Skip to main content

অমৃতলোকে দেবাশিস দত্ত











‘রবীন্দ্রনাটকে মৃত্যু’ নিয়ে সুগভীর অধ্যয়নসঞ্জাত গ্রন্থ প্রকাশের এক বছরের মধ্যেই বিচিত্র সেই মৃত্যুলোকে পাড়ি জমালেন উত্তর পূর্বের গর্বিত তথা ব্যতিক্রমী সাহিত্য ব্যক্তিত্ব দেবাশিস দত্ত। উপজাতি অধ্যুষিত নাগাল্যাণ্ড রাজ্যে বসবাস করে পাহাড়সম প্রতিকুলতাকে সামলে নিরলস সাহিত্যদেবায় ব্রতী এই সাহিত্যিকের মৃত্যু স্বভাবতই সৃষ্টি করে গেল এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলা ভাষার ব্রাত্য এই অঞ্চলে কিছু মননশীল পথের সাথীকে নিয়ে তিনি সাহিত্যের মরুদ্যানে ফুল ফোটানোর যে কাজটি করে গেছেন আজীবন তা কোনও অংশেই এক আন্দোলনের চাইতে কম কিছু নয়। এক অন্তহীন সংগ্রামের পথেই অন্ত হয়ে গেলেন মহাশূন্যে।

৭৮ বছর বয়সে নিজেকে সাহিত্যসেবায় নিয়োজিত করে রেখেই রোগের কাছে হার মানতে হলো এই বর্ষীয়ান সাহিত্যিককে। তীরে এসে তরী ডোবার মতোই তাঁর অন্তরের ধন - সাহিত্য পত্রিকা ‘পূর্বাদ্রি’র শেষ সংখ্যাটি দেখে যেতে পারলেন না। এক বলিষ্ঠ প্রত্যয় ও দায়বদ্ধতা নিয়ে ১ অক্টোবর ২০০৩ ডিমাপুর থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘পূর্বাদ্রি’। নববর্ষ ও শারদ সংখ্যা রূপে ‘পূর্বাদ্রি’ গত বছর প্রায় পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য কোনও প্রান্তিকতায় আবদ্ধ হতে পারে না - এ প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন ‘পূর্বাদ্রি’র সম্পাদক দেবাশিস দত্ত। পূর্বাদ্রির যাত্রা প্রায় একক শক্তির উপর নির্ভর করে শুরু হয়েছিল। পরবর্তী কালে ‘পূর্বাদ্রি’র সাথে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন এবং বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করছেন। ‘পূর্বাদ্রি’ নাগাল্যাণ্ডে বাংলা পত্রিকা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বিরাট ভূমিকা পালন করছে - সে কথা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা চলে। ডিমাপুরে সাহিত্য পরিমণ্ডল প্রায় শূন্যস্তরে ছিল। ‘পূর্বাদ্রি’ সেই স্তরকে সচল করেছে।

২০০৬ গুয়াহাটি লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলন থেকেই পূর্বাদ্রির সাথে বহির্ডিমাপুরের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। এর পর থেকে সাহিত্যের এই ভুবনে দেবাশিস দত্ত এবং ‘পূর্বাদ্রি’ এক অপরিহার্য অঙ্গ।

লেখালেখির শুরু তাঁর কৈশোর বেলা থেকেই। সাহিত্যিক দেবাশিস দত্তের জন্ম অবিভক্ত ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশের) শ্রীহট্ট জেলার মোলভীবাজারের অন্তর্গত ভানুগাছ (কমলগঞ্জ) রেলওয়ে স্টেশনের অদূরবর্তী পাত্রখোলা চা বাগানে১৯৪৩ সনের ১লা এপ্রিল বাবা প্রয়াত রামকুমার দত্ত, মা প্রয়াতা সুপ্রভা দত্ত তাঁর ভাষায় – “শৈশব কেটেছে সবুজ ঘেরা চা গাছ আর শিরীষ, ধলাই নদীর নির্জনতাকে বুকে ধরে ব্যতিক্রমী একটা উন্নতমানের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের পরিবেশ ছিল পাত্রখোলা চা বাগানে

বিদ্যালয় শিক্ষা বাংলাদেশের আদমপুর এম ই স্কুল, করিমগঞ্জের নিলামবাজার স্বামী বিরজানন্দ হাইস্কুল ও উধারবন্দের দুর্গানগর হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুলে এরপর শিলচর গুরুচরণ কলেজ থেকে বাংলায় সাম্মানিক সহ স্নাতক এবং গৌহাটি বিস্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীলাভ পড়াশোনার পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবেই চলেছিল তার সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্য আরাধনা

শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৯ সালে ডিমাপুর কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তখন থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩১ বছরের কর্মময় জীবনে শ্রী দেবাশিস দত্ত রচনা করে গেছেন অসংখ্য মূল্যবান সাহিত্য ২০০০ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছিলেন।

তাঁর সাহিত্য চর্চায় মূলত স্থান পেয়েছে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধসমূহ তারই অঙ্গ হিসেবে দেশের তুলনামূলক ভাবে অপরিচিত ও অনাবিষ্কৃত এই নাগাভূমির সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনধারা, রূপকথা ইত্যাদির উপর তাঁর বিস্তৃত এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তথা গবেষণা বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বস্তুত তাঁর এই বিশাল সাহিত্যকর্মের মাধ্যমেই নাগাভূমির বৈচিত্রময় রঙ, রূপ, মাধুর্য আজ বিশ্বের বাঙালি পাঠক পাঠিকার দরবারে জায়গা করে নিতে পেরেছে

২০০১ সালে এই সাহিত্যিকের জীবনে ঘটে যায় এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অক্ষয় স্বর্গগামী হন সাহিত্যিক-পত্নী কল্যাণী। এই একটি ঘটনা তাঁর মননে চিন্তনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর অব্যবহিত পরেই কবিতার রহস্যময় জগতে তাঁর নিঃশব্দ পদার্পণ। আর তারই ফলশ্রুতি কবিতা সংকলন – ‘মেঘকন্যা’।

এর বাইরে অসংখ্য পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে অনেক সাহিত্যকৃতি।

বাংলা সাহিত্যের এই দুর্যোগের দিনে অধ্যাপক দেবাশিস দত্তের চলে যাওয়াটা তাই অবধারিত ভাবেই সৃষ্টি করবে এক শূন্যতা। আজ এই বিষাদময় দিনে তাঁরই কথায় স্মরণ করি তাঁকে - “ক্ষুদ্রতা দিয়ে জীবনকে পাওয়া যায় না। - - - -  জীবনে বিশাল, বিরাট মহত্তর কিছু লাভ করতে গেলে মহত্তর ত্যাগের মধ্য দিয়েই তাকে পাওয়া যায়। সহজে যা আয়ত্তে আসে, অনায়াসে তার সমাপ্তি ঘটে। বিরাট কিছু ত্যাগ করতে না পারলে বিশালকে আয়ত্তাধীন করা সম্ভব নয়। - - - - জীবনে সত্যস্বরূপের সন্ধান পেতে গেলে দুঃখ, মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাকে পেতে হয় - এ ঐতিহাসিক সত্য। সভ্যতা সৃষ্টির মূলে এ কথার যথার্থতা নিহিত রয়েছে”। ( রবীন্দ্রনাটকে মৃত্যু, পৃ - ৭৮)।

- - - - - - - - - -

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

Comments

  1. এক অমূল্য রত্ন হারালাম। এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়।বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনাকে ভালোবাসা।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়