Skip to main content

শেকড়ের টানে সমৃদ্ধ - ‘জড়র টানে’ ৮ম সংখ্যা


বলা যেতেই পারে এক অভিনব উদ্যোগ এবং অভাবনীয় কৃতিত্ব। এপার বাংলা, ওপার বাংলা মিলিয়ে কোটি কোটি মানুষ আঞ্চলিক বাংলা ভাষায় কথা বললেও একশোভাগ আঞ্চলিক ভাষায় লেখালেখিসম্পন্ন একটি পত্রিকা বা সাময়িকী - এমন নজির নিতান্তই বিরল। পরিসর কিছু কমিয়ে আনলে এপার বাংলায় আমাদের এই ঈশান বাংলায় এমনই এক অসাধ্য সাধন করে চলেছে সর্বভারতীয় সিলেটি ফোরাম। ফোরামের নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ‘জড়র টানে’ সিলেটি আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত একটি নিয়মিত নিখাদ পত্রিকা যেখানে প্রতিটি রচনা তা সে গদ্যই হোক বা পদ্য - আবশ্যিক ভাবে সিলেটিতেই হতে হবে। এটাই নিয়ম। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এই পত্রিকার ৮ম সংখ্যা, ডিসেম্বর ২০২৪ সংখ্যা।
আগাপাশতলা একটি উন্নত মানের পত্রিকা যার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে ভেতরের সম্পূর্ণ লেখালেখি গুণগত মানসম্পন্ন। ১/৪ ডিমাই কাগজের সাইজে ৫৮ পৃষ্ঠার এই ম্যাগাজিনের ৪৫ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে বিচিত্র সব বিষয়ের উপর লেখা গদ্য-পদ্যের সম্ভার। স্বভাবতই আঞ্চলিক কথ্য ভাষা ও সংলাপে ফুটে উঠেছে শেকড়ের টান, শেকড়ের কথা। উঠে এসেছে ঐতিহ্য, পরম্পরার বিশ্লেষণ। এক এক করে এগোলে প্রথমেই রয়েছে একটি ‘মুখচন্দ্রিকা’। সম্পাদকের কলমে এই অংশে আছে - ‘...উদ্যোগ থাকলেউ তো আর হয় না, সাথে লাগে সবোর আন্তরিকতা না হৈলে জড়র টানের এই সাত সাতটা সিঁড়ি বাইয়া অতটা উপরে উঠা অতো সহজ আছিল না...। আমি আজকে গর্ব করিয়া কৈতে পারি আমরার এই ফোরামর অনুপ্রেরণায় ঔ প্রচুর ভালা ভালা লেখক, শিল্পী, কবি তারা উপরে উঠিয়া আইতে পারছৈন, নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষরও রাখতে পারছৈন...।’
এবং সত্যিকার অর্থেই এই প্রতিভার স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাঠানো লেখাসমূহে। আলোচ্য সংখ্যায় সন্নিবিষ্ট রচনাসমূহ পাঠ করলে অনুভব করা যায় যে রচনাসমূহের বিষয়বস্তু এবং রচনার বুনোট কোনো মান্য বাংলার লেখালেখির চাইতে কোনো অংশেই কম নয়। এমন রচনা যাঁরা লিখতে পেরেছেন তাঁরা যে অনায়াসে কোনো নামিদামি পত্রিকায় লিখতে সক্ষম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখালেখির প্রথমেই আছে সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্তীর - ‘এক জজ সাহেবার গল্প’। ১৯৬১ সনের ভাষা আন্দোলনের পরিণতিতে যে নির্মম ঘটনা ঘটেছিল শহর শিলচরের বুকে তার জের হিসেবে এক সাহসী বরাককন্যা গোপা দত্তের এক দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডের নিখুঁত বর্ণনা। একটি অবশ্যপাঠ্য ঐতিহাসিক রচনা। ৬টি পর্বে মুক্তি দত্ত লিখেছেন একটি সাংস্কৃতিক প্রতিবেদনধর্মী নিবন্ধ ‘সিলেটি সংস্কৃতি’ যেখানে সিলেটি আচার ও সংস্কৃতি অনুযায়ী রয়েছে ৬টি সংস্কারের বৃত্তান্ত। সাধভক্ষণ, ষষ্ঠীপূজা, অন্নপ্রাশন, হাতেখড়ি, পইতা ও বিয়ে। প্রথম দুটি পর্বের, বিশেষ করে প্রথম পর্বের উৎসাহব্যঞ্জক খুঁটিনাটি বিস্তার ঘটলেও বাকি চারটি পর্বের শুধু সংজ্ঞালিখনেই সমাপ্ত হয়েছে নিবন্ধ। বিস্তৃতির সুযোগ এবং চাহিদা দুটিই কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ছিল। মিস্টি দেব-এর সংক্ষিপ্ত রচনা ‘সতী পীঠ’ সুখপাঠ্য। বিস্তৃত ভ্রমণ কাহিনি সন্নিবিষ্ট হলে তা পাঠকের জন্য সুখকর হতো। এক পৃষ্ঠার একটি দুর্দান্ত স্মৃতিচারণমূলক কাহিনি ‘স্মৃতি’ লিখেছেন সমিতা ভট্টাচার্য। পাঠকের মনে দোলা দিয়ে যাবেই এমন রচনা। লেখক, প্রাবন্ধিক নির্মলেন্দু দেব লিখেছেন একটি তথ্যভিত্তিক নিবন্ধ ‘আমি ব্রাহ্মণ ?’ আজকের উত্তর-আধুনিক সমাজভাবনার বিপরীতে এক ব্যতিক্রমী লেখা। সিক্তা দাশগুপ্ত দত্তের গল্প ‘বাবা’ এক কথায় অসাধারণ। মেদবর্জিত এক ভিন্নধর্মী উত্তরণের গল্প। গল্পের বুনোট পোক্ত যদিও কিছু সম্প্রসারণের সুযোগ হয়তো ছিল। অসাধারণ একটি রম্য গল্প ‘লঙ্গাইর বেগুন’ লিখেছেন প্রসেনজিৎ দাস। গল্পের বুনোট, সংলাপ উন্নত লিখনশৈলীর পরিচায়ক। বিনয় ভূষণ দাসের ছোটগল্প ‘স্নেহময়ী মা’ নড়িয়ে দেয় পাঠক হৃদয়। সুলিখিত। তাঁর পরবর্তী পূর্ণদৈর্ঘের গল্প ‘দুই বন্ধুর গল্প’ চেনা প্লটে অচেনা সৌরভের বার্তা ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। নিরবচ্ছিন্ন পঠনের টানটান গল্প। একইভাবে নির্মল ভট্টাচার্যের গল্প ‘চিত্রা’ও এগিয়েছে তরতরিয়ে। ‘গল্পসুলভ’ একটি গোছানো গল্প। রামোময় ভট্টাচার্যের গল্প ‘মরণ ফাঁদ’ কল্পকাহিনির আদলে একটি ফিকশনধর্মী গল্প। ‘সাপের ছোঁবল’ গল্পটি লিখেছেন হিমাংশু দাস। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে সাজানো একটি মৌলিক গল্প। বিরতিবিহীন সরল পঠনের গল্প। পৃথ্বীশ পুরকায়স্থের গল্প ‘ঈশান খুটি’ও একটি সুলিখিত মৌলিক গল্প। পারিবারিক আবহে মানবিক সহাবস্থানের চমৎকার গল্প। মন নিয়ে একটি মানবিক নিবন্ধ ‘মন’ লিখেছেন মুক্তি ভট্টাচার্য দে। সুলিখিত নিবন্ধ। এছাড়া রয়েছে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর গল্প ‘অধরা সবুজ’।
কবিতা বিভাগে রয়েছে নানা স্বাদের একগুচ্ছ কবিতা। লিখেছেন সেবিকা দাস, রামোময় ভট্টাচার্য, প্রদীপ রঞ্জন দাস, নিয়তি চৌধুরী চক্রবর্তী, সৌমেন্দু ভট্টাচার্য, তিলক ভট্টাচার্য, সিক্তা দাশগুপ্ত দত্ত, বিপ্রাশীষ চক্রবর্তী, মধুমিতা দাস, বাপ্পী পাল দেব। এর মধ্যে বিষয়ে, বয়ানে, বিস্তারে বেশ ক’টি কবিতা একাধারে হৃদয়স্পর্শী ও সুলিখিত। 
শেষের কয়েকটি পাতা জুড়ে রয়েছে ফোরামের ‘সাহায্যের হাত’-এর কর্মকাণ্ড বিষয়ক সচিত্র ও বিস্তৃত প্রতিবেদন। সব মিলিয়ে এক ব্যতিক্রমী ধারার পত্রিকা সাময়িকী। স্পষ্ট ছাপা, কাগজের মান পঠনসুখের জন্ম দেয়। ডলি ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক হলেও অস্পষ্ট। আঞ্চলিক ভাষায় বানানের কোনো নির্ধারিত বিধি থকে না। তাই একই বানান ভিন্ন ভিন্ন লেখায় এসেছে ভিন্ন ধারায়। তবু এক সুখপঠন - জড়ের টানে।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - অনুল্লেখিত
যোগাযোগ - ৯৮৬৪৩৬০৪১৭

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...