Skip to main content

ভাষার গরজে বিশেষ ‘ভাষা প্রণাম’ সংখ্যা ‘মনু থেকে ফেনী’


ত্রিপুরার দীর্ঘতম নদী হিসেবে পরিচিত মনু নদী যার অন্তপথ প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের একটি আঞ্চলিক নদী ফেনী যার উৎস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য - এই দুই নদীর নাম নিয়েই পত্রিকানামমনু থেকে ফেনী স্বভাবতই ভারত ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সাহিত্যচর্চাই এই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় যেহেতু রক্তাক্ত উনিশ ও একুশের প্রেক্ষাপটে এবং ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহিদের আত্মত্যাগের গরিমাগাথায় বাংলা ভাষার সাহিত্যক্ষেত্রটি ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে রয়েছে তাই পত্রিকায় দুই দেশের কবি লেখকের উপস্থিতি যতটা স্বাভাবিক ততটাই সংগত।
কবি, লেখক বিজন বোস যত্ন সহকারে সম্পাদনা করে আসছেন পত্রিকাটির। তাঁর ভাবনার প্রতিফলন এভাবে ফুটে উঠেছে সম্পাদকীয়তে - ‘...বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার, লালন করার এবং তাকে অন্তহীন শুভ পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে চলার দায়িত্ব নীতি-প্রণয়নকারীদের সঙ্গে লেখক ও সম্পাদকদেরও নিতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই ‘মনু থেকে ফেনী’র পঞ্চম সংখ্যার মতো ষষ্ঠ সংখ্যাও ‘ভাষা প্রণাম’ সংখ্যা।’ বাংলা ভাষাবিষয়ক চিন্তা-চর্চা কিংবা শহিদ-স্মরণ যে শুধু উনিশ আর একুশেই সীমাবদ্ধ নয় তারই রকটি নান্দনিক প্রকাশ এই সংখ্যা। পক্ষান্তরে এমনও বলা যায় যে প্রস্তাবিত ২১শে ফেব্রুয়ারি সংখ্যাটি নানা প্রতিবন্ধকতায় প্রকাশে বিলম্ব হলেও উৎস, উৎসাহ কিংবা উৎসর্গ থেকে সরে আসেননি সম্পাদক। বিলম্বিত হলেও তাই অকাট্য, অচ্ছেদ্য গরজ নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে ‘ভাষা প্রণাম’ সংখ্যা। 
৭৬ পৃষ্ঠার ছিমছাম সংখ্যাটিতে সন্নিবিষ্ট প্রতিটি লেখা যে অত্যন্ত সুচয়িত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। লিটল ম্যাগাজিনের দায়বদ্ধতা মেনে নিয়েও এমন পারিপাট্য নিঃসন্দেহে ধন্যবাদযোগ্য। চারটি সুস্পষ্ট বিভাগবিন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে সূচিপত্র। সেই সারণি ধরে এগোলে প্রথমেই থাকা প্রবন্ধ বিভাগের সাতটি প্রবন্ধের মধ্যে প্রথম প্রবন্ধ হল শুভজিৎ বোসের ‘বাঙালির প্রাপ্তি মাতৃভাষা দিবস, ভাষা অবমানিত হলে জাতি সবই হারায়’। শিরোনাম খানিকটা দীর্ঘ মনে হলেও নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে ভাষার বিলুপ্তির শঙ্কা থেকে তাকে বাঁচিয়ে রাখার ও প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে কিছু বাস্তবসম্মত পথ দেখিয়েছেন নিবন্ধকার। দ্বিতীয় নিবন্ধ ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান’। লেখক আমির হোসেন। অদূর ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বাংলার উপর উর্দুর আত্যাচার তথা শুধু রাষ্ট্র নয়, ভাষা বাংলার প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহ, ভালোবাসা, গরজ, অঙ্গীকার ও অবদান নিয়ে একটি বিস্তৃত, তথ্যবহুল এবং আবেদনময় রচনা। এর পরের নিবন্ধটি লিখেছেন জয়িতা ভট্টাচার্য। এটি ভাষা-বিষয়ক নয় তবে যথেষ্ট গবেষণাধর্মী একটি নিবন্ধ ‘মার্জার কাহিনী’। সমাজ, সাহিত্যে বেড়ালের উপস্থিতি নিয়ে একটি তথ্যবহুল ও সুভাষিত ‘সুস্বাদু’ পরিবেশন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ - লিখেছেন সিদ্ধার্থ সিংহ। সংক্ষিপ্ত বয়ানে তুলে ধরেছেন ভাষা শহিদ দিবসের তাৎপর্য যা বারবার পাঠযোগ্যজহর দেবনাথের নিবন্ধ ‘আমাদের মাতৃভাষার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’। এক দীর্ঘ যাত্রা, দীর্ঘ প্রতিবেদন। ভাষার উৎপত্তি থেকে ভবিষ্যতের চিন্তাকে সামলে নিয়ে এক উৎকৃষ্ট রচনা। উচ্চারিত হয়েছে সর্বনাশের প্রেক্ষিত ও সাবধানবাণী। নিবন্ধ ‘একুশের নেপথ্যে’। নিবন্ধকার মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম। ১৯৫২র ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যকে তথ্যাদির উল্লেখে প্রাঞ্জল করে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক। এই বিভাগের শেষ নিবন্ধটি লিখেছেন শিবজ্যোতি দত্ত। ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও বাংলা ভাষা আন্দোলনের অনন্যতা’। আলাদা আলাদা শিরোনামে বিশ্বব্যাপী কিছু ভাষা আন্দোলন তথা চলচ্চিত্র, সাহিত্য আদিতে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি বিষয়ক এক ব্যতিক্রমী নিবন্ধ। তবে এখানে আসামের ‘অসমিয়া’ ভাষা আন্দোলনকে উচ্চারণগত ভাবে ‘অহমিয়া’ বলে লেখা হয়েছে। এছাড়া অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের উপর আলোকপাত যথাযথ হয়নি। এই আন্দোলনে বা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় শুধু ‘অসন্তোষের সৃষ্টি হয়’নি। শহিদ হয়েছিলেন এগারোটি তাজা প্রাণ। এর উল্লেখ নেই নিবন্ধে। আবার হয়তো মুদ্রণ বিভ্রাটের ফলে এই গোটা পর্বকে আলাদা শিরোনাম না দিয়ে ‘স্পেনের কাতালোনিয়া’ শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
গল্প বিভাগে রয়েছে দুটি গল্প। প্রথমেই দেবাশ্রিতা চৌধুরীর ‘উত্তরাধিকার’ ভাষার প্রেক্ষাপটে এক অসাধারণ গল্প। এ জাতীয় বিষয় নিয়ে গল্প লেখা এক দুরূহ তথা আয়াসসাধ্য ব্যাপার। এই অনবদ্য গল্পটি বিদ্যায়তনিক পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে অনায়াসেপলাশ মজুমদারের ‘ছলনাজাল’ এক সার্থক ছোটগল্প। বাস্তবের ঘেরাটোপকে শেষ লাইনে গল্পে পর্যবসিত করেছেন নিদারুণ মুনশিয়ানায়।
কবিতা বিভাগে ‘অম্লমধুর’ কবিতা লিখেছেন একগুচ্ছ নামিদামি কবি। তবে মধুর তথা উৎকৃষ্ট কবিতার সংখ্যাই বেশি। যেসব কবির কবিতা আছে তাঁরা হলেন শান্তনু প্রধান, চিরশ্রী দেবনাথ, রনি অধিকারী, কৃষ্ণকুসুম পাল, মিলনকান্তি দত্ত, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, চৈতন্য ফকির, শিপ্রা রায়, কাজল চক্রবর্তী, শুভদীপ রায়, নৃপেন চক্রবর্তী, সৌহার্দ সিরাজ ও শ্যামলকান্তি দে।
শেষ বিভাগ - সাক্ষাৎকার। শিরোনাম ‘মাতৃভাষা আমাদের আত্মার অভয়ারণ্যে নির্ঘোষ নিক্কণ’। এখানে সম্পাদক বিজন বোস মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ড. তপন বাগচীর। নানা কথার ফাঁকে মান্য ভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সাক্ষাৎকারদাতা।
বেশ কিছু বানান ভুল রয়ে গেলেও ছাপা, অক্ষরবিন্যাস, অরুণকুমার দত্তের প্রচ্ছদ ও কাগজের মান যথাযথ। সব মিলিয়ে সীমিত আয়োজনে এক নান্দনিকতা ও গরজের সুস্পষ্ট ছাপ অনুভব করা গেছে পত্রিকাটির এই সংখ্যায়।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৬২২৯৯৯৬৫ 

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...