Skip to main content

তিথি যখন অতিথি


প্রকৃতি ও পঞ্জিকার নিয়ম মেনে ফের এলেনও দেবী এবার, আবার দেখতে দেখতে যাবতীয় শঙ্কা আর টানাপোড়েন কাটিয়ে নির্ঘণ্ট মেনে ফের পুজো শেষ ! ‘পুজো শেষবলতে কিংবা ভাবতেও বেদনায় ভরে ওঠে মনটা তৃতীয় কিংবা চতুর্থ দিন থেকেই কেমন এক বিমর্ষতা, এক মন খারাপের সুর বেজে ওঠে অন্তর জুড়ে এতগুলো বছর ধরে এই একই অনুভূতি আমার শুধু নয়, আপামর পুজোপ্রিয় মানুষের, উৎসবপ্রিয় মানুষের পুজোর সমান্তরাল অনুষঙ্গ উৎসব যদিও স্থান বিশেষে এবং জন বিশেষে এবার তারতম্য ঘটেছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জেরে এই পর্বটুকু আপাতত সরিয়ে রাখলে এবারের অর্থাৎ ২০২৪-এর পুজোর সেরা নায়িকা কিংবা খলনায়িকা যদি বাছতে হয় সে নিঃসন্দেহে এবং অবিসম্বাদিতভাবেই হচ্ছেতিথি এভাবে দেবদেবীকেও পিছনে ফেলে দিয়ে তিথির এই ট্র্যাজিক হিরোইন কিংবা খলনায়িকা হয়ে ওঠা একেবারেই অনভিপ্রেত যদিও ইতিহাসে তা বিরল নয় মোটেও প্রতিটি মানুষ এবং বিশেষ করে পূজার উদ্যোক্তা ও পুরোহিতমশাইদের বলতে গেলে তিথি এবার একেবারে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিয়েছে
পুজো থেকে উৎসবে নিজেকে জড়িয়ে নিতে অনেকেরই কষ্ট হয়েছে যদিও কিছু পারিবারিক, কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতার জেরে বেরোতে হয়েছে ঘর থেকে শামিল হতে হয়েছে এমন উৎসবপ্রিয় বহু মানুষের ভিড়ে মানুষ বেরিয়েছে পথে পথে, প্যান্ডেল হপিং-এ কিন্তু বুঝে উঠতে পারেনি এই হপিং সপ্তমী নাকি অষ্টমীর, অষ্টমী নাকি নবমীর এহ বিড়ম্বনা ! একটি পঞ্জিকার মতে এবার সপ্তমী পূজার সময়কাল ছিল এক ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট, অষ্টমী পূজার এক ঘণ্টা তেরো মিনিট এবং নবমী বিহিত পূজা ছিল শনিবার সেদিন তিথির স্থিরতা ছিল সাকুল্যে আট মিনিট আট মিনিটে দুর্গাপূজা ? এ তো এ-আই এর পক্ষেও অসম্ভব অগত্যা - সব খিচুড়ি এই মণ্ডপে অষ্টমীর পুজো চলছে তো ওই মণ্ডপে নবমীর অঞ্জলি চলছে দুপুরে খিচুড়ি খেতে বসেও তাই সবাই বলাবলি করছিল এ কি অষ্টমীর খিচুড়ি ? নাকি নবমীর ? কেউ একজন পাশে দাঁড়িয়ে ফোঁড়ন কাটল - যাই হোক খিচুড়ি কিন্তু খাসা হয়েছে, কীসের ফোঁড়ন
অনেকেই মায়ের পায়ে অঞ্জলি দিতে পারলেন না পারলেন তোঅষ্টম্যাং তিথৌবলার বহু আগেই এসে থিতু হয়েছে নবমী তিথি অনেক মহিলা মায়ের সিঁথিতে, পায়ে সিঁদুর পরাতে পারলেন না দশমীটা ঠিক কবে সেটাই কেউ বলতে পারছেন না নাকের জলে, চোখের জলে জয় মা বলতে গিয়ে মনে হলজয় তিথিবলাটাই এবার সংগত হবে এহ বাহ্য !
এতসব জ্বালা যন্ত্রণা কাটিয়ে যাঁরা ঘরে বসে সময় কাটাতে চাইলেন তাঁরাও স্বাভাবিক ভাবেই নিরাশ সামাজিক মাধ্যমে যেন অঘোষিত লক আউট চলছে কেউ অনলাইন নেই শপিং কিংবা হপিং-এ ব্যস্ত সবাই আশ্চর্য, পুজোর দুদিন পেরিয়ে গেলেও এই শপিং-এর যেন শেষ নেই অষ্টমী (অর্থাৎ নবমী)র সন্ধ্যায়ও কাপড়ের দোকানে সারি পেতে বসে খরিদ্দার তাঁরা কবে আর পরবেন পুজোর কাপড় কে জানে গলির মোড়ের টেইলরদাদা নবমীর সন্ধ্যায়ও মেশিন চালাচ্ছেন আর কাপড় ডেলিভারি দিচ্ছেন কবে যে পুজো দেখতে বেরোবেন তিনি কে জানে দৈনিক সংবাদপত্রের আগাপাশতলা পড়ে দিনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেন ফ্ল্যাটের সৌমেনকাকুদুদিন ধরে সে গুড়েও বালি। পুজোর ছুটিতে সংবাদপত্রের কর্মী, সম্পাদকরা। কানাঘুষোয় শোনা গেছে রাতের বেলা কাজের চাপে সম্পাদকদের ঘুম ঠিকঠাক হয় না বলে পুজোয় নাকি তাঁরা দিনরাত ঘুমিয়েই কাটান। এ তাঁদের কার্য-সূত্র অধিকার কিন্তু সৌমেনকাকুদের মতো পত্রিকাপোকাদের কথাও তো ভাবা উচি এ নিয়ে কর্মহীন কাকু সপ্তমী (নাকি অষ্টমী)র সন্ধ্যায় এক জবর পোস্ট দিয়েছিলেন ফেসবুকে অথচ চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোনো লাইক কমেন্ট নেই আশ্চর্য ! সবাই কি এখন ঘুমে কিংবা বাইরেই থাকে দিনরাত ? এই কটা দিন ? এদিকে তাঁর গিন্নি ঘন ঘন পুজো মণ্ডপে যাচ্ছেন আর নির্ঘণ্ট জেনে আসছেন অথচ নির্ঘণ্ট মেনে ফের মণ্ডপে গিয়ে জানতে পারেন নির্ঘণ্ট বদলে গেছে সিদ্ধান্ত পালটাচ্ছে মুহুর্মুহু তিথি আর পঞ্জিকার পাল্লায় সবাই নাস্তানাবুদ
তবে এসব কিছুই নয় পাড়ার হাবলুদার অবস্থা এসবের চাইতে বহুগুণ খারাপ পাড়ারই তিথি নামের ডাগর এবং কিছুটা ডাকসাইটে মেয়েটির সঙ্গে প্রেম চলছিল বহুদিন ধরে যদিও সরাসরিআমি তোমাকে ভালোবাসিকথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারছিল না হাবলুদা তিথি ইনিয়েবিনিয়ে বহুবার চেষ্টা করেছে কথাটা হাবলুদার মুখ দিয়ে বলানোর নিজের ঠোঁটে বসিয়ে রেখেছিল প্রত্যুত্তর - হাবলুদা বললেই ঝটিতি উগরে দেবে বলে সেদিন ফোনে কথা হয়েছিল, বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে নবমীর সন্ধ্যায় দুটিতে বেরোবে পুজো দেখার ছলে লুকিয়ে, আলাদা আলাদা ভাবে গত দুদিন ধরে আর কথা হয়নি তাই কার্যক্রম স্থিরই ছিল
বুকে বল সঞ্চয় করে হাবলুদা যথারীতি গায়ে নতুন কেনা বডি স্প্রে থেকে বেশ খানিকটা লাগিয়ে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল নির্ধারিত স্থানে এরপর কেটে গেছে প্রতীক্ষার বহু প্রহর হাবলুদার হৃদয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি, যাবতীয় ধুকপুকুনিকে নস্যাৎ করে আসেনি তিথি গভীর রাতে নিরাশায় নিমজ্জিত হাবলুদা ঘরে ফিরে আসার পথে পাড়ার স্বঘোষিত ছোটে সর্দারপুচকাহাবলুদার হাতেএই নাও তিথিদিদির চিঠিবলে ধরিয়ে দিল এক চিরকুট চিরকুট ছিনিয়ে নিয়ে খানিকটা আড়ালে গিয়ে হাবলুদা ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে দুরুদুরু বুকে চোখের সামনে মেলে ধরল - ‘কাল সারা সন্ধ্যা অপেক্ষা করেও তোমার দেখা না পেয়ে আমি ওপাড়ার মৃন্ময়দার সঙ্গে ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভীরু, কাপুরুষ তুমি আমার সঙ্গে আর কোন যোগাযোগা রাখবে না এই বলে দিলাম
মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে হাবলুদা আক্রোশে বলে উঠল মনে মনে - হতচ্ছাড়ি তিথি!! কেন এসেছিলি আমার জীবনে অতিথির মতো ? যা, যাচলে যাতোর চাইতে ওপাড়ার পূজাই ভালোতাকাইনি নেহাত তুই ছিলি বলে
হাবলুদার বেগতিক চেহারা দেখে গুটি গুটি পায়ে পিছনে পিছনে আসতে থাকা পুচকা এই মণ্ডপের বিখ্যাতনবমীর আরতিদেখবে বলে এক দৌড়ে পূজামণ্ডপে  গিয়ে শুনল ইতিমধ্যেই নাকি দশমীর শান্তিজল ছেঁটানোর পর্ব শেষ

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়