ব্যাসদেব কর্তৃক মহাভারত রচনার
পরবর্তীতে নানা ভাষায় এর অনুবাদ এবং সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে শহর থেকে গ্রামে লোকের
মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ার বহু উদাহরণ আমরা দেখে এবং শুনে আসছি বহু দিন থেকেই। আলোচ্য গ্রন্থটির
প্রণেতা সিলেটের বিধুভূষণ ভট্টাচার্য যিনি পেশায় একজন আয়কর আইনজীবী এবং একাধারে
সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক একজন লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক
লেখক।
মোট ৩২২ লাইনের মিশ্র ছন্দে (ছড়ার ছন্দে) লিখা এই মহাভারত আখ্যান সম্বন্ধে গ্রন্থের শ্রীগণেশেই সন্নিবিষ্ট হয়েছে দুটি মূল্যবান ভূমিকা। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাসকে যাঁর অনুপ্রেরণায় এই গ্রন্থ প্রণয়ন এবং যিনি একাধারে একজন বিশিষ্ট লেখকও। প্রথমেই ছয় পৃষ্ঠার ‘কথামুখ’-এ শ্রী দাস লিখছেন - ‘শ্রীযুক্ত বিধুভূষণ ভট্টাচার্য সিলেটি ভাষায় ছড়ার আঙ্গিকে অতি সংক্ষেপে মহাভারত লিখেছেন। এক লক্ষ শ্লোকের বিশাল আয়তন গ্রন্থকে এত ছোট আকারে উপস্থাপনা করা খুবই দুরূহ কাজ। তিনি সেই দুর্গম পথের যাত্রী হয়েছেন।’ কয়েকটি ভাগে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এই ‘কথামুখ’। রয়েছে ব্যাসদেবের মহাভারত, মহাভারতের রচনাকাল, বাংলায় মহাভারত চর্চা, সিলেটে মহাভারত চর্চা, বিধুভূষণের মহাভারত, মহাভারতের কিছু তথ্য, তথ্যকথা, মহাভারতের মহাফল, এবং মহাভারত অশেষ। তাঁর এই কথামুখ থেকে জানা যায় যে এই গ্রন্থটির লক্ষ্য ছোটরা। সেই হিসেবে প্রয়োজনীয় তথ্যাদির সূত্রে গ্রন্থপাঠে আগ্রহী হবেন পাঠকরা।
‘লেখকের কথা’য় গ্রন্থকার তাঁর ১২ পৃষ্ঠার ভূমিকায় প্রাসঙ্গিক বহু কথাই লিখেছেন। বস্তুত এই দু’টি ভূমিকা পাঠে সাধারণ পাঠক মহাভারতের বিশালত্ব সম্বন্ধে অনেকটাই ওয়াকিবহাল হতে পারবেন। শ্রী ভট্টাচার্য লিখছেন - ‘সিলেটি মহাভারতে সাহিত্যমানের ছন্দশাসন মানা সম্ভব হয়নি...... আমি আমাদের গ্রামবাংলার স্বভাবকবিদের আদি অকৃত্রিম কথনশৈলীকে ভালোবেসে তাঁদের মতো করে মহাভারতের কাহিনি বলতে পছন্দ করেছি।’ তাঁর এই মূল্যবান ভূমিকায়ও আছে কয়েকটি ভাগ - যেমন, মহাভারতে গীতা, আমার গীতা ভাবনা, সিলেটি ভাষা, মান সিলেটি মান ভাষা, কৈফিয়ত এবং দায়মুক্তি। স্বভাবতই এই ভূমিকার মাধ্যমেও পাঠকের দরবারে পৌঁছে যাবে বহু কথা, বহু তথ্য, বহু অজানা গল্পগাথা। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য যে ভূমিকায় লেখক ‘সিলেটি’ লিখলেও গ্রন্থনামে কিন্তু ‘সিলটি’ আছে।
মূল রচনার শ্রীগণেশ হয়েছে এভাবে -
মহাকবি ব্যাসদেব
কবিকুলর তিলক
তাইন রচিছইন
ষাইট লক্ষ শিলক।
কাশীরাম দাসের মহাভারতে যেমন আছে ভণিতা - মহাভারতের কথা অমৃত সমান/ কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান, ঠিক এভাবেই বিধুভূষণ লিখছেন -
মহাভারত কথার প্যাচ
জ্যামিতির লাখান
বিধুভূষণ ভটে কইরাম
সিলেটি বাখান।
সিলেটি ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার আঞ্চলিকতা গুণ, ভাষার বৈচিত্র্য ও রসবোধ। সুতরাং সিলটি মহাভারতে রসবোধের নিদর্শন থাকবে না তা হয় না। আলোচ্য সিলটি মহাভারতেও তাই রয়েছে একাধিক রসাত্মক ব্যাখ্যা। মোবাইল ফোন যেখানে দিনের অধিকাংশ সময় নিয়ে নিচ্ছে ছোটদের থেকে সেখানে মহাভারত পড়ার তাগিদ আসবে কী করে ? গ্রন্থের রচনাকার তাই লিখছেন - মহাভারতর কিচ্ছা/ হুনতে হইলে ইচ্ছা/ কামকাজ থও/ মুবাইল বন করি/ আমার গালা লইয়া বও। (গালা - নিকট)। কঠিন সিলেটি শব্দের পাদটীকাও দেওয়া হয়েছে পৃষ্ঠাশেষে। রসাত্মক আরোও কিছু পঙ্কতির উল্লেখ করা যেতে পারে এই পরিসরে -
শান্তনু নামেতে রাজা/ কুরুবংশের তেরা (তারা)/ যার কারণে অতো ভেজাল/ হক্কল বেরাচেরা ......। গঙ্গা দর্শনে শান্তনুর অবস্থা - ছুটি যার গি মুখর আগল/ বেটা আস্তা ছাগল/ মৎস্যগন্ধা কন্যার রূপে/ অইগেছে গি পাগল। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর ব্যাপারে - বিচিত্রর বড়পুত/ ধৃতরাষ্ট্র আন্ধা (অন্ধ)/ হুরুটা গান্ধা। বাপ মইলে রাজা অইলা/ দুই নম্বর পাণ্ডু/ আস্তা একটা গাণ্ডু। মহাভারতের যুদ্ধশুরুর বর্ণনা - জান থাকতে দিতা নায়/ ফুচির (সূচের) আগা মাটি/ কইল, নেউক যুদ্ধ করি/ মোর মুণ্ডু কাটি। কূটবুদ্ধির বিশারদ/ কৃষ্ণ গিয়াও ফেইল/ তারিখ পড়ল শুরু হইল/ মহাযুদ্ধর খেইল। যুদ্ধে স্বজনদের দেখে অর্জুনের বিব্রতবোধের কথা - গোষ্ঠীগাড়া কুটুম-খেশ/ বান্ধব আর স্বজন/ ভাই বেরাদর সহ/ বহুত গুণীজন/ বিপক্ষে হইছইন খাড়া/ করতা করি রণ/ দেখিয়া অর্জুনর মাথা/ ঘুরায় বনবন। ... শরীল আমার কাঁপের রে ভাই/ জ্বলি যারগি চামড়া/ গণগোষ্ঠী মারিয়া করতাম/ রাজাদি কুন আমড়া। ভূমিকায় গীতা সম্বন্ধে যেখানে অনেক কথাই লিখেছেন গ্রন্থকার সেখানে মূল অংশে ‘গীতা’র শ্লোকের সারমর্ম উল্লেখ থাকলেও ‘গীতা’ সম্পর্কিত অর্থাৎ ‘গীতা’ শব্দের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। শেষে গ্রন্থকার লিখছেন - সংক্ষেপেতে সার কথা খান/ কইয়া গেলাম খালি/ হকলে মিলি আমার লাগি/ দেউকা জোরে তালি। উপসংহারে চার স্তবকের মাহাত্ম্যও বর্ণিত হয়েছে।
গোটা আখ্যানে বেশ ক’টি সিলেটি
শব্দ আছে যা কিছু বিশেষ কিংবা সাধারণ্যের অশ্রুত হয়েও থাকতে পারে। কয়েকটির উল্লেখ
অপ্রাসঙ্গিক হবে না - গালা (নিকট), গুইয়া (গুপ্তচর), লায় (ধীরে), হেষর (শেষের),
উরো (কোলে), দঢ়া (দৃঢ়), লুয়া (লোহা), আক্কা (তাক), আপাঞ্জাল (উটকো ঝামেলা), যেবলা
(যখন), লেপ্টাগালা (ধপাস করে ভূমিতে বসা), কুদাম (ধমক), উফরা (অবশিষ্ট), হরাদ
(শ্রাদ্ধ), একজরি (একটুখানি), তুকাইয়া (খুঁজিয়া) ইত্যাদি।
পরিশিষ্টে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু সচিত্র তথাবলির উল্লেখ গ্রন্থের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুলাংশে। বহু অজানা ততথ্যাদি সম্বলিত এই অংশে আছে ষোড়শ মহাজনপদের মানচিত্র, চন্দ্রবংশ পরিচয় এবং মহাভারতের অধ্যায়, পর্ব ও উপপর্বের সারণী। দুই ব্লার্বে রয়েছে গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। শেষ প্রচ্ছদে প্রকাশকের কথা।
ঘোষ-মহাপ্রাণ ধ্বনি উচ্চারণে সিলেটিদের অনাগ্রহের ফলে ‘হ’ প্রায়শ ‘অ’-এর মতোই (প্রায়) উচ্চারিত হয়। এক্ষেত্রে লিখিত আকারে লিখার সময় হ-এর জায়গায় অ-ব্যবহার করা যায় কিনা এ এক প্রশ্ন এসে সামনে দাঁড়ায়। আলোচ্য গ্রন্থেও এমন এক বিড়ম্বনা লক্ষ করা যায়। তাই সম্ভবত অধিকতর ক্ষেত্রে যেমন হয় সেভাবেই গ্রন্থকার উভয় বিকল্পই ব্যবহার করেছেন। উচ্চারণের দায় তাই সংশ্লিষ্ট পাঠকের উপরেই বর্তায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পঙক্তির মধ্যে বিকল্প শব্দের প্রয়োগও বাঞ্ছনীয় মনে হতে পারে। যেমন - ‘যার কারণে অতো ভেজাল’-এর জায়গায় ‘যার লাগি অত ভেজাল’ও হতে পারে বলে মনে হয়। তবে এমন ধারণা করার ক্ষেত্র নিতান্তই কম। অন্যথায় অত্যন্ত সুচিন্তিত শব্দাবলি ও পঙক্তি ও স্তবকের সমাহার এই মহাভারত কাহিনি। পরবর্তীতে হয়তো পাঠকের কথা ভেবে জনপ্রিয় পয়ার ছন্দে পুরোটা লিখার চিন্তাও আসতে পারে কারণ ধারাবাহিক পড়ার সময় ছন্দ পরিবর্তনে সামান্য হলেও হোঁচট খায় পাঠক মন।
সিলেটিতেও আজ অবধি বহু সংক্ষিপ্ত মহাভারত লিখা রয়েছে। কিছু উল্লেখ ভূমিকাতেও রয়েছে। কিছু এর বাইরেও থেকে গেছে। যা অতি স্বাভাবিক। সবার সব কাজ সব দেশে জনসমক্ষে আসে না। বিধুভূষণ ভট্টাচার্যের এই মহাভারতও নিশ্চিতভাবেই তার মধ্যে দখল করে আছে এক বিশিষ্ট স্থান। সুতরাং ‘জোরে হাততালি’ দেওয়াই যায়। গ্রন্থের ছাপা, বাঁধাই, বর্ণ সংস্থাপন, অলংকরণ যথাযথ। আম্বরখানা, সিলেটের জসিম বুক হাউজ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত এই গ্রন্থের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ এঁকেছেন বিমান তালুকদার।
মোট ৩২২ লাইনের মিশ্র ছন্দে (ছড়ার ছন্দে) লিখা এই মহাভারত আখ্যান সম্বন্ধে গ্রন্থের শ্রীগণেশেই সন্নিবিষ্ট হয়েছে দুটি মূল্যবান ভূমিকা। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাসকে যাঁর অনুপ্রেরণায় এই গ্রন্থ প্রণয়ন এবং যিনি একাধারে একজন বিশিষ্ট লেখকও। প্রথমেই ছয় পৃষ্ঠার ‘কথামুখ’-এ শ্রী দাস লিখছেন - ‘শ্রীযুক্ত বিধুভূষণ ভট্টাচার্য সিলেটি ভাষায় ছড়ার আঙ্গিকে অতি সংক্ষেপে মহাভারত লিখেছেন। এক লক্ষ শ্লোকের বিশাল আয়তন গ্রন্থকে এত ছোট আকারে উপস্থাপনা করা খুবই দুরূহ কাজ। তিনি সেই দুর্গম পথের যাত্রী হয়েছেন।’ কয়েকটি ভাগে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন এই ‘কথামুখ’। রয়েছে ব্যাসদেবের মহাভারত, মহাভারতের রচনাকাল, বাংলায় মহাভারত চর্চা, সিলেটে মহাভারত চর্চা, বিধুভূষণের মহাভারত, মহাভারতের কিছু তথ্য, তথ্যকথা, মহাভারতের মহাফল, এবং মহাভারত অশেষ। তাঁর এই কথামুখ থেকে জানা যায় যে এই গ্রন্থটির লক্ষ্য ছোটরা। সেই হিসেবে প্রয়োজনীয় তথ্যাদির সূত্রে গ্রন্থপাঠে আগ্রহী হবেন পাঠকরা।
‘লেখকের কথা’য় গ্রন্থকার তাঁর ১২ পৃষ্ঠার ভূমিকায় প্রাসঙ্গিক বহু কথাই লিখেছেন। বস্তুত এই দু’টি ভূমিকা পাঠে সাধারণ পাঠক মহাভারতের বিশালত্ব সম্বন্ধে অনেকটাই ওয়াকিবহাল হতে পারবেন। শ্রী ভট্টাচার্য লিখছেন - ‘সিলেটি মহাভারতে সাহিত্যমানের ছন্দশাসন মানা সম্ভব হয়নি...... আমি আমাদের গ্রামবাংলার স্বভাবকবিদের আদি অকৃত্রিম কথনশৈলীকে ভালোবেসে তাঁদের মতো করে মহাভারতের কাহিনি বলতে পছন্দ করেছি।’ তাঁর এই মূল্যবান ভূমিকায়ও আছে কয়েকটি ভাগ - যেমন, মহাভারতে গীতা, আমার গীতা ভাবনা, সিলেটি ভাষা, মান সিলেটি মান ভাষা, কৈফিয়ত এবং দায়মুক্তি। স্বভাবতই এই ভূমিকার মাধ্যমেও পাঠকের দরবারে পৌঁছে যাবে বহু কথা, বহু তথ্য, বহু অজানা গল্পগাথা। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য যে ভূমিকায় লেখক ‘সিলেটি’ লিখলেও গ্রন্থনামে কিন্তু ‘সিলটি’ আছে।
মূল রচনার শ্রীগণেশ হয়েছে এভাবে -
মহাকবি ব্যাসদেব
কবিকুলর তিলক
তাইন রচিছইন
ষাইট লক্ষ শিলক।
কাশীরাম দাসের মহাভারতে যেমন আছে ভণিতা - মহাভারতের কথা অমৃত সমান/ কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান, ঠিক এভাবেই বিধুভূষণ লিখছেন -
মহাভারত কথার প্যাচ
জ্যামিতির লাখান
বিধুভূষণ ভটে কইরাম
সিলেটি বাখান।
সিলেটি ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার আঞ্চলিকতা গুণ, ভাষার বৈচিত্র্য ও রসবোধ। সুতরাং সিলটি মহাভারতে রসবোধের নিদর্শন থাকবে না তা হয় না। আলোচ্য সিলটি মহাভারতেও তাই রয়েছে একাধিক রসাত্মক ব্যাখ্যা। মোবাইল ফোন যেখানে দিনের অধিকাংশ সময় নিয়ে নিচ্ছে ছোটদের থেকে সেখানে মহাভারত পড়ার তাগিদ আসবে কী করে ? গ্রন্থের রচনাকার তাই লিখছেন - মহাভারতর কিচ্ছা/ হুনতে হইলে ইচ্ছা/ কামকাজ থও/ মুবাইল বন করি/ আমার গালা লইয়া বও। (গালা - নিকট)। কঠিন সিলেটি শব্দের পাদটীকাও দেওয়া হয়েছে পৃষ্ঠাশেষে। রসাত্মক আরোও কিছু পঙ্কতির উল্লেখ করা যেতে পারে এই পরিসরে -
শান্তনু নামেতে রাজা/ কুরুবংশের তেরা (তারা)/ যার কারণে অতো ভেজাল/ হক্কল বেরাচেরা ......। গঙ্গা দর্শনে শান্তনুর অবস্থা - ছুটি যার গি মুখর আগল/ বেটা আস্তা ছাগল/ মৎস্যগন্ধা কন্যার রূপে/ অইগেছে গি পাগল। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর ব্যাপারে - বিচিত্রর বড়পুত/ ধৃতরাষ্ট্র আন্ধা (অন্ধ)/ হুরুটা গান্ধা। বাপ মইলে রাজা অইলা/ দুই নম্বর পাণ্ডু/ আস্তা একটা গাণ্ডু। মহাভারতের যুদ্ধশুরুর বর্ণনা - জান থাকতে দিতা নায়/ ফুচির (সূচের) আগা মাটি/ কইল, নেউক যুদ্ধ করি/ মোর মুণ্ডু কাটি। কূটবুদ্ধির বিশারদ/ কৃষ্ণ গিয়াও ফেইল/ তারিখ পড়ল শুরু হইল/ মহাযুদ্ধর খেইল। যুদ্ধে স্বজনদের দেখে অর্জুনের বিব্রতবোধের কথা - গোষ্ঠীগাড়া কুটুম-খেশ/ বান্ধব আর স্বজন/ ভাই বেরাদর সহ/ বহুত গুণীজন/ বিপক্ষে হইছইন খাড়া/ করতা করি রণ/ দেখিয়া অর্জুনর মাথা/ ঘুরায় বনবন। ... শরীল আমার কাঁপের রে ভাই/ জ্বলি যারগি চামড়া/ গণগোষ্ঠী মারিয়া করতাম/ রাজাদি কুন আমড়া। ভূমিকায় গীতা সম্বন্ধে যেখানে অনেক কথাই লিখেছেন গ্রন্থকার সেখানে মূল অংশে ‘গীতা’র শ্লোকের সারমর্ম উল্লেখ থাকলেও ‘গীতা’ সম্পর্কিত অর্থাৎ ‘গীতা’ শব্দের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। শেষে গ্রন্থকার লিখছেন - সংক্ষেপেতে সার কথা খান/ কইয়া গেলাম খালি/ হকলে মিলি আমার লাগি/ দেউকা জোরে তালি। উপসংহারে চার স্তবকের মাহাত্ম্যও বর্ণিত হয়েছে।
পরিশিষ্টে অত্যন্ত মূল্যবান কিছু সচিত্র তথাবলির উল্লেখ গ্রন্থের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুলাংশে। বহু অজানা ততথ্যাদি সম্বলিত এই অংশে আছে ষোড়শ মহাজনপদের মানচিত্র, চন্দ্রবংশ পরিচয় এবং মহাভারতের অধ্যায়, পর্ব ও উপপর্বের সারণী। দুই ব্লার্বে রয়েছে গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। শেষ প্রচ্ছদে প্রকাশকের কথা।
ঘোষ-মহাপ্রাণ ধ্বনি উচ্চারণে সিলেটিদের অনাগ্রহের ফলে ‘হ’ প্রায়শ ‘অ’-এর মতোই (প্রায়) উচ্চারিত হয়। এক্ষেত্রে লিখিত আকারে লিখার সময় হ-এর জায়গায় অ-ব্যবহার করা যায় কিনা এ এক প্রশ্ন এসে সামনে দাঁড়ায়। আলোচ্য গ্রন্থেও এমন এক বিড়ম্বনা লক্ষ করা যায়। তাই সম্ভবত অধিকতর ক্ষেত্রে যেমন হয় সেভাবেই গ্রন্থকার উভয় বিকল্পই ব্যবহার করেছেন। উচ্চারণের দায় তাই সংশ্লিষ্ট পাঠকের উপরেই বর্তায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পঙক্তির মধ্যে বিকল্প শব্দের প্রয়োগও বাঞ্ছনীয় মনে হতে পারে। যেমন - ‘যার কারণে অতো ভেজাল’-এর জায়গায় ‘যার লাগি অত ভেজাল’ও হতে পারে বলে মনে হয়। তবে এমন ধারণা করার ক্ষেত্র নিতান্তই কম। অন্যথায় অত্যন্ত সুচিন্তিত শব্দাবলি ও পঙক্তি ও স্তবকের সমাহার এই মহাভারত কাহিনি। পরবর্তীতে হয়তো পাঠকের কথা ভেবে জনপ্রিয় পয়ার ছন্দে পুরোটা লিখার চিন্তাও আসতে পারে কারণ ধারাবাহিক পড়ার সময় ছন্দ পরিবর্তনে সামান্য হলেও হোঁচট খায় পাঠক মন।
সিলেটিতেও আজ অবধি বহু সংক্ষিপ্ত মহাভারত লিখা রয়েছে। কিছু উল্লেখ ভূমিকাতেও রয়েছে। কিছু এর বাইরেও থেকে গেছে। যা অতি স্বাভাবিক। সবার সব কাজ সব দেশে জনসমক্ষে আসে না। বিধুভূষণ ভট্টাচার্যের এই মহাভারতও নিশ্চিতভাবেই তার মধ্যে দখল করে আছে এক বিশিষ্ট স্থান। সুতরাং ‘জোরে হাততালি’ দেওয়াই যায়। গ্রন্থের ছাপা, বাঁধাই, বর্ণ সংস্থাপন, অলংকরণ যথাযথ। আম্বরখানা, সিলেটের জসিম বুক হাউজ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত এই গ্রন্থের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ এঁকেছেন বিমান তালুকদার।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ১৫০/- (বাংলাদেশ)
যোগাযোগ - ০১৭৩৪৯২১১৩৫
যোগাযোগ - ০১৭৩৪৯২১১৩৫
Comments
Post a Comment