Skip to main content

ইচ্ছে করে আকাশটাকে লাঙল দিয়ে টুকরো করে কাটি… কবিতায় অনুভূতির - ‘স্ফুলিঙ্গ’


স্ফুলিঙ্গ শুধু আতসবাজিতে কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রেই দেখা যায় না, শব্দের ফুলকিতে সাহিত্যসম্ভার জুড়ে  এমন স্ফুলিঙ্গের উপস্থিতি যুগ থেকে যুগান্তরে বিশেষভাবে প্রতীয়মান। প্রত্যেক কবিরই লিখনশৈলী তথা কবিতার সার্বিক ধাঁচটি স্বতন্ত্র। বিষয় নির্বাচনেও সবার আলাদা একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কবি সুপ্রদীপ দত্তরায়ও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর কবিতায় দ্রোহ, শ্লেষ, প্রতিবাদ, বিরুদ্ধবাদিতা আকছার ফুটে ওঠে স্ফুলিঙ্গের মতো। সমাজকে আতসকাচে পর্যবেক্ষণ করে তার ভিতর থেকে সরাসরি কাঠগড়ায় তুলে আনেন যাবতীয় অনাচার, অনিয়ম, অন্যায়, অন্ধ বিশ্বাস ও অসংখ্য প্রহসন। তাঁর কবিতার ধাঁচ সচরাচর দীর্ঘ।
এসব কিছুকেই সম্বল করে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবির কাব্যগ্রন্থ ‘স্ফুলিঙ্গ’। বস্তুত আলোচ্য এই গ্রন্থটির অধিকাংশ কবিতাই এমনধারা, স্ফুলিঙ্গসম। ৬৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে ৪৮টি কবিতা। এই ধারা কিংবা ধাঁচের বিপরীতে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রেম-ভালোবাসাবিষয়ক কবিতা যা পাঠককে নিশ্চিতই পরিচিত করিয়ে দেবে এক অন্য সুপ্রদীপকে।
গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম ‘ঈশ্বর’, যার শেষ কয়েকটি পঙ্‌ক্তি উপর্যুক্ত বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করে যথার্থ রূপে -
‘...যদি কোনোভাবে শিকড়ের সন্ধান পেয়ে যায় জীব -
আমি জানি হে শিব, তোমারই সমূহ বিপদ
স্তব্ধ হবে পুতুল পুতুল খেলা -
মুখোশ খুলে যাবে তোমার -
আমি নিশ্চিত, হে স্বঘোষিত ঈশ্বর।’
একাধারে দ্ব্যর্থক, সাহসী এবং সপাট বিদ্রোহ। অধিকাংশ কবিতাই এমন। মুখোশ খুলে দেওয়ার খেলায় মেতেছেন কবি। এতে কাব্যিকতার সঙ্গে সমঝোতা করতে হলেও ‘কুছ পরোয়া নেহি’।
আবার প্রেম, প্রকৃতি, ঋতুরঙ্গে কাব্যময়তা এসেছে আপন ছন্দে -
‘আকাশের মেঘ চাঁদ তারা আর পাখি -/ অনেক লিখেছি, ওরা কল্পনায় ফাঁকির গল্প সব।/ তোমার চোখে তারা, গালে টোল, ঠোঁটে কামড়, / কবিতার মতো রহস্যময়ী চলা -/ এবার কবিতা লিখতে উত্যক্ত করছে আমায়…।’ (কবিতা - ‘তোমাকে’)
গ্রন্থে রয়েছে ‘কবি’ ও ‘কবিতা’ বিষয়ক একাধিক কবিতা। কবিতাকে কবি দেখেছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে -
‘একটি কবিতার জন্ম দিতে/ অসংখ্য শব্দের টানাপোড়েন -/ শব্দের পর শব্দ খুঁজে খুঁজে/ ক্লান্ত মসী ধুঁকতে থাকে যখন,/ মন্ত্রবলে ধূমকেতুর মতো/ শন্দ এসে হাজির…। (কবিতা - সন্তান)
‘দুর্বোধ্য’ নামের কবিতায় কবির কবিতা-ভাবনা প্রস্ফুটিত হয়েছে বিচিত্র অনুষঙ্গে, অভাবিত বিশ্লেষণে - ‘আমি আসলে ঠিক কবিতা বুঝি না।/ কিছু কবিতা আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে,/ কিছু জলের মতো, ভিজে ছপছপ।/ কিছু যেন শোনা মাত্রই রক্ত টগবগ করে,/ আবার কিছু কবিতা রসে টইটম্বুর…।’
কবি ও কবিতাকে নিয়ে, কবিতার অনুষঙ্গে কবি সুপ্রদীপ লিখেছেন অনেকগুলি কবিতা - ‘তোমাকে’, ‘আক্ষেপ’, ‘কবি’, ‘কবি তোমাকে নয়’, ‘কবিতা’, ‘ক্লীব’, ‘কথা দিলাম’ ইত্যাদি। তবে সুপ্রদীপের কবিতায় জীবনবোধের পাশাপাশি অনিয়মের বিরুদ্ধে শ্লেষ ও বিরোধই শেষ কথা। আলোচ্য গ্রন্থটিতে একাধিক উদাহরণ রয়েছে তার।
আসলে নানা বিষয়ে অসংখ্য শব্দমালা, অসংখ্য পঙ্ক্তিসমূহ রচিত হয়েছে যে সব উদ্ধৃত করার পরিসর বহু বিস্তৃত হওয়া চাই। তবু কিছু বিশেষ কবিতার শিরোনামের উল্লেখ এখানে দায়িত্ব নিয়েই করাটা বাঞ্ছনীয় - ‘আক্ষেপ’, ‘নির্বাসন’, ‘ঈশ্বরীয় কথা’, ‘বিবেক’, ‘আমার না বলা কথা’, ‘বিসর্জন’, ‘কবি’, ‘ছেলে’, ‘মাধুরী’, ‘শব’ ইত্যাদি। পরিশেষে কবিমনের যাবতীয় ক্ষোভ, হতাশা, বিরোধকে এক পাশে সরিয়ে রেখে কিছু অনাবিল ভাবনাকে সঙ্গে করেই নাহয় যবনিকা টানা হোক এই আলোচনার -
‘তোমার বিষণ্ণতা তোমাকে
গভীর অরণ্যে নিয়ে যায়।
শাল আর সেগুনের শুকনো পাতার মতো
তোমার স্বপ্নগুলো মর্মর ধ্বনি তুলে।
তোমার চোখের কোণে জল,
ভেতরে কালবৈশাখীর আভাস।
তুমি যত সুন্দরী হও,
ফোঁটা ফোঁটা মানিকগুলো তোমাকে
আরও বেশি আকর্ষণীয়া করে।
মনের মধ্যে ইচ্ছেনদী বয়,
আমি তো পুরুষ, ভয় হয়, যদি ভুল হয়ে যায়…!’ (কবিতা - অনুরোধ)
হার্ড বোর্ড বাঁধাইয়ের ভেতর স্পষ্ট ছাপা, বড় আকারের ফন্ট পাঠকবান্ধব বলা যেতে পারে। প্রকাশক নীরব আলো প্রকাশনের সব বইই এমন। মনোজুল ইসলামের প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক। বেশ কিছু বানান রয়ে গেছে পুরোনো রূপে। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘মাতা সুপ্রীতি দত্তরায়-কে’। সব মিলিয়ে একাধারে দুঃখ-সুখের অনুভূতিমিশ্রিত কবিতার সম্ভার এবং সুখপাঠ্য কবিতার সমাহার - ‘স্ফুলিঙ্গ’।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ১৭০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫১৭৩২৭৩

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...