নীরব সাধনার কবি প্রাণজি বসাকের একটি ব্যতিক্রমী ধারার কাব্যগ্রন্থ ‘তারপর তাহার পর’। যতিচিহ্নবিহীন একক কবিতার এই গ্রন্থে আছে গ্রন্থনাম অনুযায়ী একটিই কবিতা। ভাবনা ও বোধের এক কাব্যিক প্রকাশ। ৬২ পৃষ্ঠার এই বইয়ের ৫৪ পৃষ্ঠা জুড়ে একটি কবিতার শরীরে যেন আপন এক জীবনবোধকে কবি উন্মোচিত করেছেন একান্ত আপন ভঙ্গিমায়। নিজের কাছে নিজেরই বয়ান করেছেন লিপিবদ্ধ - অসাধারণ, অনায়াসলব্ধ শব্দ ব্যঞ্জনায়। সবটুকু আবেশ আর অন্ধকার বর্তমানকে যেন এক ঘোর ছায়াবৃত্তে রেখেছেন মহাকালের আঙিনায়, দলিল করে - অমূল্য রতন করে -
...ছায়ারাও বেশ চেনে জানে বিশ্রাম গৃহ
সবুজ ছায়াপথ নদীনালা অরণ্যসমূহ
কে কার জন্য দাঁড়ায় খণ্ড বাসস্টপে
হাওয়াও কামড়ে দেয় প্রতীক্ষার গতরে
কাদামাটি ছেনে ছেনে তুমি গড়ালে জীবন
আমি ডুব মেরে তুলে আনি অমূল্য রতন...
অসংখ্য অনুষঙ্গ, অগুনতি আবহ এসেছে কবিতার যাত্রাপথে। অনুভব আর অনুভূতির নির্মোহ প্রয়োগ। শেষ প্রচ্ছদে প্রকাশকের কলমেও তারই বিস্তৃত বাখান -
‘প্রাণজির কবিতায় বেজে ওঠে দূরাগত কোনো ঘণ্টাধ্বনি, নিঃশব্দ বৃষ্টির ভেতরে বিশ্রামের ওম, ক্ষণজন্মা বিদ্যুতের ভাঁজে দেখা যায় আশঙ্কার যৌথস্বরলিপি - অক্ষর। এ তাঁকে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। জীবনভর ছুটিয়ে মারে। প্রাণজিও ছুটছেন। দীর্ঘ যাত্রার ঢেউয়ে দুলতে দুলতে প্রাণজি ছড়িয়ে যাচ্ছেন দূর থেকে আরও প্রলম্বিত দূরে। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে পাঠকের কেবলই মনে হতে থাকে তারপর তাহার পর কতদূর। শেষহীনতার আর্তি তাঁর প্রতিটি শব্দপুঞ্জকে পথ করে তুলেছে। এই কাব্যগ্রন্থটি তাঁর বাইশতম আয়োজন। এটি তাঁর কবিজীবনের আরেকটি দীঘল বাঁক। দীর্ঘ কবিতায় একজন কবি নিজেকে তন্নতন্ন করে খোঁজেন। ক্ষতবিক্ষত করেন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। প্রাণজিও এই দীর্ঘ যাত্রাটিতে নানা কৌণিক অবস্থান থেকে নিজেকেই দেখেছেন। পাঠক লক্ষ করবেন, নিজেকে দেখতে দেখতে একজন কবি নিজেই পাঠক হয়ে ওঠেন। পাঠকের প্রতিনিধি হয়ে নিজেই যেন বিস্ময় বোধ করেন, তারপর তাহার পর।’
প্রকাশকের তরফে এমন গভীর পর্যবেক্ষণ আজকাল খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ত্রিপুরা, ধর্মনগরের এই প্রকাশক - ‘সাতদিন’ ব্যতিক্রমী। আলোচ্য গ্রন্থের অন্তর্গত কিছু পঙ্ক্তি এতটাই শক্তিশালী যে ইচ্ছে হয় পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে দেওয়া হোক আলোচনায়। কিন্তু সে হবার নয়। তবু কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করার লোভ সামলানো যায় না -
তাহার পর...
লেবুজলে হালকা নুন
তাতে মেটে দিঘির পিপাসা
গভীরে তার বুদ্ধ পূর্ণিমার গোটা চাঁদ ডুবে
পাখিদের কোলাহল থেমে গেলে
মুখ ধুয়ে নেয় সুশীল সমাজের উচ্চবর্গ
নতুন গানের আবহে হাঁটছে বৈশাখ...
কিংবা -
সূর্যনগরীর গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উঠেছে দিবাকর/ পথে ঘাটে/ মাঠে মাঠে/ আকাশে আকাশে/ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ছোঁয়া ক্যাম্পাসে/ এবং প্রাচীন মরীচিকাময় বিজ্ঞ চাতালে/ আকাশের কোনো এক কোণে কোথায়ও/ চাঁদটা নেই.../ সেই কবে মরে গেছে ভোরে/ আর আমার জুতসই কলমে ছুটে আসে/ বাঙ্ময় কবিতারা.../ লাইনে লাইনে দাঁড়ায় তারা/ আর যাব না কোথাও/ কোনোখানে কোন পথে/ কথা দিলাম তোমাকে.../ ওহে মুরব্বী বাতাস/ আমার উচ্চারণ জড়িয়ে এসেছে এখন...।
স্পষ্ট ছাপা, গুণমানসম্পন্ন কাগজ, যথাযথ অক্ষর/শব্দ বিন্যাসে বিন্যস্ত গ্রন্থটিতে শুদ্ধ বানানের প্রয়োগ এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। অনবধানতায় হয়তো বা দু’একটি যতিচিহ্ন বসেছে। ভূমিকাহীন এই পেপারব্যাক গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন ‘অনুবাদক ও কবি, বাণী চক্রবর্তী, ভিলাই’কে। সব মিলিয়ে এক ঘোরলাগা পাঠের কাব্যগ্রন্থ ‘তারপর তাহার পর’।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৩১৫৩২৪৮০
Comments
Post a Comment