Skip to main content

সুচয়িত সম্ভারে পরিপূর্ণ বিষয়ভিত্তিক পত্রিকা 'সেবা', ৩১/৩২ যুগ্ম সংখ্যা


একটি ষাণ্মাসিক পত্রিকার যখন যুগ্ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় তখন এর মানে দাঁড়ায় বছরে একটি মাত্র সংখ্যা। নিয়মিত পাঠকের অপেক্ষা সেক্ষেত্রে দীর্ঘ হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন একটিই সংখ্যা এমন উৎকর্ষে, ধারে ও ভারে সেজে ওঠে তখন সবুরে মেওয়া ফলে পাঠকের। প্রতীক্ষার প্রহর শেষে পুষিয়ে যায় কড়ায় গণ্ডায়। সাবেক করিমগঞ্জ, বর্তমান শ্রীভূমির ‘সেবা - এ হেল্প আজেড গ্রুপ’ থেকে প্রকাশিত - বরিষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি নিবেদিত পত্রিকা ‘সেবা’র ষষ্ঠদশ বর্ষ, ৩১/৩২তম যুগ্ম সংখ্যা (অক্টোবর, ২০২৪ইং) প্রকাশিত হয়েছে খানিক বিলম্বে যদিও আগেই বলা মতো এমন একটি সংখ্যা হাতে পেতে প্রতীক্ষা দীর্ঘ হলেও ক্ষতি নেই পাঠকের।
১৩২ পৃষ্ঠার পরিমার্জিত এ-৪ সাইজের ঢাউস পত্রিকা একাধারে একটি জার্নাল এবং সাহিত্য পত্রিকা। উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা পরিচালিত বৃদ্ধাবাস ‘বেলাভূমি’র পরিচালক তথা পত্রিকার সম্পাদক অপর্ণা দেব তাঁর দুই পৃষ্ঠাজোড়া সম্পাদকীয়ের প্রথম পৃষ্ঠাটি সাদা রেখেছেন ‘আর জি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসক মৌমিতার অকাল প্রয়াণে একরাশ যন্ত্রণা, হাহাকার শুধু... শোক...’ প্রকাশ করে। পরবর্তী পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘বেলাভূমি’ ও ‘সেবা’ বিষয়ক তথ্যাদি।
লেখালেখির শুরু মৃন্ময় দেব-এর একটি চমৎকার নিবন্ধ - ‘বৃদ্ধাশ্রম : ছিন্ন চিন্তা ভিন্ন স্বর’ দিয়ে। বৃদ্ধাবস্থা, বৃদ্ধাশ্রম, একাকিত্ব নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধে উঠে এসেছে নানা চিন্তা ও সুর। রয়েছে সুস্পষ্ট কিছু নিদান ও ভাবনা। একই চিন্তাধারা ও বিষয় নিয়ে ধর্মানন্দ দেব-এর নিবন্ধ ‘প্রবীণ নাগরিকদের সমস্যার দিকে সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন’ও সমান প্রাসঙ্গিক। নিদান হিসেবেই বলা চলে সঞ্জয় গুপ্তের মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন ‘কেয়ার গিভার’ যেখানে আছে অনবদ্য একটি মোক্ষম কথা - ‘ছোট গাছ স্থানত্যাগ করালে হয়তো বাঁচে, কিন্তু বড় গাছ উপড়ে নিয়ে গেলে শেকড় ছাড়া বাঁচে না।’ একজন লেখক, শিল্পীর স্মৃতিকথামূলক নান্দনিক আত্মকথা লিখেছেন সোমশুভ্র দাস। স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ লিখেছেন কমলেশ ভট্টাচার্য, ভূপতিকুমার দে-ও। অশোকানন্দ রায়বর্ধনের ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্মভিটে ও তিতাস ভ্রমণ’ তিতাস পারের সাহিত্য অনুষ্ঠান উপলক্ষে এক হৃদয়ছোঁয়া প্রতিবেদন। ‘বাগনানের মা’ মাধুরী ঘোষ ও ‘অগ্নিকন্যা’ শোভা ছেত্রীকে নিয়ে লেখা এক অনবদ্য সাহিত্যকর্ম ড. শিবশঙ্কর পালের ‘সমতলমাধুরী : পাহাড়িশোভা’। গুণী মহিলা, বর্ষীয়ান ‘বিনুদি’র সান্নিধ্যে যাপিত দিনের হার্দিক স্মৃতিচারণ শুভ্রা গাঙ্গুলি ভট্টাচার্যের ‘নয়নতারা, আমার বিনু-দি’। বহু কথা, বহু তথ্যসম্বলিত মিশর ভ্রমণের সংক্ষিপ্ত অথচ অনবদ্য ভ্রমণ কাহিনি অলোক দত্তের ‘মৃত্যু পরবর্তী জীবনের গল্প’। ব্যতিক্রমী লিখনশৈলী। মৃন্ময় রায়ের নান্দনিক প্রতিবেদন - ‘শতবর্ষে রক্তকরবী এবং আমরা’। সুস্পষ্ট গরজ ও ব্যতিক্রমী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে নিবন্ধে। অপর্ণা দেব-এর ‘হ্যালুসিনেশন’ বিষয়ভিত্তিক এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। বৃদ্ধাশ্রম ও বেলাভূমি নিয়ে দুটি প্রতিবেদন লিখেছেন গৌরী দত্ত কানুনগো ও সুদীপা দাস। কুমার অজিত দত্তের ‘সহিস’, শ্যামল ভট্টাচার্যের ‘অন্য বাঘের সাঁতার’, মৃদুলকান্তি দে, বিল্লাল হুসেন, সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল বৈদ্য, অমিতাভ সেনগুপ্ত, সুচেতনা মুখোপাধ্যায়, কমল বসু, শিবানী ভট্টাচার্য দে, কেকা বসুদেব, রীতা সাধুখাঁ, কল্যাণ সেনগুপ্ত - বিষয়ে বৈচিত্রে শৈলীতে সবার গল্পই পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। তপন মহন্তর অনুবাদ গল্পও সুপাঠ্য। সহজ অনুবাদ। আবেগিক প্রকাশের অনুগল্প লিখেছেন শর্মিলা দত্ত। ‘জেনারেশন গ্যাপ’ অসাধারণ একটি গল্প, কিন্তু লেখকের নাম নেই। সম্ভবত সংগৃহীত। ভাষা শহিদ দিবস উনিশে মে’র আবেগ নিয়ে বেলাভূমির আবাসিকদের সঙ্গে আলাপচারিতার অনুলিখন করেছেন সজল পাল। সংখ্যাটির অন্যতম বিশেষ রচনা।
নানা স্বাদের কবিতা রয়েছে একগুচ্ছ। লিখেছেন তুষ্টি ভট্টাচার্য, অরিন্দম দাস, অজয় সান্যাল, কালিকৃষ্ণ গুহ, সুদর্শন নন্দী, অশোক দেব, পারিজাত সাগর, দিলীপকান্তি লস্কর, শরদিন্দু চক্রবর্তী, প্রাণকৃষ্ণ কর, মৃণাল কান্তি ভট্টাচার্য, বিজন বোস, বিজয়া দেব, অতনু বর্মন, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, কাবেরী গোস্বামী, সুজাতা রায়, তৃণময় সেন, সুদীপ কুমার মন্ডল ও রণজিৎ কুমার দেব। প্রতিটি কবিতাই যেন জীবনকে ফিরে দেখা, বয়সের যাপনকথা।
স্বাধীনতা সংগ্রামী বীণা দাসের উপর একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন শুভেন্দু মজুমদারের ‘পেনশন-প্রার্থী’। বৃদ্ধাশ্রমে নিজের মতো করে বাঁচার এক আবেগিক প্রতিবেদন ‘বৃদ্ধাশ্রম থেকে এক মায়ের ভালো লাগার কিছু কথা’। এখানেও লেখকের নাম নেই। আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে সংগৃহীত প্রখ্যাত লেখিকা নবনীতা দেবসেন-এর গল্প ‘সুটকেস’ সংখ্যাটির মর্যাদা বাড়িয়েছে। অরুণাভ সেন সংকলিত ‘কিংবদন্তি শিল্পী - যূথিকা রায়’ এক সংক্ষিপ্ত অথচ নান্দনিক প্রতিবেদন।
প্রচ্ছদ থেকে ভেতরের লেখালেখির মান উৎকৃষ্ট। সম্পাদকের গরজ ও অধ্যবসায়ের ছাপ স্পষ্ট। বানানের শুদ্ধতা, সুচয়িত ফুটনোট মান বৃদ্ধি করেছে পত্রিকার। একাধিক পৃষ্ঠায় বিস্তৃত কিছু রচনার পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখে ত্রুটি ধরা পড়েছে। প্রতিটি রচনার শুরুতে কবি, লেখকদের ছবি ও স্থাননামের উল্লেখ এক সুচিন্তিত সংযোজন। মানস ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদ ব্যতিক্রমী, প্রাসঙ্গিক। সব মিলিয়ে বরিষ্ঠ নাগরিকদের উদ্দেশে নিবেদিত একটি উন্নত মানের পত্রিকা সংখ্যা - ‘সেবা’ ৩১/৩২তম সংখ্যা।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫৫৯৬৭২৩

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...