতা, সাজসজ্জায়, আড়ম্বরে যা খরচ হয় সম্ভবত তার অর্ধেকও খরচ হয় না সাত্ত্বিকতায়, আচারে, উপচারে।
অথচ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় কত গভীর এই পূজাপর্ব। এখানে প্রাকপূজার কিছু নিয়মনীতি নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে এই আলোচনা। পূজা শুরু হয় আশ্বিনের শুক্লা ষষ্ঠীর বোধনপর্ব দিয়ে। তারও এক সপ্তাহ আগে অমাবস্যা থেকে শুরু হয় দেবীপক্ষ। অর্থাৎ মহালয়া থেকে লক্ষ্মীপুজো এই এক পক্ষ দেবীপক্ষ। আবার তারও এক পক্ষ আগে থেকেই শুরু হয় পিতৃপক্ষ। এই পিতৃপক্ষ শব্দেও আবার সেইসব তথাকথিত উদার মানুষরা এবং তথাকথিত নারীবাদীরা প্রশ্ন তুলেন পিতৃপক্ষ কেন ? মাতৃপক্ষ নয় কেন ? বলাই যেত মাতৃপক্ষ। তাতে কিছুই যেত আসত না। কিন্তু যেহেতু হিন্দু ধর্মের এবং ভারতীয় সমাজ পিতৃতান্ত্রিক তাই বলা হয় পিতৃপক্ষ। সন্তান জন্মের পর পিতার পদবিই ধরে রাখে এখানে। তা বলে মাতৃজাতি কোনোদিনই অপাংক্তেয় বা অসম্মনিত ছিল না। তারই প্রমাণ ‘পিতৃপক্ষ’ শব্দটির ভিতরেই রয়েছে মাতৃদেরও যথাযোগ্য স্থান। কী করে তা বোঝা যাবে ? আসি সেই পর্বে।
হিন্দু ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী যদি আমরা প্রতিটি আচার অনুষ্ঠান এবং সেগুলো পালনের নিয়ম নীতি বা পদ্ধতিগত মন্ত্রের ব্যাখ্যায় যাই তাহলেই তা বোঝা যাবে জলের মতো। পিতৃপক্ষের শুরু থেকেই আরম্ভ হয় প্রয়াত পিতৃপুরুষের উদ্দেশে জলদান অনুষ্ঠান যা আমরা তর্পণ বলে জানি। তিল ও জলদান করা হয় বলেই বলে তিলতর্পণ। এই পর্বে যেমন পিতার দিকের প্রয়াতদের উদ্দেশ্য করে তর্পণ করা হয়, তেমনি মায়ের দিকেরও। বস্তুত মাতৃঋণ অধিক বলে পুরাকাল থেকেই বলা হয়ে আসছে এবং সেই সূত্রেই মাতৃপক্ষকেই অধিক জলদানের প্রথা বা নিয়ম রয়েছে তর্পণকালে। তর্পণে পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহরা যেমন থাকেন তেমনি থাকেন মাতা, পিতামহী, মাতামহী, প্রপিতামহী, প্রমাতামহীরাও। সুতরাং পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে সব সময় কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোনও মানে হয় না।
আসা যাক তর্পণ প্রসঙ্গে, যা এই নিবন্ধের মূল বিষয়। তর্পণ করতে হয় স্বচ্ছ আবহাওয়াযুক্ত প্রভাতে স্বচ্ছসলিলা জলাশয়ে এক হাঁটু দাঁড়িয়ে যথাযথ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে। পরিবর্তিত দিনকালের সহজলভ্যতা অনুযায়ী নদীর পাশাপাশি পুকুর বা আপৎকল্পে আধারিত জলাধারেও সারতে অনেকেই বাধ্য হন আজকাল। নান্য পন্থা। তর্পণবিধিতে উল্লেখ আছে - ‘পুত্র, পৌত্রাদি না থাকিলে প্রয়াতের স্ত্রী তিল ও কুশের দ্বারা স্বামী, শ্বশুর ও আর্যশ্বশুরের (শ্বশুরের পিতার) তর্পণ করিতে পারেন... পিত্রাদির নাম উল্লেখ করত যে বাক্য করিতে হয়, তাহা করিবে; তাহাতে কোন নিষেধ নাই।’ এখানে আমরা স্ত্রী-আচার তথা স্বামীর নাম উচ্চারণ করতে পারার বিধান পাই প্রাচীনকাল হতেই। পিতৃতর্পণকালে ক্রমান্বয়ে যেসব মন্ত্র উচ্চারিত হয় সেসবের অর্থ জানলে আমরা এক সুসংঘবদ্ধ তথা যুক্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার ছবি দেখতে পাই যেখানে আজকের মতো স্বার্থসর্বস্ব নয় বরং পরার্থেও যে আমাদের করণীয় কিছু থাকে তারও এক সুন্দর উদাহরণ প্রত্যক্ষ করতে পারি। স্বর্গগত পিতৃপুরুষের যথানিয়মে এবং যথাযথ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে উত্তরসূরির দায়িত্ব পালন করার মতো এক স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করা যায়।
শরতের স্নিগ্ধ সকালে নদী বা ঝরনাধারায় অবগাহন করে পিতৃপুরুষকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে হৃদয়ে যে এক অনাবিল অনুভূতির জন্ম হয় তার কোনও তুলনা হয় না। স্বর্গগত দুই বা তিন পুরুষের স্নেহ, সাহচর্য এবং তাঁদের অবর্তমানে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়। একে একে সবার নাম ধরে ‘তৃপ্যতাং’ শব্দে গণ্ডূষ ভরে অর্ঘ্য ও জলদান করার সময় চোখ ভিজে আসে দুঃখ ব্যথায়। সবচাইতে বেশি অবাক করে শেষ পর্বের মন্ত্রগুলি। এখানে আছে - ওঁ যেঽবান্ধবা বান্ধবা বা, যেঽন্যজন্মানি বান্ধবাঃ তে তৃপ্তিমখিলাং যাস্ত, যে চাস্মত্তোয়কাঙ্ক্ষিণঃ। অর্থাৎ যাঁরা আমাদের জন্ম জন্মান্তরের বন্ধু ছিলেন বা বন্ধু ছিলেন না, যাঁরা আমাদের থেকে জলের প্রত্যাশা করেন তাঁরা সম্পূর্ণ তৃপ্তিলাভ করুন। এই মন্ত্রোচ্চারণ কালে এই জীবনে পরলোকগত বন্ধুদের ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তাদের সান্নিধ্যে একসময় দিন কেটেছে যে হর্ষ আনন্দে আজ তাদের প্রয়াণে দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে অন্তর। তর্পণমন্ত্রে আরোও আছে - আব্রহ্মস্তস্বপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু। অর্থাৎ ব্রহ্মা থেকে তৃণ পর্যন্ত জগৎ, জগতের লোক, স্থাবর জঙ্গমাদি সবাই তৃপ্ত হোন। এবার স্বজন, আত্মীয়, বন্ধুর বাইরেও যে এক পরিচিত (সান্নিধ্যে থাকা বা অসান্নিধ্যে) জগৎ রয়েছে তাদের ছবিটাও ভেসে ওঠে সামনে।
এবছর আমাদের নিকট অঞ্চলে দেশ বিদেশের যেসব ব্যক্তি অকালে নৃশংসভাবে নিহত হলেন জীবিত অসুরদের হিংসার ছোবলে তাদের ছবিই ভেসেছে চোখে। চোখের জলে এক গণ্ডূষ জল নাহয় সমর্পিত হোক তাদের জন্যও। অভয়াদের আত্মা তৃপ্তিলাভ করুক। অভয়ে, অকুতোভয়ে, নির্ভয়ে নিরাপদে থাকুক অভয়ারা এবং তাবৎ মানুষেরা এই প্রার্থনাই রইল এবছরের তর্পণকালে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়