এক ভিন্নতর আঙ্গিকের গল্প সংকলন ‘শনবিলের ছেলে’। শনবিল দেশের সর্ববৃহৎ বিল হওয়ার সূত্রে উত্তরপূর্ব ভারতের এক গর্ব যদিও প্রচার ও সরকারি স্তরে যথেষ্টই অবহেলার জন্য জনমানসে এর পরিচয় সেভাবে গড়ে ওঠেনি। অথচ এক উল্লেখযোগ্য ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে এই অঞ্চলটির পিছনে। সবই যেন ক্রমশ প্রকাশ্য। শনবিলের জৈববৈচিত্র এবং মনোহর শোভা তাই এখনও উপযুক্ত ভাবে মর্যাদা পায়নি বহিরাঞ্চলে।
আলোচ্য গ্রন্থটি গল্পকার, কবি কল্লোল চৌধুরীর একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস। গ্রন্থটির প্রথম সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের পারমিতা প্রকাশন থেকে ২০১৫ ইংরেজিতে। সম্প্রতি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে এর ‘আজকাল সংস্করণ’। ৭২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ১১টি গল্প। প্রতিটি গল্পেই উঠে এসেছে আঞ্চলিক সমস্যা, ইতিহাস থেকে বাস্তব। গল্পগুলিকে ঠিক কাহিনি বা গল্প না বলে তথ্যসমৃদ্ধ বাস্তব প্রতিবেদন বা নিবন্ধ হিসেবেও নেওয়া যেতে পারে। এসবকেই গল্পের আকারে পরিবেশন করেছেন লেখক। স্বভাবতই এক ভিন্নতর আঙ্গিকের অবতারণা।
প্রথম গল্প ‘হাফলং-এর পাহাড় ও দীপঙ্কর-মিনতি’। উত্তর কাছাড় অর্থাৎ বর্তমান ডিমা হাসাও-এর এক সময়ের উগ্রপন্থী কার্যকলাপের বর্ণনা লেখক গল্পের আঙ্গিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন মনে হবে একটি সত্যকাহিনির উপস্থাপনা। হয়তো সত্যকাহিনিই। কিন্তু যেহেতু গল্প তাই গল্প হিসেবেই উঠে আসবে আলোচনায়। সেই হিসেবে গল্পটি এক দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে, ধরে রাখা হয়েছে সময়কে যদিও আরও বহু বিস্ত্রৃত হতে পারত। বস্তুত প্রথম থেকে শেষ লাইন অবধি শুধু ঘটনার উল্লেখ ও বিস্তার। গল্পের নেই কোনও বাহুল্য, নেই অহেতুক মেদ। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য যেন অপরিহার্য। টানটান এক নিরবচ্ছিন্ন পঠনের গল্প হলেও শেষ হয়েছে তাড়াহুড়োয়। কথা ফুরোতেই মুড়িয়ে গেছে নটেগাছ। জমজমাট ঘটনাক্রম থাকলেও সাহিত্যগুণসম্পন্ন সাজসজ্জা এখানে অনুপস্থিত যা কখনও বাহুল্য মনে হলেও কখনও অপরিহার্যও বটে। খাবার যেমন সুস্বাদু হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। শুধু এই গল্পে নয় প্রায় প্রতিটি গল্পেই এই আঙ্গিক বজায় থেকেছে। বলা যেতে পারে লেখক ইচ্ছে করেই কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হয়তো ঘটনা, বিষয়, প্রেক্ষাপটকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করার মানসে বেছে নিয়েছেন এই সটান, সপাট আঙ্গিক।
দ্বিতীয় গল্প ‘মিছিল’। প্রেক্ষাপট ত্রিপুরার তৎকালীন উগ্রপন্থা, বামপন্থা। গোগ্রাসে গিলতে হয় গল্প। এগিয়েছে তরতরিয়ে, তবে সেই সপাট আঙ্গিক বজায় থেকেছে পূর্ণমাত্রায়। পরের গল্প ‘ঘাড়মুড়া-ভৈরবী ফরেস্ট রেঞ্জের কথকতা’। বরাক উপত্যকার প্রত্যন্ত একটি অঞ্চলের বনাঞ্চল, তার সৌন্দর্য, গভীরতা, জৈববৈচিত্রের এক অনুপম প্রতিবেদন। উঠে এসেছে উগ্রপন্থা, চোরাশিকার আদির পাশাপাশি বন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও প্রকৃতিপ্রেমের আবহে একটি নিটোল সম্পর্কের গল্পও। এটিও প্রসারিত হতে পারত অনায়াসে। চতুর্থ গল্প ‘দাঙ্গা’য় বাবরি মসজিদ কাণ্ডের পর উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যেও লেখক এঁকেছেন এক সদ্ভাবের দৃষ্টান্তমূলক ছবি। সংক্ষিপ্ত গল্প হলেও তার আবেদন বিশাল। পঞ্চম গল্প ‘ক্যানভাস’। ভিন্ন স্বাদের অসাধারণ একটি কাহিনি। এখানে নান্দনিকতা আছে। আছে প্রেম, ভালোবাসা, সংসার যাপনের কথা। পরের গল্প ‘হিতৈষিণী’। সংসার সমরাঙ্গনে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প। অলৌকিক ভাবে এক হিতৈষিণীর আগমনে মোড় ঘুরেছে গল্পের। মন-মানসিকতার নিটোল চিত্র এঁকেছেন গল্পকার।
সপ্তম গল্প ‘ভোটপর্ব’। ভোট নামক গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের পিছনে ভোটকর্মীদের অসহায় অংশগ্রহণ তথা অগণতান্ত্রিক ও অসদুপায়ে স্বার্থান্বেষী জনগণের ভোট বানচালের কুকর্মের খতিয়ান। গল্প এখানেও এগিয়েছে সপাট। পরের গল্প ‘জংলী হাতি’তে ব্যতিক্রমী বিষয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে হাতি-মানুষের সংঘাত ও তার মোকাবিলার বৃত্তান্ত। গল্পের বুনোট জমাট। নবম গল্প ‘অমলকান্তির মেকানিজম’। বিচিত্র মানুষের মুখ ও মুখোশের গল্প। এরকম সাধারণ প্রেক্ষাপটেও যে লুকিয়ে থাকে অসাধারণ গল্পের উপাদান তা আহরণ করে দেখিয়েছেন গল্পকার। দশম গল্প ‘মাছওয়ালা’। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও প্রান্তজনের বংশানুক্রমিক দুর্দশার গল্প। সংলাপে, বুনোটে জমে উঠেছে গল্পের চলন। শেষ গল্প ‘শনবিলের ছেলে’। এই গল্পে লেখক নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। ইতিহাস থেকে বর্তমান সবই উঠে এসেছে গল্পে। একাধারে একটি গল্প এবং একটি সংগ্রহযোগ্য খতিয়ান।
বলা যায় সব ভালো যার শেষ ভালো। গৌতম কুণ্ডুর প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ভেতরের ছাপা, অক্ষর বিন্যাস সবই যথাযথ। জ্যাকেট কভারের প্রথম ব্লার্বে সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ পরিচিতি এবং শেষ প্রচ্ছদে নিয়মমাফিক রয়েছে লেখকের সচিত্র পরিচিতি। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ ও গল্পকার রণবীর পুরকায়স্থকে। সব মিলিয়ে এক সংগ্রহযোগ্য সংকলন ‘শনবিলের ছেলে’।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
মূল্য - ২০০ টাকাযোগাযোগ - ৯৮৫৯৫২৮৭৯৮
Comments
Post a Comment