Skip to main content

অণুগল্পে প্রকাশিত এক আকাশ কথাভাষ - ‘চিলেকোঠার চিরকুট’


কত কত চিরকুটেই যে লেখা থাকে কত কত অজানা গল্প, না বলা কথা। অণুকথায় ধরা থাকে অন্তরের যাবতীয় সুখ-দুঃখগাথা। অঙ্গভঙ্গি কিংবা নয়নঠারেও তো চকিতে লেখা হয়ে যায় অন্তরের বাখান। সেক্ষেত্রে একটি সুসজ্জিত অণুগল্প যে পাঠকের দরবারে হাজির করতে পারে এক আকাশ অনুভব ও অনুভূতির প্রকাশ তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে ?  
দুই ফর্মার স্টেটমেন্ট সাইজে পেপারব্যাক সংস্করণ ভেতরে ২৬ পৃষ্ঠা জুড়ে খেয়ালি মনের ১৮টি সুসজ্জিত অণুগল্প স্বভাবতই একপঠনের সংকলন আজকের দিনে বাংলায় যাঁরা গল্প/অণুগল্প লিখছেন তাঁদের মধ্যে মঞ্জরী হীরামণি রায় একটি উল্লেখযোগ্য নাম লিখছেন বহু দিন ধরে, তবু প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি নয় এর কারণ হচ্ছে এই যে মঞ্জরী বহু দিন ধরে লেখালেখি করলেও পরিমাণের চেয়ে লেখার মানের দিকে তাঁর অধিক সচেতনতা ফলত মুড়ি মুড়কির মতো নয়, রয়ে সয়ে গুণগত মানসম্পন্ন গল্প রচনায় তিনি মনোযোগী
আলোচ্য গ্রন্থচিলেকোঠার চিরকুট’-এও এই উৎকর্ষ বজায় থেকেছে অধিকাংশ গল্পে ১ বা ২ পৃষ্ঠায় বিস্তৃত এইসব গল্পের প্রসার, বিস্তার এবং শৈলীতে যে পারিপাট্য এবং চমৎকারিত্ব রয়েছে তা অনুধাবণ করতে হলে প্রয়োজন নিমগ্ন পাঠ অন্যথায় গল্পের মূল বিষয় থেকে দূরে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। বিশেষ করে অণুগল্পের যাবতীয় নির্যাস যেখানে শেষলগ্নে হয় উন্মোচিত।   
যে কোনো কবি বা লেখকের লিখনশৈলীতে সময়ের ছাপ ও পরিবর্তন আসাটা খুবই স্বাভাবিক মঞ্জরীর এই গ্রন্থের গল্পসমূহেও এসব পরিবর্তন লক্ষণীয় আলোচ্য গ্রন্থের সবকটি গল্পের এমনকি উৎসর্গেরও ভাষা ও ভাবনা এক অসামান্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে একশো ভাগ সক্ষম হয়েছেন গল্পকার। কয়েকটি মোহনীয় লাইন তুলেই দেওয়া যেতে পারে এখানে -
‘...বৃষ্টির নিক্কণ থেমে গেছে অনেকক্ষণ। রাত-চরেরা ডানা মেলেছে ঝাপসা জ্যোৎস্নায়। রুদ্রের ক্লান্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ে ঘুম। প্রতি শুক্লপক্ষেই তার জ্যোৎস্নাযাপন। তবে রাত-কুসুমেরা আর তার জন্য সুবাস ছড়ায় না...।’ (গল্প - জ্যোৎস্নাযাপন)।
‘...দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পশ্চিমের রঙিন আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়ে মায়াবী রোদ। রাস্তার মোড়ের বড়ো মাথায় দুটো পাখি। বিশ্বস্ত সঙ্গী তারা। নীড়ে ফেরার তাগাদায় আকাশে উড়ান ভরে। শূন্য হিয়া নিয়ে মিতা সেদিকে তাকিয়ে থাকে...।’ (গল্প - হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে)।
গ্রন্থে রয়েছে যে ১৮টি গল্প তার অধিকাংশেরই সমাপ্তিপর্বে উন্মোচিত হয়েছে যাবতীয় কথা। পূর্বাংশটি সযতনে সাজিয়ে তুলেছেন গল্পকার ভাষায়, কথনে, সংলাপে, সাবধানতায় যাতে খেই হারিয়ে না যায়। পাঠক মনে এক তৃপ্তিসুখের আলোড়ন ওঠা অবশ্যম্ভাবী। অণুগল্পের ক্ষেত্রে বুনোট দীর্ঘায়িত করার সুযোগ নেই। বহু কথাকে কম কথায় প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সময় আবছা ইঙ্গিতই হয়ে ওঠে একমাত্র বিকল্প। সেখানেও সফল গল্পকার।
‘মরমিয়া নৌকো’, ‘আঁখি’, ‘বসন্ত’, ‘দোলনা’ প্রভৃতি একাধিক গল্প পাঠকের হৃদয়তন্ত্রীতে দোলা লাগিয়ে যেতে বাধ্য। দু’একটি গল্পের শেষটায় সাধারণ্যে কিছু অস্পষ্ট ছাপ অনুভূত হতে পারে। ‘বসন্ত’ গল্পে জাটিঙ্গা স্থাননামে ‘ঝাটিঙ্গা’ কেন লেখা হল কিংবা ‘মালি’ গল্পে মালিকে মালী লেখা হয়েছে কেন তা বোঝা যায়নি। স্পষ্ট ছাপা, অক্ষর বিন্যাস, শুদ্ধ বানান গ্রন্থটির অন্যতম সম্পদ। শেষ মলাটে রয়েছে গল্পকারের সচিত্র পরিচিতি। সপ্তর্ষি চ্যাটার্জির প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক হলেও প্রচ্ছদচিত্র ও নামলিপির ‘বর্ণ-বিন্যাস’ সমগোত্রীয় হওয়ায় স্পষ্টতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।
সব মিলিয়ে সুখপঠনের এই অনবদ্য সংকলনটি পড়তে পড়তে যেন আচমকাই শেষ হয়ে যায়। রেশ থেকে যায় যদিও। ফলত বর্ধিত কলেবরে একটি নতুন সংকলনের চাহিদা তৈরি করে দিতে পুরোমাত্রায় সক্ষম হয়েছে গ্রন্থটি।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

দৌড় প্রকাশনা, কলকাতা।
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮১২৯৭৬৪৭৮ 

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...