Skip to main content

প্রতিবাদী শরৎ

কেমন শরৎ এল এবার ? বর্ষা শেষের পক্ষকাল আগে থেকে চারপাশ জুড়ে যে অস্থিরতার সূত্রপাত তা এসে নতুন করে প্রকাশিত হল শরতের সূচনায় বাংলাদেশের পর পশ্চিমবঙ্গে এমন শরৎ আগে দেখিনি কখনও আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য শরতের এক অন্যরকম মাহাত্ম্য পেঁজা তুলোর মেঘের ফাঁকে ফাঁকে একদিকে যেমন রংবেরং-এর ঘুড়ি ওড়ে আকাশে অন্যদিকে তেমনই শিশিরসিক্ত সকালের ঘাসবনে লুটিয়ে পড়ে রাতের বৃন্তচ্যুত শিউলি মা দুর্গার চরণপথে দিকে দিকে এক গন্ধমাতন আলোড়ন নদীচরে, পাহাড়ের ঢালে গুচ্ছ কাশের দোলায় দোলে ওঠে অঙ্গ কাশের বনে খেলে বেড়ায় নব্যদুর্গারা।  
আলোড়ন মনাকাশ জুড়েও মাতন মনন জুড়েও দোলন আবালবৃদ্ধের অঙ্গে অঙ্গে আকাশে বাতাসে কান পাতলে, চোখ রাখলেই মাতৃমুখ - মননসুখ মা আসছেন দুর্গতিনাশিনী মা বরাভয় হাতে তিনি ঘুচিয়ে দেবেন যত দুঃখশোক অসুরশূন্য হবে পৃথিবী
প্রতিবারই এভাবে শরৎ আসে পৃথিবীর বুকে, প্রতিবারই আমরা এমনই ভাবনায় ডুবে থেকে এমনই কল্পনায় করি দিনাতিপাত অথচ চোখের সামনেই আমরা দেখতে পাই নিয়ত বেড়ে চলেছে অসুরদের উৎপাত খুন, জখম, ধর্ষণ, অত্যাচার, অনাচার, দুর্দশা, উৎপীড়ন, কুশিক্ষা, ধর্ম-ভাষার অন্ধতা, হিংসা, বিদ্বেষ, সংকীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, লোভ, লালসা, রাহাজানি, লুটপাট, মিথ্যাচার, স্বার্থপরতা, দুর্ঘটনা, প্রতারণা, নির্লজ্জতা, ভীতি প্রদর্শন, অপহরণ, দলবাজি, সংঘর্ষ, নিন্দাবাদ, মুর্দাবাদ, বঞ্চনা, হয়রানির বাড়বাড়ন্ত এসব কিছুই আমাদের চাওয়ার বিপরীত
কেন এমন হয় ? আমাদের কি তবে শুভ হবে না কোনোদিন ? মা তো অসুরদলনী, কেন তবে অসুরদের এত দাপাদালি ? সিনেমা, টিভি, সিরিয়ালে যেমন ভিলেনদের রমরমা, তেমনি বাস্তবেও ? এ ওকে ঠকাচ্ছে, প্রতারণা করছে। প্রয়োজনে সরিয়ে দিচ্ছে এই পৃথিবী থেকে। মা কি এসব দেখেন না ? আমাদের ভক্তির জোর কি এতটাই কমে গেল ? অথচ এই দেশ, আমাদের ভারতবর্ষ যুগ যুগ ধরে সত্য আর নিষ্ঠার ভারতবর্ষ, ভক্তির ভারতবর্ষ, আধ্যাত্মিকতা ও পরম্পরার ভারতবর্ষের আজ এ কেমন রূপ ?
মায়ের তো দশ রূপ দশ মহাবিদ্যা - কালী তারা মহাবিদ্যা ষোডশী ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তাশ্চ বিদ্যা ধূমাবতীস্তথা। বগলা সিদ্ধবিদ্যাশ্চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা। অর্থাৎ মুণ্ডমালা তন্ত্র অনুসারে দশমহাবিদ্যা হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করা হয় কালীকে যিনি ব্রহ্মের চূড়ান্ত রূপ, এবং সময়ের গ্রাসকারী (কালীকুল ব্যবস্থার সর্বোচ্চ দেবতা)। কেন মায়ের এত রূপ ? নিজের অপমানের বদলা নিতে জেগে উঠেছিলেন সতী। নানা রূপে নিজেকে করেছিলেন উদ্ভাসিত। সম্য দেখে নেওয়া যাক তাঁদের রূপ -
১। কালী: দেবী দুর্গার ভ্রকুটি থেকে উৎপন্ন কালী। যার চার হাতের ডান দিকে হাতে খড়্গ ও চন্দ্রহাস। বাম দিকের হাতে চর্ম ও পাশ। গলায় নরমুণ্ড
২। তারা: গায়ের রং নীল, নব যৌবনা, পরিধানে ব্যাঘ্র চর্ম। দেবীর চারটি হাত। দেবীর অবস্থান প্রজ্জলিত চিতার মধ্যে। তাঁর বাম পা শিবের বুকে অবস্থিত।
৩। ছিন্নমস্তা: দেবীর এই তৃতীয় রূপই সব থেকে ভয়ঙ্কর। বাম হাতে ধরে আছেন নিজের মাথা এবং গলা থেকে নির্গত রক্তের স্রোতগলায় মুণ্ডমালা এবং নাগ উপবীত।
৪। ষোড়শী: ষোড়শীর অপর নাম স্ত্রী বিদ্যা। দেবীর চার হাত, গায়ের রং জবাকুসুমের মতো (ভোরের সূর্যের মতো) হাতে নানাবিধ অস্ত্র। মহাদেবের নাভি পদ্মের উপর দেবী আসীন।
৫। ভুবনেশ্বরী: দেবীর গায়ের রং জবা ফুলের মতো। চার হাতে অস্ত্র ও বরাভয় মুদ্রা। চার দিকে চার জন দেবী এই দেবীকে ঘিরে আছেন।
৬। ভৈরবী: ইনি চতুর্ভুজা, হাতে অক্ষমালা। দেবী অস্ত্রহীন। এই দেবী বিদ্যা ও ধনদাত্রী।
৭। ধূমাবতী: ধূমাবতী বিধবা, শিবহীন, ভয়ঙ্করী, রুক্ষ মলিন বসনা, বিবর্ণ কুণ্ডলা, বিরল দন্তা, নিত্য বুবুক্ষিতা, অতিকৃশা, বৃদ্ধা।
৮। বগলা: দেবীর গায়ের বর্ণ পীত। বসন পীত বর্ণ। বাহন শব। বাম হাতে দুর্গম অসুরের জিহবা ধরে ডান হাতে গদা দিয়ে শত্রু দমন করেন।
৯। মাতঙ্গী: দেবী শ্যামবর্ণা, ত্রিনয়না, চতর্ভূজা ও সিংহাসনে উপবিষ্টা। এর সন্তান হাতি।
১০। কমলা: দেবী চতুর্ভূজা। দেবীর দুই ডান হাতে পারিজাত পুষ্প, বাম দিকে উপর হাতে বরমুদ্রা, সমুদ্রের মধ্যে দেবী প্রস্ফুটিত পদ্মে আসীন।
এই যে এত এত রূপ ধরে সতী ত্রিলোকধারী মহাদেবকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন অথচ আজ এই পৃথিবীতে নারীর উপর কী প্রচণ্ড উৎপীড়ন, অবমাননা। পার্শ্ববর্তী রাজ্যে এক নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন ও হত্যা। একই ভাবে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মীয় লোকজন ও মন্দিরাদিতে অত্যাচার, পীড়ন, ধ্বংসযজ্ঞ। কেন এমন হয় ? আসলে আমরা সাত্ত্বিকতা ছেড়ে উল্লাসে মেতেছি। আমাদের কাছে পুজো মানেই নতুন কাপড়, হই হুল্লোড়, দুর্গা দেখার ছলে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় গলাধঃকরণের উৎসব। পুজোর বেলায় প্যান্ডেল, লাইটিং, ডেকরেশন আর মূর্তির উচ্চতার দিকে নজর। দুস্থ নারায়ণ সেবা, পুজোর নিয়মাবলির দিকে নয়। পুজোয় আমরা সদলবলে দাপিয়ে বেড়াই গভীর রাতেও কিন্তু আমাদের উপর যখন নেমে আসে ধর্ম-ভাষার উৎপীড়ন তখন আমরা আপন ঘরে সীমাবদ্ধ করে রাখি নিজেদের। আমরা প্রতিবাদহীন। তাহলে আমাদের শুভটা হবে কী করে ? নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে হলে সাহস আর সত্যকে হাতিয়ার করতে হবে। আমাদের সজাগ, সতর্ক হতে হবে। নারীশক্তি জেগে উঠতে হবে। নারী পুরুষ একজোট হয়ে একাধারে বলীয়ান ও মহাবিদ্যারূপী হয়ে ধ্বংস করে দিতে দবে অসুররূপী অনিয়ম, অনাচারকে। তবেই শান্ত হবে এ সমাজ। অন্যথা নয়। আসবে যাবে শরৎ কিন্তু সুরভি ছড়াবে না শিউলি, শেষ হবে না এ অবদমন, অবনমন।
 
ভিত চাই, একটি শক্ত ভিত
শরৎ এসেছে।
একদিকে মা দাঁড়াবেন, একদিকে সন্তান
কবিতার শরীর বেয়ে উঠবে মায়ের মুরতি।
শিউলির ঝরাফুল পথে তাঁর চরণচিহ্ন
দেহ তাঁর শিশিরমায়ার জলরং ছায়া ছবি
শিরোপরি নবীন কাশের গুচ্ছ।
 
টানা চোখে তাঁর জগৎ সংসার
উড়ে যাওয়া একফালি সাদা মেঘ
খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে আগমনি সুর
দিন রাত কারো একাকার
হিমসিম যাপন দিন শরৎ অসার
সংসার মায়াময় বাটোয়ারা সুখে
ঘুম নেই রাতজাগা পাখিটির চোখে।
 
শরৎ এসেছে ঝেঁপে চরাচর জুড়ে
পথে পথে আলোর রোশনাই
আঁধার মাড়িয়ে কেউ
ছুটে যায় অট্টহাসির পসরা নিয়ে
প্রতিবাদ, প্রতিরোধ নিয়ে
শেষ পারানির কড়ি গচ্ছিত রাখে
মায়ের চরণতলে কবিতার ছত্রে ছত্রে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়