গ্রন্থটি যেখানে উৎসর্গই করা হয়েছে ‘যারা দেশহীন ভাষাহীন’
তাদেরকে, স্বভাবতই সেখানে থাকবে তাদেরই কথা
- ‘তাহাদের কথা’। আবার যেখানে ভূমিকা এবং শেষ মলাটের
পরিচিতি লিখছেন বরাকমূলের দুই কৃতী সাহিত্যিক সেখানে বইয়ের ‘ভিতরকথা’ যে ‘বিশেষ’ হবে তাতেও কোনো সন্দেহ
থাকার অবকাশ নেই।
কবি তথা বহির্বরাকে উনিশে মে’র ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহিদদের পরিচয় ও মর্যাদা দানে নিরলস সচেষ্ট সাহিত্যকর্মী শান্তনু গঙ্গারিডির জন্ম বরাক উপত্যকায়। শিক্ষা ও কর্মজীবনও কেটেছে বরাক, ব্রহ্মপুত্র সহ এই উত্তরপূর্বে। বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা এই কবি তথা ‘উনিশে মে’ পত্রিকার সম্পাদক শান্তনু স্বভাবতই খুব কাছে থেকে দেখেছেন, অনুভব করেছেন উত্তরপূর্ব, বিশেষ করে আসামে বাঙালিদের উপর দফায় দফায় নেমে আসা অবিচার ও অত্যাচার। সেইসব এবং এইসব অবিচারের নির্মোহ বিশ্লেষণ তথা অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও শ্লেষাত্মক উচ্চারণে তুলে ধরেছেন তীব্র প্রতিবাদ। একজন কলম-সেনানী হয়ে কীভাবে নেমে পড়া যায় সরেজমিনে তারই এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন কবির এই আলোচ্য তৃতীয় গ্রন্থ ‘এখানেই আমাদের ঘর গেরস্থালি’।
কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে, শান্তনুর কবিতায় একের পর এক প্রতিবাদী পঙ্ক্তির উল্লেখ সহ ভূমিকায় বিস্তৃত লিখেছেন সাহিত্যিক তপোধীর ভট্টাচার্য। সঙ্গে রয়েছে সমকালকে ভিত্তি করে সমস্যার উপর আলোকপাত ও কার্যকারণ বিশ্লেষণ। যদিও এটা সর্বজনবিদিত যে এই সমস্যার প্রেক্ষাপট সমকালিক নয়। এর শিকড় প্রোথিত এবং লালিত হয়েছে বহু দশক আগে থেকেই। ভূমিকাকার তপোধীর লিখছেন - ‘শান্তনু এই প্রেক্ষিতে কবিতাকে যে তাঁর প্রতিবাদের শানিত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন, এরই নিদর্শন রইল এই সংকলনে। ...... নিকষ কালো অন্ধকারে সবদিক আচ্ছন্ন এখন। কী আর লিখতে পারেন শান্তনু এছাড়া ? মানুষ বড়ো কাঁদছে, তিনি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। দেখছেন, আসাম জুড়ে চলা শাসকের চূড়ান্ত কার্নিভাল; তাই ‘তর্পণে অবিশ্বাসী নাস্তিকগুলোও / বৃদ্ধপিতামহের লিংক হাতড়াচ্ছে...... দুরূহতম সময়ে নতুন করে লিখতে হয় অন্নদার আত্মপরিচয়...।
৮০ পৃষ্ঠার এই কাব্য সংকলনের ৬৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ৭০ টি কবিতা। প্রতিটি কবিতাই যেন আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। কবিতার ধারাবাহিকতা ও ধাঁচ নিয়ে শেষ মলাটে বরাকের আরেক কৃতী লেখক রণবীর পুরকায়স্থ লিখছেন ‘ ... শান্তনুকে আমরা কবিতা ও জীবনচর্চায় বহু রৈখিকতায় বিশ্বাসী বলেই জেনে এসেছি। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটিতে কবি অনেকাংশে এক-রৈখিক সুর তুলে ধরলেন বলে অনেকের মনে হতে পারে। উত্তরে বলা যায়; না, আসলে তা নয়...।’
আসলে বিষয়ভিত্তিক সংকলনে স্বভাবতই কবিতায় কবিতায় ফুটে ওঠে এক এক-রৈখিকতা। আর এখানেই শান্তনুর আলোচ্য এই কাব্যগ্রন্থ ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে কারণ এক-রৈখিকতার আপাত উপস্থাপনার অন্দরে কবি তূণীরবদ্ধ তিরের মতোই সাজিয়ে নিয়েছেন বহুরৈখিকতার ধারা। আঙ্গিক-বৈচিত্র্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে কবিতাগুলি। নিছক গদ্য আঙ্গিক, ছকহীন ও ছকবদ্ধ পদ্য আঙ্গিক, ছন্দ-ছন্দহীনতার বৈচিত্রে লক্ষ্যভেদের আয়োজন। এক একটি কবিতা আপন বৈভবে, আপন স্বকীয়তায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। বহু পঙ্ক্তি, বহু শব্দ, শব্দের ব্যঞ্জনা, শব্দের কাটাছেঁড়া বাঙময় হয়ে উঠেছে পাঠক হৃদয়ে। বস্তুত কিছু পঙ্ক্তিকে আলাদা করে উল্লেখ করার সুযোগ নেই। অসংখ্য পঙ্ক্তি জুড়ে রয়েছে বিচিত্র কাব্যশৈলী, ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে উঠে আসা কবিতা, বিষয়ভিত্তিক ব্যথা, দুঃখ, শ্লেষ, ক্ষোভ, প্রতিবাদ। রয়েছে কিছু কবিতা বিষয়ের বাইরেও।
শান্তনুর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে অধ্যয়নসঞ্জাত জ্ঞানের প্রকাশ। দেশ, কালের গণ্ডি পেরিয়ে এক বিস্তৃত সময় ও আন্তর্জাতিকতা স্থান করে নিয়েছে তাঁর কবিতায়। কবি নিজেকে করে তুলেছেন বহুজাগতিক এবং অপরিহার্য। পাঠকের কাছে এ এক আলাদা প্রাপ্তি, অনন্য অর্জন। তবে কিছু কবিতায় কিছু একরৈখিক তথা সিদ্ধান্তগত দোষারোপের ছায়াও রয়েছে যা হয়তো সর্বজনস্বীকার্য নাও হতে পারে। শব্দের চাতুর্য, বহুভাষিক উল্লেখ তথা কবিতার অনবদ্য অবয়বের মধ্যেও ফাঁক গলে লঙ্ঘিত হয়েছে স্বল্পসংখ্যক কিছু বানানের শুদ্ধতা।
অসাধারণ দক্ষতায় শক্তিশেলের মতো আছড়ে পড়েছে বহু কবিতা। যেমন - ছিফত আলির খং, ভূতচতুর্দশীতে লেখা কবিতা, মেইক ইন ইন্ডিয়া চুল্লি-থেরাপি, লিস্টিহীনায়াং ডেপুটেশনায়ঃ শ্রীশ্রীদুর্গাভ্যাম, লালফিতা, বর্ণলিপি... ইত্যাদি। ব্যতিক্রমী শিরোনাম সম্বলিত কবিতার ব্যতিক্রমী সংকলন ‘এখানেই আমাদের ঘর গেরস্থালি’। হ্যাঁ এখানেই আমাদের লিগ্যাসি -
‘আজ সকালেই নাগরিকপঞ্জি আধিকারিকের হাতে তুলে দিলাম,
কাল রাতে খুঁজে পাওয়া আমার প্রয়াত বাবার গোটা গোটা অক্ষরের
সই ও তারিখ লেখা সেই প্রাইমার
- বর্ণপরচয়।
নশ্বর দুনিয়ায় ঈশ্বর প্রদত্ত
বাঙালির লিগ্যাসি - কাম - পরিচয়পত্র। (কবিতা - অন্নদার আত্নপরিচয়)
গ্রন্থটির প্রকাশক - উনিশে, কলকাতা। বর্ণময় প্রচ্ছদের সৌজন্যে তপন কর। ছাপা ও বোর্ড বাঁধাইয়ের মান মোটামুটি যথাযথ। শব্দ ও পঙ্ক্তিবিন্যাসে আরোও যত্নবান হওয়ার সুযোগ ছিল। প্রতি পৃষ্ঠার উপরে দেওয়া গ্রন্থনাম ও কবিতার শিরোনামের মধ্যে গ্যাপ না থাকাটা বিসদৃশ হয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়মাহাত্ম্যে, সার্বিক উৎকর্ষে আপামর পাঠকের - বিশেষ করে - ‘দেশহীন ভাষাহীন’ তথা অত্যাচারিত ভাষিক মানুষের এক অবশ্যপাঠ্য কাব্য সংকলন - ‘এখানেই আমাদের ঘর গেরস্থালি’।
কবি তথা বহির্বরাকে উনিশে মে’র ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহিদদের পরিচয় ও মর্যাদা দানে নিরলস সচেষ্ট সাহিত্যকর্মী শান্তনু গঙ্গারিডির জন্ম বরাক উপত্যকায়। শিক্ষা ও কর্মজীবনও কেটেছে বরাক, ব্রহ্মপুত্র সহ এই উত্তরপূর্বে। বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা এই কবি তথা ‘উনিশে মে’ পত্রিকার সম্পাদক শান্তনু স্বভাবতই খুব কাছে থেকে দেখেছেন, অনুভব করেছেন উত্তরপূর্ব, বিশেষ করে আসামে বাঙালিদের উপর দফায় দফায় নেমে আসা অবিচার ও অত্যাচার। সেইসব এবং এইসব অবিচারের নির্মোহ বিশ্লেষণ তথা অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও শ্লেষাত্মক উচ্চারণে তুলে ধরেছেন তীব্র প্রতিবাদ। একজন কলম-সেনানী হয়ে কীভাবে নেমে পড়া যায় সরেজমিনে তারই এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন কবির এই আলোচ্য তৃতীয় গ্রন্থ ‘এখানেই আমাদের ঘর গেরস্থালি’।
কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে, শান্তনুর কবিতায় একের পর এক প্রতিবাদী পঙ্ক্তির উল্লেখ সহ ভূমিকায় বিস্তৃত লিখেছেন সাহিত্যিক তপোধীর ভট্টাচার্য। সঙ্গে রয়েছে সমকালকে ভিত্তি করে সমস্যার উপর আলোকপাত ও কার্যকারণ বিশ্লেষণ। যদিও এটা সর্বজনবিদিত যে এই সমস্যার প্রেক্ষাপট সমকালিক নয়। এর শিকড় প্রোথিত এবং লালিত হয়েছে বহু দশক আগে থেকেই। ভূমিকাকার তপোধীর লিখছেন - ‘শান্তনু এই প্রেক্ষিতে কবিতাকে যে তাঁর প্রতিবাদের শানিত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন, এরই নিদর্শন রইল এই সংকলনে। ...... নিকষ কালো অন্ধকারে সবদিক আচ্ছন্ন এখন। কী আর লিখতে পারেন শান্তনু এছাড়া ? মানুষ বড়ো কাঁদছে, তিনি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। দেখছেন, আসাম জুড়ে চলা শাসকের চূড়ান্ত কার্নিভাল; তাই ‘তর্পণে অবিশ্বাসী নাস্তিকগুলোও / বৃদ্ধপিতামহের লিংক হাতড়াচ্ছে...... দুরূহতম সময়ে নতুন করে লিখতে হয় অন্নদার আত্মপরিচয়...।
৮০ পৃষ্ঠার এই কাব্য সংকলনের ৬৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ৭০ টি কবিতা। প্রতিটি কবিতাই যেন আপন স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। কবিতার ধারাবাহিকতা ও ধাঁচ নিয়ে শেষ মলাটে বরাকের আরেক কৃতী লেখক রণবীর পুরকায়স্থ লিখছেন ‘ ... শান্তনুকে আমরা কবিতা ও জীবনচর্চায় বহু রৈখিকতায় বিশ্বাসী বলেই জেনে এসেছি। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটিতে কবি অনেকাংশে এক-রৈখিক সুর তুলে ধরলেন বলে অনেকের মনে হতে পারে। উত্তরে বলা যায়; না, আসলে তা নয়...।’
আসলে বিষয়ভিত্তিক সংকলনে স্বভাবতই কবিতায় কবিতায় ফুটে ওঠে এক এক-রৈখিকতা। আর এখানেই শান্তনুর আলোচ্য এই কাব্যগ্রন্থ ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে কারণ এক-রৈখিকতার আপাত উপস্থাপনার অন্দরে কবি তূণীরবদ্ধ তিরের মতোই সাজিয়ে নিয়েছেন বহুরৈখিকতার ধারা। আঙ্গিক-বৈচিত্র্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে কবিতাগুলি। নিছক গদ্য আঙ্গিক, ছকহীন ও ছকবদ্ধ পদ্য আঙ্গিক, ছন্দ-ছন্দহীনতার বৈচিত্রে লক্ষ্যভেদের আয়োজন। এক একটি কবিতা আপন বৈভবে, আপন স্বকীয়তায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। বহু পঙ্ক্তি, বহু শব্দ, শব্দের ব্যঞ্জনা, শব্দের কাটাছেঁড়া বাঙময় হয়ে উঠেছে পাঠক হৃদয়ে। বস্তুত কিছু পঙ্ক্তিকে আলাদা করে উল্লেখ করার সুযোগ নেই। অসংখ্য পঙ্ক্তি জুড়ে রয়েছে বিচিত্র কাব্যশৈলী, ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে উঠে আসা কবিতা, বিষয়ভিত্তিক ব্যথা, দুঃখ, শ্লেষ, ক্ষোভ, প্রতিবাদ। রয়েছে কিছু কবিতা বিষয়ের বাইরেও।
শান্তনুর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে অধ্যয়নসঞ্জাত জ্ঞানের প্রকাশ। দেশ, কালের গণ্ডি পেরিয়ে এক বিস্তৃত সময় ও আন্তর্জাতিকতা স্থান করে নিয়েছে তাঁর কবিতায়। কবি নিজেকে করে তুলেছেন বহুজাগতিক এবং অপরিহার্য। পাঠকের কাছে এ এক আলাদা প্রাপ্তি, অনন্য অর্জন। তবে কিছু কবিতায় কিছু একরৈখিক তথা সিদ্ধান্তগত দোষারোপের ছায়াও রয়েছে যা হয়তো সর্বজনস্বীকার্য নাও হতে পারে। শব্দের চাতুর্য, বহুভাষিক উল্লেখ তথা কবিতার অনবদ্য অবয়বের মধ্যেও ফাঁক গলে লঙ্ঘিত হয়েছে স্বল্পসংখ্যক কিছু বানানের শুদ্ধতা।
অসাধারণ দক্ষতায় শক্তিশেলের মতো আছড়ে পড়েছে বহু কবিতা। যেমন - ছিফত আলির খং, ভূতচতুর্দশীতে লেখা কবিতা, মেইক ইন ইন্ডিয়া চুল্লি-থেরাপি, লিস্টিহীনায়াং ডেপুটেশনায়ঃ শ্রীশ্রীদুর্গাভ্যাম, লালফিতা, বর্ণলিপি... ইত্যাদি। ব্যতিক্রমী শিরোনাম সম্বলিত কবিতার ব্যতিক্রমী সংকলন ‘এখানেই আমাদের ঘর গেরস্থালি’। হ্যাঁ এখানেই আমাদের লিগ্যাসি -
‘আজ সকালেই নাগরিকপঞ্জি আধিকারিকের হাতে তুলে দিলাম,
কাল রাতে খুঁজে পাওয়া আমার প্রয়াত বাবার গোটা গোটা অক্ষরের
সই ও তারিখ লেখা সেই প্রাইমার
- বর্ণপরচয়।
নশ্বর দুনিয়ায় ঈশ্বর প্রদত্ত
বাঙালির লিগ্যাসি - কাম - পরিচয়পত্র। (কবিতা - অন্নদার আত্নপরিচয়)
গ্রন্থটির প্রকাশক - উনিশে, কলকাতা। বর্ণময় প্রচ্ছদের সৌজন্যে তপন কর। ছাপা ও বোর্ড বাঁধাইয়ের মান মোটামুটি যথাযথ। শব্দ ও পঙ্ক্তিবিন্যাসে আরোও যত্নবান হওয়ার সুযোগ ছিল। প্রতি পৃষ্ঠার উপরে দেওয়া গ্রন্থনাম ও কবিতার শিরোনামের মধ্যে গ্যাপ না থাকাটা বিসদৃশ হয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়মাহাত্ম্যে, সার্বিক উৎকর্ষে আপামর পাঠকের - বিশেষ করে - ‘দেশহীন ভাষাহীন’ তথা অত্যাচারিত ভাষিক মানুষের এক অবশ্যপাঠ্য কাব্য সংকলন - ‘এখানেই আমাদের ঘর গেরস্থালি’।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ১২৫ টাকা
যোগাযোগ - অনুল্লেখিত।
যোগাযোগ - অনুল্লেখিত।
Comments
Post a Comment