Skip to main content

ভ্যাকসিন

বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে উদ্বাস্তুর শহর রামকৃষ্ণ নগরে কিরণকাকু ছিলেন এক মূর্তিমান বিভীষিকা। হালকা নীল রঙের শার্ট আর প্রায় বুক অবধি ওঠানো লং প্যান্ট। দীর্ঘদেহী সুঠাম গড়ন।তাঁকে দেখলেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠতো। গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। তাঁর আসার কারণটা না জানা অবধি বুকের ভেতর একটা হাতুড়ি পেটার শব্দ বেজে যেত এক নাগাড়ে। নজর থাকতো তাঁর হাতের ছোট্ট ব্যাগটির দিকে। যত গণ্ডগোল ওতেই।ওটি না খোলা অবধি সব ঠিকঠাক। ব্যাগটি খোলার জো যা করলেই চমকে উঠতো পিলে।
###
নিজের বাঁ হাতের বাহুমূলে গোলাকার দু'টি দাগ দেখে আসছি - বুঝতে শিখেছি যবে থেকে। বড়দের কাছ থেকে পরবর্তীতে জানতে পেরেছি এগুলো বসন্তের টিকার দাগ। চারপাশের লোকজন সবার হাতেই এই দাগ। মানুষের হাতের এই দাগটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ালো চোখে। এই দাগহীন হাত যেন কেমন বিসদৃশ লাগে।
বসন্ত রোগের বিভীষিকায় এক সময় প্রচুর প্রাণহানি ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত এই টিকার আবিষ্কারে জীবন রক্ষা হয়েছে লক্ষ লক্ষ লোকের।
এর পর এলো কলেরা। সে কী মড়ক। শুনেছি গ্রামের পর গ্রাম সাফ্ হয়ে গেছে। মড়া পোড়ানোর মতো জায়গা ছিল না। কী ভয়াবহ অবস্থা। ভাবলেও শিউরে ওঠে গা। শেষ পর্যন্ত তারও বেরোলো প্রতিষেধক ইনজেকশন।
###
স্কুলে বসে আছি। পাঠদান চলছে। হঠাৎ চারদিকে একটা ফিসফিস গুঞ্জন। চাপা গুঞ্জন অনতিবিলম্বে জোরদার কথাবার্তায় পর্যবসিত হলো। মাস্টারমশাই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যেতেই জানালা দিয়ে টপটপ করে পালাতে শুরু করলো ছাত্ররা। ব্যাপার কী ? খবর নিয়ে জানা গেল কিরণ কাকুর প্রবেশ ঘটেছে স্কুলে। তাঁকে দেখতে পেয়েই আদ্দেকের উপর ছেলেরা পগার পার। জানা গেল আজ স্কুলের ছাত্রদের কলেরার ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে। এ খবর শোনার পর বাকি থাকা ছাত্রদেরও আদ্দেক গেল পালিয়ে। হাতে গোণা কয়েকটি ছাত্রের মধ্যে আমিও পড়ে রইলাম বলির পাঁঠা হয়ে। জানতাম এই ইঞ্জেকশনের পর হাত ফুলে ঢোল হবে। জ্বর আসবে প্রচণ্ড। তথাপি নিজেই ভেবেচিন্তে দেখলাম কলেরায় মৃত্যুর চাইতে একটা ইঞ্জেকশনের ব্যথা শতগুণ ভালো। যথারীতি কিরণ কাকু এলেন আর ভয়ে প্রায় মৃতপ্রায় আমার হাতটিকে বিদ্ধ করে আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন কলেরার হাত থেকে। শেষ মুহূর্তে একবার পালানোর চিন্তা মাথায় এলেও সে সুযোগ আর ছিল না। একবার আড়গড়ায় মাথা গলিয়ে দিলে আর বলির হাত থেকে বাঁচা যায় না।
যথারীতি পরের দু'দিন প্রচণ্ড জ্বরে আর ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া হাতের ব্যথায় কেটেছে প্রায় বেঘোরে। তবে একটাই স্বস্তি যে দু' চার দিন স্কুল কামাই হলেও কেউ কিছু বলবে না। মমতাময়ী মায়ের নিরবচ্ছিন্ন পরিচর্যায় সেরে উঠলাম দু'দিনেই।
###
আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাহুমূলে কোনও গোলাকার দাগ নেই। আশা করবো অতিমারী করোনার আগত টিকা দাগহীন এবং ব্যথাহীন হবে। আশা করবো আর কোনও নতুন মহামারী যেন না আসে ওদের জীবনে।

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...