Skip to main content

ছোটদের অবশ্য-পাঠ্য সংকলন - ‘আমার অসম’


একটি ভিন্নধর্মী পুস্তক ‘আমার অসম’। শেষ প্রচ্ছদে লেখক পরিচিতির সূত্র ধরে জানা যায় তাঁর ‘শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বরাক উপত্যকার বড়থল চা বাগানে। চা পাতার সুবাস আর মুক্ত প্রকৃতির হাওয়ায় বেড়ে ওঠা শ্রাবণী (শ্রাবণী গঙ্গোপাধ্যায়)...ভালোবাসেন ছোটদের জন্য লিখতে...।’ ইতোমধ্যেই তাঁর দুটি গল্প সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে যা ছোটদের জন্য লেখা। গ্রন্থ পরিচিতি লিখতে গিয়ে লেখক পরিচিতি কেন পড়তে হল সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আর এজন্যই প্রথমে লেখা হয়েছে যে আলোচ্য গ্রন্থটি একটি ভিন্নধর্মী গ্রন্থ। ব্যতিক্রমী এজন্যই যে একটি রাজ্যের বিভিন্ন ইতিহাসাশ্রিত বিষয় নিয়ে স্বল্প পরিসরের নিবন্ধ সাধারণত পাঠ্য পুস্তক কিংবা ছোটদের জন্যই লেখা হয়ে থাকে।
আলোচ্য গ্রন্থে ‘পাঠ্য পুস্তক’ বা ‘ছোটদের জন্য’ লেখা না থাকলেও পাঠশেষে এমনই একটা ধারণা জন্মাতে বাধ্য। যেহেতু পাঠ্য পুস্তক বলে উল্লেখ নেই তাই ধরেই নেওয়া যেতে পারে যে এটা লেখকের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত অনুভব ও জন্মস্থান, জন্মরাজ্যের প্রতি গরজ ও দায়বদ্ধতার খাতিরে ছোটদের জন্যই লেখা একটি গ্রন্থ যা নিশ্চিতভাবে উৎসাহ প্রদান করবে ছোটদের। বর্তমানকে জানতে নিজের জন্ম বা বাসস্থানের ইতিহাস জানা একদিকে যেমন অবশ্যম্ভাবী অন্যদিকে আকর্ষণীয়ও।
৬৭ পৃষ্ঠার এই বইয়ে রয়েছে মোট ১২টি অধ্যায়। ইতিহাসের আবহে ফিরে দেখা সব বর্ণনা ও তথ্য যা জানা সবারই প্রয়োজন। এবং এমনটাই লিখেছেন লেখক তাঁর বিস্তৃত ভূমিকায় - ‘...একটি দেশ কিংবা রাজ্যের আসল রূপ ফুটে ওঠে তার ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, সেই জায়গার সঙ্গে জড়িত ইতিহাস, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে। দেশ বা রাজ্য শুধু একটি সীমানা নয়। একটি অঞ্চলকে জানতে হলে এই সমস্ত বিষয়গুলিকে নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে। ...এই বই-এ ইতিহাসের টুকরো টুকরো গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়, ইতিহাসের প্রতি ছোট ছোট পড়ুয়াদের আগ্রহ জন্মানোই আমার উদ্দেশ্য...।’ সুতরাং উল্লেখ করা মতো আলোচ্য পুস্তক বা গ্রন্থটি যে ছোটদের জন্যই লিখিত সেটা নিশ্চিত।
প্রথম অধ্যায় - ইতিহাসে অসম। অসম নামের যাথার্থ্য, আহোম, মান ও ইংরেজের আগমন অবধি এই রাজ্যের ইতিহাস সংক্ষেপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই অধ্যায়ে। দ্বিতীয় নিবন্ধ - ‘বরাক-ব্রহ্মপুত্রপারের হয়ে ওঠার গল্প’তে উভয় উপত্যকার এক সার্বিক রূপরেখা তুলে ধরার প্রয়াস করা হয়েছে। এক বিশাল সময়কে এতটা সংক্ষেপে বর্ণনা করা খুবই দুরূহ। স্বভাবতই কিছু কথা, কিছু তথ্যের পুনরুল্লেখ হয়েছে। তবু বলা যায় এক অদম্য প্রয়াস। বহু তথ্যাদির সমন্বয়ে ইতিহাসের এক বিশাল কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরা হয়েছে বহু যত্ন সহকারে। তৃতীয় অধ্যায় ‘জঙ্গিয়ার গীত’। এক স্বল্পালোচিত বিষয়কে যতটা সম্ভব তথ্যাদির আলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। অনেকের কাছে, বিশেষ করে উঠতি প্রজন্মের কাছে এক নতুন শব্দ হিসেবে উঠে আসতে পারে এই জঙ্গিয়ার গীত। নিমগ্ন পঠনে এক স্বল্পাবিষ্কৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ তথা আকর্ষণীয় বিষয় সম্বন্ধে সবার কাছে নিশ্চিতই গ্রহণযোগ্য হবে এই জঙ্গিয়ার গীত। পরবর্তী দুটি অধ্যায় ‘তেলের অসম’ ও ‘চা-এর ইতিকথা’য় অসমের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ তেল ও চা-এর বিস্তৃত ইতিহাস যতটুকু সংক্ষেপে পারা যায় তাই করেছেন লেখক। বহু কথা, বহু তথ্য ছোটদের কাছে যে অত্যন্ত শিক্ষণীয় তা অনস্বীকার্য। পরবর্তী দুটি অধ্যায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চা শ্রমিকরা’ ও ‘চরগোলা এক্সোডাস’ অসমের চা-শিল্পের, চা বাগানের ইতিহাসে খুবই উল্লেখযোগ্য। চা শ্রমিকদের দুর্দশা, বিদ্রোহ ও জীবন সংগ্রামের হৃদয় বিদারক ইতিহাস। উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহের উল্লেখে অধ্যায়গুলি হয়ে উঠেছে সবার কাছেই অবশ্যপাঠ্য।
অষ্টম, নবম ও দশম অধ্যায় যথাক্রমে ‘অগ্নিযুগের গল্পগাথা’, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ব্রহ্মপুত্রপারের ছাত্ররা’ এবং ‘স্বাধীনতা আন্দোলনে বরাকের পড়ুয়ারা’ শিরোনামভিত্তিক নিবন্ধ যেখানে স্বাধীনতার আন্দোলনে দুই উপত্যকার সার্বিক যোগদান বিষয়ে বহু তথ্যের অবতারণা করা হয়েছে যা একান্তই জানা প্রয়োজন। ঘটনা, দুর্ঘটনার বয়ানে পাঠের চাহিদা হয়ে ওঠে দুর্নিবার। পরবর্তী দুটি নিবন্ধ ‘স্বাধীনতা আন্দোলন ও অসম : নেতাজি সুভাষের অবদান’ এবং ‘স্বাধীনতা আন্দোলনে চন্দবাড়ি এবং শহর শিলচর’ একইভাবে শিরোনাম অনুযায়ী একান্ত পাঠ্য দুটি রচনা। এখানেও পরিসরের স্বল্পতা লেখককে বিস্তৃত বর্ণনের সুযোগ দেয়নি। তবু বলা যায় ছোটদের যতটুকু জানা প্রয়োজন তার সবটুকুই রয়েছে।
কিছু পুনরুল্লেখ, কিছু বানান ও ছাপার বিসঙ্গতি রয়ে গেছে গ্রন্থ জুড়ে। ছাপার স্পষ্টতা থাকলেও অক্ষরের আকার, বর্ণ সংস্থাপনে সামঞ্জস্য বজায় থাকেনি। পেপারব্যাক সংস্করণটির প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক। ভাবনা ও অলংকরণে উজ্জ্বলেন্দু দাস ও মান্না দেব। প্রচ্ছদ ছবির সৌজন্যে জ্যোতি চৌবে। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর বাবা ‘দীপক কুমার দেবরায়কে’। সব মিলিয়ে ছোটদের জন্য নিশ্চিতই একটি উপযোগী সংকলন যা অনায়াসেই অন্তর্ভুক্ত হতে পারে পাঠক্রমে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

লেখক, প্রকাশক - শ্রাবণী গঙ্গোপাধ্যায়
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৫৯৯৯৭৩৩৪১ 

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...