Skip to main content

আমারই অজান্তে নদীরা বাঁক নিয়ে যায় গোপনে... ‘পোড়া অক্ষর দিল ডানা’


উত্তরপূর্বের এবং বিশেষ করে বরাকের সমকালীন কবিতাভুবনে যে কয়েকজন কবি তাঁদের কাব্যপ্রতিভায় নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সুদীপ ভট্টাচার্য অন্যতম। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোড়া অক্ষর দিল ডানা’। ব্যতিক্রমটা যে গ্রন্থনামেই বিদ্যমান তা অনুধাবন করা যায় সহজেই। সুদীপের কবিতা নিয়ে লেখক সম্পাদক নারায়ণ মোদক তাঁর শুভেচ্ছা বার্তায় লিখছেন - ‘…প্রচণ্ড দাবদাহে চৌচির মৃত্তিকায় হঠাৎ বায়ুকোণে যে ঝড়ের আভাস, ছিটেফোঁটা বৃষ্টি সিক্ত করছে সাহিত্যের অঙ্গন তাদের মধ্যে সুদীপ ভট্টাচার্য অন্যতম। ...সুদীপের সৃষ্ট পঙ্‌ক্তি কালের স্রোতে ভেসে যাবার মতো নয়। কালের গতি রোধ করে হৃদয় জুড়ে তার উপস্থিতি বর্তমানে যেমন আছে তেমনি ভবিষ্যতের গর্ভেও তা স্থায়ীভাবে প্রস্ফুটিত হবে - এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস...।’
সুদীপের কবিতা কেমন ? বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক সুমন গুণ তাঁর আলোচনায় লিখছেন - ‘...মন্দ্র সরলতা সুদীপ ভট্টাচার্যের কবিতার সম্পদ ...কথার মধ্যে তির্যক কোনও আহ্বান প্রশ্রয় দেন না তিনি। চিত্ররূপময় জীবনের জন্য তাঁর আসক্তি আছে, আরাধনাময় আমন্ত্রণ আছে...। বিভ্রান্ত সময়েও তিনি বিশ্বাস রাখেন শুদ্ধতায়, নির্মলতায়...।’ - এইসব নিখাদ নান্দনিক বয়ানের সূত্র ধরে এগোলে আমরা দেখি ৮০ পৃষ্ঠার আলোচ্য গ্রন্থে কবি সন্নিবিষ্ট করেছেন শব্দসুষমায় মন্দ্রিত মোট ৫৪টি কবিতা - বিচিত্র অনুভবের ধারায়, বিষয় বৈচিত্রে আলোকোজ্জ্বল। স্বভাবতই বহু কবিতা বিস্তৃত হয়েছে একাধিক পৃষ্ঠায়। এতসব কথার মধ্যেও যে কথাটি উচ্চারিত হয়নি তা হল সুদীপের কবিতায় উপস্থাপিত দৃশ্য ও অদৃশ্য ছন্দের উপস্থিতি। এবং ছন্দকবিতাসমূহে ছন্দের যথাযথ প্রয়োগ স্বাভাবিক অর্থেই কবিতাকে দিয়েছে এক অনবদ্য পঠনসুখ। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় -
...কিছু কিছু চোখ লুকিয়ে থাকে
পদ্ম পাতায় নিবাস
অচেনা শহরে বালক খুঁজে
শিউলি ফুলের সুবাস...। (প্রথম কবিতা - মৃগনাভি)
...বুকের লালনে লালনের গান, এপারে এগারো জন
আরো কত প্রাণ দিতে হবে বলো মাতৃমুক্তি পণ...। (কবিতা - অক্ষরে কৃষ্ণচূড়া)।
এমনিভাবে ‘হাওয়া মহল’, ‘এবার একটু হও তো দেশী’, ‘মৌচাক’, ‘ইশারা’, ‘বৃষ্টি আসেনি’, ‘সাদাকালো’ ইত্যাদি কবিতায়ও ছন্দকে হাতিয়ার করে স্বচ্ছন্দে এগিয়েছেন কবি। প্রেম ভালোবাসা, প্রকৃতি, উনিশ, দেশভাগের বেদনা, বাস্তব, মৃত্যু ইত্যাদি যাবতীয় অনুষঙ্গ যেন কাব্যগুণে ভাস্বর হয়ে উঠেছে একের পর এক কবিতায়। কবিতাকে মননে লালন করেন কবি। তাই আত্মচিন্তনে, মননে, লেখনীতে সৃষ্টি হয় একের পর এক অমোঘ শব্দমঞ্জরী। একাধিক কবিতায় তার আভাস -
...খিদে পায়নি কতকাল,
কতকাল ঝড়ে উড়ে যাওয়া ছাউনি দেখিনি।
কুশিয়ারার জল আজও বড় শান্ত,
কত নীড়ের ছবি তার গহিন।
অথচ জলের ভিতরে কত জল,
ঘটে যাওয়া কত মহাপ্রলয়...। (কবিতা - প্রবাসীর আত্মকথা)
গ্রন্থের যে কবিতাগুলিকে বিশেষোল্লেখে রাখতে হয় তার তালিকা দীর্ঘ। তাই এর উল্লেখে সায় দেয় না পরিসর। তবু বাছতে হলে শ্রেষ্ঠ কবিতা যদি বাছতেই হয় তাহলে সেই কবিতা - ‘বুদ্ধ চলেছেন’। কিছু পঙ্‌ক্তি -
...এমন সময়ে কে আর দাঁড়াবে বলো পাশে বুদ্ধ ছাড়া ?
আমার ভালোবাসার শহর মননে দহনে রাত্রি জাগে পাড়া।
বুদ্ধ আসবেন, নির্বাণ, নীলপদ্ম দেবেন, চোখ দেবেন মানুষে
গাছের পাশে গাছ দাঁড়িয়ে আছে দেখে মানুষেরাও ভাববে।
এসব সবই বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়
যদিও অসম্ভব জানি,
আমার কবিতার চেয়ে মানুষের প্রেম যেন
বড় স্থায়ী হয়।
একাধিক গদ্য কবিতায়ও কবি তার মুনশিয়ানা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু কবিতার পঙ্‌ক্তিবিন্যাসে অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভূত হয়েছে। অজয় দাসের প্রচ্ছদ প্রতীকী হলেও বড়ই ছিমছাম। কবির প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদে এত ‘সাদা’ কেন এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘মা-কে’। পাকা বাঁধাইয়ের মলাটের ভিতর কোনো ব্লার্ব নেই যদিও শেষ পৃষ্ঠায় রয়েছে কবি-পরিচিতি। স্পষ্ট ছাপা, যথাযথ বর্ণ সংস্থাপন। কবিতায় নির্ভুল বানান গ্রন্থটির মর্যাদা বাড়িয়েছে যদিও প্রথম পৃষ্ঠা (শুভেচ্ছা বার্তা)র প্রথম লাইনেই দুদুটি বানান ভুল দৃষ্টিকটু হয়েছে। কবিতায় যতিচিহ্নের ব্যবহার অধিক প্রতীয়মান হয়েছে। এর বাইরে প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে সুদীপ তার কাব্যমেধার যে পরিচয় রাখতে সমর্থ হয়েছেন তা অনস্বীকার্য।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - স্কলার পাবলিকেশন, শ্রীভূমি
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৯৫৭৬৭১৫৪৬

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...