Skip to main content

নান্দনিক সাহিত্যসৃষ্টির সগর্ব, সোচ্চার আবাহন দশম সংখ্যা - ‘সীমান্ত’


ফেব্রুয়ারি মাস বিশ্ব জুড়ে ভাষার মাস। এই আবহে প্রকাশিত হল নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন নামের একটি ঐতিহ্যপূর্ণ সংগঠনের গোসাইগাঁও (আসাম) শাখার দশম সংখ্যা মুখপত্র তথা সাহিত্য পত্রিকা ‘সীমান্ত’। বড়োল্যান্ড এলাকা থেকে নিয়মিত হিসেবে একটি বাংলা পত্রিকার প্রকাশ নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়। একটি সম্পাদকীয় দপ্তর থাকলেও এ সংখ্যার সম্পাদক বন্দন দেব। সম্পাদকীয়তে প্রতিকূল অবস্থাতেও শুধুমাত্র ভাষার টানেই যে এমন এক আয়োজন সে কথা পরিপাটি করেই উল্লেখ করেছেন সম্পাদক। স্বভাবতই ভাষা সাহিত্যের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে আলোচ্য সংখাটিতে। ভাষা গরজে সমৃদ্ধ সম্পাদকীয়তে বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক বাক্য সংযোজিত হয়েছে। পাশাপাশি এও বলা হয়েছে - ‘শাখার মুখপত্র ‘সীমান্ত’ পত্রিকায় কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল বাক্য গঠন, গুরুচণ্ডালী দোষ ও বানানের ক্ষেত্রে ভুল থাকা স্বাভাবিক। আমরা যে ভৌগোলিক খণ্ডে ও বিভিন্ন ভাষাভাষীর সংমিশ্রণে থাকি তাতে স্মরণিকা প্রকাশ করাটাই আশ্চর্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়…।’ এরপর এ নিয়ে আর কথা হয় না। তবে এ ‘ভুল’কে যে ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠার প্রয়োজন এবং প্রচেষ্টা রয়েছে এমন ইঙ্গিত পেলে ভালো লাগত বইকী।
প্রবন্ধ, কবিতা ছোটগল্পের সমাহারে ১১৬ পৃষ্ঠার ‘সীমান্ত’ নিঃসন্দেহে এক সমৃদ্ধ আয়োজন। অক্ষর-আকার (ফন্ট সাইজ) বড় হওয়ার সুবাদে এবং ছাপার স্পষ্টতার কারণে পঠন-বান্ধব হয়ে উঠেছে সংখ্যাটি। ছোট পত্রিকা, বিশেষ করে মুখপত্রে লেখা সংযোজনে সম্পাদকমণ্ডলীর কিছু দায়বদ্ধতা থাকে, বাধ্যবাধকতা থাকে। আমন্ত্রিত লেখার সঙ্গে সেইসব লেখার সহাবস্থান তাই এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এখানেও ব্যত্যয় ঘটেনি। এবার ভেতরের মলাটে চোখ রাখা যাক।  
এ সংখ্যায় মোট প্রবন্ধের সংখ্যা ১১ টি। লিখেছেন মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম, কবিতা বোস, উদয় নারায়ণ বাগ, লোপামুদ্রা চক্রবর্তী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাদুড়ী, নির্মলেন্দু রায়, কামাখ্যা প্রসাদ শর্মা, অবনীন্দ্র কুমার নন্দী, চিন্ময় কুমার বল (পুনঃপ্রকাশিত, এর আগে বেরিয়েছিল তেজপুর শাখার মুখপত্র ‘প্রাচীপট’-এ), কমলিকা শর্মা ও বিশ্বজিৎ রায় (সংগৃহীত)। প্রথম ও শেষ নিবন্ধ দুটি বিষয়ভিত্তিক। পরিসরের অভাবে প্রতিটি রচনার আলোচনা সম্ভব নয় তবে মীনাক্ষী, নির্মলেন্দু, চিন্ময়, কবিতা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কমলিকার নিবন্ধ বিশেষোল্লেখে রাখা যেতেই পারে। উদয় নারায়ণের নিবন্ধের বিষয়বস্তুজনিত গ্রহণযোগ্যতা পাঠক ভেদে ভিন্ন হতেই পারে।
প্রিয়স চন্দ্র রায়ের রম্য রচনা অতি সংক্ষিপ্ত। সুদীপ মুখার্জীর ভ্রমণ কাহিনি মুদ্রণ প্রমাদের জন্য ‘অসাধারণ’ হয়েও হয়ে উঠতে পারল না। গল্প বিভাগে রয়েছে পাঁচটি মৌলিক ও একটি অনুবাদ গল্প। তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘূর্ণি ঝড়’ টানটান থ্রিলারধর্মী রচনা, তবে আচমকাই যেন শেষ হয়ে গেল। ওই ‘চাপ’ বা ‘নিম্নচাপ’-এর ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কিছু ঘোলাটেই হয়ে রইল হয়তো। তনিমা পাত্রের ‘বংশধর’ - ‘সুচিন্তিত’, সংক্ষিপ্ত সাহিত্য চর্চা। ছিমছাম - সিদ্ধান্তের গল্প বনশ্রী রায় মিত্রের ‘মুরোদ’। ‘ড়’ ও ‘র’-এর বিভ্রাট রয়েছে। যৌন আবেদনধর্মী টানটান উত্তেজনার গল্প ‘উত্তাল অববাহিকা’। লিখেছেন গৌতম হাটি। সাহিত্যগুণসম্পন্ন ভিন্নধর্মী প্লট। তবে কিছু তৎসম শব্দের প্রয়োগ অহেতুক বোধ হতে পারে। রীতা দেবনাথ মুখার্জীর গল্প স্মৃতিচারণমূলক। অনুবাদের অনুবাদ হলে যা হয় তাই হয়েছে সুলেখক তপন মহন্তের অনুবাদ গল্প ‘সন্দেহ’তে। অনুবাদক নিজেই পাদটীকায় লিখছেন - ‘ভাষান্তরে আহত কণ্ঠস্বরের কতটুকু ধরে রাখা সম্ভব বলা মুশকিল।’
বাকি রইল কবিতা পর্ব। দুই ভাগে নিন্যস্ত। একটি নিয়মিত কবিতা বিভাগ, অন্যটি কচি-কাঁচাদের পাতা। এক ব্যতিক্রমী সংযোজন। সম্পাদকীয় দপ্তরকে সাধুবাদ এমন বিভাগ যুক্ত করার জন্য। এও ভাষার এক গরজ, ভবিষ্যতের সোপান তৈরির গরজ। এতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে তিন পাতায় মোট সাতটি বিচিত্রধর্মী ছড়া/কবিতা। গুণমান এখানে বিবেচ্য নয়। লিখেছেন রবিনা সরকার, বর্ণালী সরকার, পিয়া কুণ্ডু, ঈশা সাহা, অনুষ্কা দত্ত, অঙ্কিতা ঘোষ ও অংকিতা সাহা। মহিলা ছড়াকারদের জয়জয়কার। এহ বাহ্য। পরবর্তীতে এ রাজ্যের বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিকদের লেখা সন্নিবিষ্ট হলে জমজমাট হবে নিঃসন্দেহে।
নিয়মিত কবিতা বিভাগে রয়েছে গুচ্ছ স্বাদের গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা। দীর্ঘ সূচি। লিখেছেন নারায়ণ চৌধুরী, পৃথা রায়চৌধুরী, রফিকুল হাসান, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, বরকত কাজি, কৃষ্ণকান্ত সূত্রধর, তরুণ কুমার আচার্য, প্রিয়স রায়, গৌতম বসু, পান্না চক্রবর্তী, পঙ্কজ সেনগুপ্ত, জুলি সেন মিত্র, রানী দেবনাথ, মধুমিতা পাল, ফটিক ঘোষ, উত্তম বিশ্বাস, রাখি দাস, বর্ণালী দেবনাথ, বন্দন দেব, অমর ধাড়া, মানিক দীক্ষিত, পরেশ চন্দ্র সরকার, রঞ্জিত দে, অঙ্কিতা দেব, বিবেকানন্দ চাকলাদার (বিবেক) ও অংকিতা দত্ত।
আয়োজনে, সম্ভারে একটি পূজা সংখ্যার চেয়ে কম নয় মোটেও। পত্রিকা প্রকাশে আয়োজকদের নিবেদন পাতায় পাতায় পরিস্ফুট। প্রাসঙ্গিক প্রোজ্জ্বল প্রচ্ছদের সৌজন্যে গৌতম দে সরকার। সম্পাদকীয় আহ্বান মেনে বানান ভুলের ব্যাপারটি ঊহ্য রেখেই তাই বলা যায় শাখার তরফে প্রকাশিত এই মুখপত্র নিশ্চিতভাবেই নান্দনিক সাহিত্যসৃষ্টির পথে এক সগর্ব, সোচ্চার আবাহন।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - অনুল্লেখিত
যোগাযোগ - ৮৬৩৮০৫২৭৭১

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি