Skip to main content

মিথিলেশ ভট্টাচার্যের স্মৃতিমেদুর শহর সফর - ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়’


হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে ...
পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে যেতে এ কথাটিই যেন বার বার ফিরে ফিরে আসছিল মনের মধ্যে। যদিও ফারাক আছে বেশ। তবু এই পথ চলার বৃত্তান্ত পাঠক মনকে কোনও এক অদেখা সুতোর বন্ধনে জড়িয়ে আটকে রাখে নিরন্তর।
গল্পকার মিথিলেশ ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথা ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়’ও এমনি এক পথ চলার সাতকাহন। পাঁচ বাই সাত ইঞ্চির ৬৫ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে কোলকাতা থেকে এপ্রিল ২০২২-এ। চিন্তা গদ্য সিরিজ ১৪-এর অধীনে।
গ্রন্থ নামেই গ্রন্থের নির্যাস রয়েছে প্রোথিত। পথ যতই ভাঙা হোক, ধূলিময় হোক, ঋদ্ধ অতীতের সহাবস্থানে সেই ধুলো কখনো ধূসর হয় না, সেই ধুলো চির রঙিন, হৃদয়-রাঙা। সে অর্থে যথেষ্ট অর্থবহ এবং যথার্থ নামকরণ। কিন্তু এ স্মৃতিকথা জীবনকথা নয়। এ একটি মাত্র দিনের এক পথকথা। এ গ্রন্থের নায়ক - ভাষ্যকার নির্মলেন্দুর মুখ দিয়ে কথাকারের এক অনবদ্য স্মৃতিমেদুর পথ চলার বৃত্তান্ত। অবসরপ্রাপ্ত নির্মলেন্দুর নিত্যদিনের পথ চলার মধ্য থেকে তুলে আনা একটি দিনের কথা।
নির্মলেন্দু আর শহর শিলচর যেন একে অপরের পরিপূরক। জীবনপথের অনেকখানি দূরত্ব পেরিয়ে এসে আজও নির্মলেন্দু একাত্ম হয়ে আছে শহর শিলচরের পথে পথে অলিতে গলিতে।
‘ঘরের বাহিরে দুই পা ফেলিয়া’ শীর্ষক ভূমিকায় গ্রন্থকার মিথিলেশ লিখছেন - ‘ঘরের বাহিরে দুই পা ফেলিয়া বড় একটা বাইরে বেরোতে চাইনি কখনো। ...তবে একেবারেই যে বেরোইনি তা ঠিক নয়। বেরিয়েছি। ... সবচেয়ে ভালো করে দেখেছি ও জেনেছি আমার দ্বিতীয় জন্মের শহর শিলচরকে এবং তার মানুষজনকে। ...ঘুরেফিরেই আমার মনে হয়েছে ঐতিহ্যমণ্ডিত, ভাষা শহিদের এই শহরকে নিয়ে কিছু লিখি।
...আমি নিয়মিত আমার প্রিয় শহরে সাইকেল রিকশায়, অটোয় এবং পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি এবং এই বেড়ানোর বর্ণনাই আমার এই বইয়ে হুবহু লিখে রাখার চেষ্টা করেছি। ...’
আর এর পরই শুরু হয় নির্মলেন্দুর পথ চলার বৃত্তান্ত - ‘সহসা ভালোলাগার এক দুরন্ত আমেজে-আবেশে চোখ দু’টি যেন বুজে আসছিল নির্মলেন্দুর। অটোর বাঁদিকে দরজায় হাত রেখে পিছনের গদিতে শরীর হেলান দিয়ে বসেছিল সে। অঘ্রাণের প্রথম বেলা। বাতাসে তিরতিরে শীতের আমেজ। নির্মেঘ নীলাকাশ চকচকে রোদে ভেসে যাচ্ছে। বেশ তাপও আছে রোদে... রাঙ্গিরখাড়ি নেতাজি সুভাষ মূর্তির কাছ থেকে সামনের দিকের পিচ ঢালা রাস্তা বেশ মসৃণ। ঝাঁকুনি প্রায় নেই বললেই চলে ...... ।’
এরপর প্রেমতলা, শিলংপট্টি হয়ে দেবদূত অবধি অটোযাত্রা শেষে গোটা শহরের পথকথা। এসেছে প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি পয়েন্ট। চক্কর কেটে কেটে অতীত আর বর্তমানকে স্ন্যাপশটের মতো তুলে ধরে আবার প্রেমতলা অটো পয়েন্ট অবধি যাত্রার বৃত্তান্ত। প্রতিটি রাস্তার, ফেলে আসা দিনের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য দোকান, চায়ের দোকানের স্মৃতিকথা যেন খেলা করে বেড়িয়েছে ছত্রে ছত্রে। এসেছে বরবক্র বরাকের কথা, ব্রাহ্ম মন্দির, গান্ধীবাগ, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি, ক্লাব হাউস, সদরঘাট ব্রীজ, অধুনালুপ্ত একাধিক সিনেমা হল, চন্দবাড়ি, জানিগঞ্জ, আর ডি আই হল, গোলদিঘি, ফাটক বাজার, তখনকার শহর শিলচরের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা। অতীতের নানা ঘটনারাজি ছবির মতো ভেসে ওঠেছে নির্মলেন্দুর চোখের সামনে। পথে কত নবীন-প্রবীণ সাথিদের সাথে দেখা, খোঁজখবর, স্মৃতি রোমন্থন।
কত আড্ডা, কত বৈঠকের স্মৃতি। বার বার ফিরে এসেছে শিলচরের হারানো দিনের আড্ডাসভা ‘মহিমালয়’-এর কথা। মহিমালয়ের আড্ডার মহিমার কথা আর ‘মহিমামৃত’ অর্থায় ‘কাঁচের গেলাসের গোলাপি রঙের চা’-এর কথা আর সেদিনের সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের কথা।  পড়তে পড়তে পাঠক মনও চলে যায় নির্মলেন্দুর সাথে অতীতের সেই সব দিনগুলোতে। “এক বেলা মহিম-বাবুর চা-দোকান বন্ধ থাকলে আমাদের দম বন্ধ হবার জোগাড় হতো - কোথায় যাব, বসব, চা খাব -ওসব ভেবে বড্ড হতাশ আর অবসন্ন হয়ে পড়তাম... আর আজকাল তো মহিমালয় আর মহিমবাবুহীন হয়ে আমরা একেবারে অনাথ হয়ে গেছি - এত বড় শহরে কোথাও একটা বসার জায়গা নেই, দু’দণ্ড আড্ডা দেওয়ার জায়গা নেই - ওসব না হলে সাহিত্য সৃষ্টি হয় না -।”
অতীতের স্মৃতিচারণার পাশাপাশি আজকের শিলচরের ক্ষয়িষ্ণু মানসিকতার ব্যথাও থাকে না অনুচ্চারিত - ‘গোপালগঞ্জ-জানিগঞ্জের পরিবর্তিত নাম শহিদ শচীন পাল অ্যাভিনিউ। কিন্তু নামটি কেউ মুখে বলে না। ভাষা আন্দোলনের আটান্ন বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখানকার জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনের শহিদদের সম্পর্কে উদাসীন, বিস্মৃতপ্রায়। এক আশ্চর্য জনপদ। কোনো আঘাতই যেন শরীরে লাগে না, মনে দাগ কেটে বসে না। ......’
এক পাক ঘুরে আসার ছলে শহর শিলচরকে যেন অতীতের বুক চিরে বর্তমানের নির্যাসহীন কঠোর বাস্তবে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন কথাকার। তবু কোথাও এক ভালোবাসা, এক অনন্ত আত্মীয়তার বন্ধন যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাতায় পাতায়। পথ চলতে চলতে যেন সিঞ্চিত হয়েছে একের পর এক মধুময় আমেজ-আবেশ। মনে পড়ে যায় কোনও এক অনামা কবির আরোও একটি কবিতার লাইন - ‘পথ চলা যেন দোদুল দোলায় লতাবিতানের শাখা, আদুরে গতরে বালিকা বধূটি কলকল মধুমাখা’।
যাত্রাশেষে - “পথের পাশে দাঁড়িয়ে বাঁদিকে ঘুরে তাকিয়ে কেমন এক বিস্ময় জাগে নির্মলেন্দুর। প্রেমতলার চৌমাথার পুলিশ আইল্যাণ্ডের পাশ দিয়ে অটোয় করে একসময় ঢুকেছিল সে শহরের প্রাণকেন্দ্রে - এখন বৃত্ত প্রায় পূর্ণ করে এসে দাঁড়িয়েছে যে পথে এসেছিল তারই শুরু বা শেষপ্রান্তে ...।”
কোথাও সাহিত্যরসের অপরূপ প্রক্ষেপণ, কোথাও প্রেম-ভালোবাসা, মানবিকতার অনবদ্য ছোঁয়া। সব মিলিয়ে নির্মলেন্দুর সঙ্গে সঙ্গে পাঠকেরও যেন শহিদ তীর্থ শিলচরের একপাক পরিভ্রমণ।
নিখুঁত শব্দ ও অক্ষরবিন্যাস। ছিমছাম প্রচ্ছদের পাশাপাশি আছে কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি যা আজও শহর শিলচরের গৌরবময় অতীতকে পাঠকের সামনে এনে দাঁড় করায়। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে - ‘শিলচর শহরের আপামর পুরবাসীজনের করকমলে যাঁরা একদিন ছিলেন, যাঁরা বর্তমানে আছেন, যাঁরা ভবিষ্যতে থাকবেন।’ অল্পসংখ্যক কিছু বানান প্রকাশকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে যদিও সরল পঠনে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। গ্রন্থমুল্য গ্রন্থের গরিমার সঙ্গে মানানসই যদিও সাধারণ পাঠকের কাছে গ্রন্থের আকার-আয়তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘ভাঙাপথের রাঙা ধুলায়’
মিথিলেশ ভট্টাচার্য
মূল্য - ৩০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৫৯৯৫১২৩৩

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়