Skip to main content

কবিতার লিগ্যাসি - তপন মহন্ত-র ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’

কবিতার লিগ্যাসি - তপন মহন্ত-স্বনির্বাচিত কবিতা

জীবন বোধের এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন যে কবিতার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যায় চরাচরে, আধুনিক কবিতা মানেই যে শুধু কিছু অবোধ্য স্বগতোক্তি নয়, কবিতারও যে একটা নিজস্ব ধারা, স্বাতন্ত্র্য কিংবা আধুনিক কালের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বলা যায় একটা লিগ্যাসি আছে সেটাই কবিতার স্বচ্ছতোয়া ফল্গুধারায় একেবারে স্পষ্ট করে তুলে ধরলেন কবি তপন মহন্ত - তাঁর স্বনির্বাচিত কবিতা কাব্যগ্রন্থে

কোনও সলতে পাকানো নেই, ভণিতা নেই সোজাসাপটা প্রবেশ কবিতার অন্দর মহলে অন্তরে বয়ে বেড়ানো দুঃখের বহিঃপ্রকাশ কাব্যগ্রন্থের নিবেদন লিগ্যাসির কবিতায় তীব্র যাতনা, ক্লেশ, মানসিক অত্যাচারের বলি যাঁরা তাঁদেরই ব্যথায় ব্যথিত কবি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করলেন তাঁদেরই - ‘দেশ পেলো না যাঁরা কবির স্বনির্বাচিত কবিতায় স্বভাবতই তাঁর পছন্দের কবিতা সন্নিবিষ্ট হয়ে থেকে ফলে পাঠক যাঁরা তাঁর ইতিমধ্যে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি পড়েছেন তাঁদের পছন্দের সব কবিতা আলোচ্য গ্রন্থে নাও পেতে পারেন সেক্ষেত্রে পাঠক মননে একটা আফসোস থেকে যেতেই পারে কিন্তু তপন মহন্তের এইস্বনির্বাচিত কবিতাকাব্যগ্রন্থে কবি সুচিন্তিত চয়নে অত্যন্ত মুন্সিয়ানায় সন্নিবিষ্ট করেছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সম্ভার বিষয় ভাবনার গভীরতা এবং কবিতার গঠন মাধুর্য উভয়কে উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত সুচারু পারিপাট্যে তাঁর ইতিপূর্বে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থসমূহ থেকে নির্বাচিত করেছেন তাঁরই দৃষ্টিতে বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকা কবিতাগুলো। প্রথম যে কবিতাটি সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে সেই কবিতাটির নাম ‘অশ্রু কথা মিশ্র আলাপে’। একই নামে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ। প্রথম এই কবিতাটির আলোচনা করেই শুধু একাধিক পৃষ্ঠা খরচ করা যায়। কবি এই একটি কবিতাতেই তাঁর যাবতীয় ভাবনাকে মোট ১০টি বিভাগে প্রাঞ্জল ভাবে মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। অনবদ্য কিছু পংক্তির সমাহারে চূড়ান্ত সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে এক নিদারুণ দুঃখগাথা -

উঠোনের এক কোণে দমবন্ধ আঁতুড় ঘরে
আমার জন্ম এক দুর্যোগের রাতে
নিজের নাড়িটি নিজেই কেটেছে মা।
- - - -
পাঠশালায় পাখি-পড়া তৃতীয় ভাষায়
- - -  সামনে করালগ্রাসী মহাবাহু
ঘোলাজলে ফাঁদ পাতে শুধু।
- - - -
মায়ের প্রবাসী বুকে চাঁদের ফসিল
মুখে তাঁর প্রলাপের ভাষা - - - -
শকুনেরা খুলে ধরে লিগ্যাসির ডানা।

মোট ১০৪টি নির্বাচিত কবিতার অধিকাংশই হলো নিপীড়িত মানুষের ভাষাজনিত বিড়ম্বনার বাখান। কবি যে অঞ্চলের বাসিন্দা সেই আসাম রাজ্যের অন্যতম প্রধান ভাষিক গোষ্ঠীর উপর যুগ যুগ ধরে চলে আসা অশনি প্রহারের ঘৃণিত বর্ণন। বৃহত্তম জনগোষ্ঠী তথা সরকারি বদান্যতায় মুহুর্মুহু নেমে আসা অস্তিত্ব সংকটের বেড়াজালে আবদ্ধ অত্যাচারিত মানুষের বেদনায় একদিকে যেমন ব্যথিত কবিমন অন্যদিকে তেমনি তীব্র শ্লেষ ও ব্যঙ্গ, বিদ্রুপে ধরাশায়ী করতে চেয়েছেন কুচক্রী শাসক ও হিংস্র মননের মানবরূপী দানবদের। স্বভাবতই কর্মসূত্রে সরেজমিন অভিজ্ঞতায় পুষ্ট কবির একাধিক কবিতায় ফুটে উঠেছে আন আর সি, ডিটেনশন ক্যাম্প, লিগ্যাসি ডাটার কলঙ্কিত আখ্যান। অসাধারণ ব্যঞ্জনা তথা রূপকের আশ্রয়ে বেড়ে উঠেছে তাঁর দগ্ধ হৃদয়ের বাঙ্ময় কবিতা। তাঁর ‘শিকড়ের কথা’ কবিতায় কবি লিখছেন -

মাটি আর ঘাস খোঁজে পাথরের প্রাণে
মাটি হাসে মিটিমিটি মাটির টবেই
আর দেখে -
স্বদেশের উৎখাত চারাগাছ
কীভাবে শিকড় ছাড়ে প্রবাসের ভূমে
শিউলি ফুলের গাছে নিঝুম দুপুরে
ইষ্টিকুটুম পাখি ডাকে
শুখা ভূমে কোথায় কুটুম
ঝিঁঝির করাত চলে অন্ধকারে।

এমনি - জন্মভূমি, যুদ্ধ, আলোকযাত্রী ইত্যাদি একাধিক কবিতায় কবি সপাট কথার স্পষ্ট উচ্চারণে সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর স্বচ্ছ অভিব্যক্তি। শুধু লিগ্যাসির বিড়ম্বনা নয়, বর্তমানের যাবতীয় সমস্যারাজি নিয়েই কলম ধরেছেন কবি। সামাজিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি কবি মানসিকতার যথার্থ স্ফূরণ ঘটেছে এই কাব্য সংকলনের হাত ধরে। কয়েকটি বিশেষ কবিতার নামোল্লেখ না করলে অসমাপ্ত থেকে যাবে এই আলোচনা। তার মধ্যে রয়েছে আত্মকথা, স্বগত, অগ্নিগড়ে কিছুক্ষণ, আলপনা, বিবমিষা, মেঘ বিষয়ক, ঘোড়া, সংরক্ষণ, অস্থি, পদক, কাকতৃষ্ণা ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচিত কবিতার সংকলন থেকে বিশেষ কবিতা বেছে নেওয়াটা খুবই দুরুহ ব্যাপার। কবিতা এখানে নানা রূপে, নানা অবয়বে উপস্থিত। নদীমাতৃক প্রকৃতি থেকে শুরু করে আত্মকথার অসামান্য বর্ণনা যেমন রয়েছে একই মলাটে তেমনি রয়েছে দীর্ঘ থেকে ক্ষুদ্র অবয়বের পরিসরে ভাবনাবিধুর বাখান।

‘ইচ্ছে’ শিরোনামে আছে একটি অসাধারণ কবিতা। উল্লেখের লোভ সংবরণ করা গেল না।

আমার সমাধি ঢাকা থাকবে না কোনোদিন সফেদ পাথরে
ভাট আর দ্রোণফুল আমাকে সাজিয়ে দেবে বোঁটকা আতরে
ঘুন পোকা কুরে খাবে হাড় থেকে অবশেষে বজ্জাতি শাঁস
পঞ্চভূতে মিশে যাবে মহন্তর পোকা পড়া আনক্লেমড লাশ
ফলন্ত ইচ্ছের ডালে মহার্ঘ এইসব ড্রাইফ্রুট ঝোলে
বুড়ি বেশ্যা চাঁদ শুধু নিশি চুমু দিয়ে যায় ঘোমটার তলে।

চার লাইনের অসাধারণ কিছু অণু কবিতাও সংকলনটিকে করে তুলেছে আরোও আকর্ষণীয়, আরোও গ্রহণযোগ্য। যেমন -

তোমাকে যখন ভেবেছি যমুনা
তখন তুমি লাজুক ঝরনা
যখন তোমায় ঝরনা ভাবি
তখন তুমি দুকুল প্লাবী। (কবিতা - দুকুল প্লাবী)।

কিংবা -

জলে কুমির ডাঙায় বাঘ
তবু আমার জলেই বাস
পদ্মনাভিতে মুখ ডুবিয়ে
আমার ফুটো নৌকা বিলাস। (কবিতা - নৌকা বিলাস) ইত্যাদি।

হাতে গোণা কিছু বানান ভুলের বাইরে সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার দর্পণস্বরূপ এক নিটোল, পরিপাটি এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৯ আগরতলা বইমেলায়। প্রকাশক - নান্দীমুখ প্রকাশনী, আগরতলা, ত্রিপুরা। ছিমছাম প্রচ্ছদ এঁকেছেন পুষ্পল দেব। বর্ণ সংযোজনে পুষ্পিতা সিংহ এবং মুদ্রণে ক্যাসানোভা প্রিণ্টিং, আগরতলা।

মূল্য - ১৫০ টাকা

যোগাযোগ - ৯৪৩৫০৮২৩৯৩

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়