Skip to main content

অভিজিৎ চক্রবর্তীর 'সিলেটি মহাভারত' - এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস




বাংলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় মহাভারত অনুবাদক ছিলেন কবি কাশীরাম দাস। এরপর রয়েছে হরিসিদ্বান্ত তর্কবাগীশ এর ৪৩ খন্ডের মহাভারত। এরপর সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সঞ্জয় ভট্ট নামে আরেকজন মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন। সেটি 'সঞ্জয় ভারত' নামে পরিচিতি পায়। 

তথ্য মতে মহাভারতের প্রথম দুইটি পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ আলাদা আলাদাভাবে তৈরি হয় পঞ্চদশ শতকের শুরুর দিকে। এর মাঝে একটির রচয়িতা সুনামগঞ্জের সঞ্জয় ভট্ট যদিও, কেউ কেউ দাবি করেন সঞ্জয়ই প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা মহাভারত রচনাকার। তবে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা মহাভারত রচনাকার হিসাবে সঞ্জয়ের চাইতে চট্টগ্রামের পরমেশ্বর দাসের দিকে যুক্তির পাল্লা বেশি ভারি। হিসাবমতে ‘পরাগলি মহাভারত’ নামে পরিচিত পরমেশ্বর দাসের ‘পাণ্ডববিজয় কাব্য’ ‘সঞ্জয় ভারতের’ প্রায় ত্রিশ বছর আগে লেখা।

মহাভারতের আরেকটি সংস্করণ সিলেটি ভাষাতেই রচিত হয়েছে এই করোনাকালে। বিধুভূষণ ভট্টাচার্যের সিলেটি মহাভারত।

“মহাভারত কথার প্যাচ/আমির্তির লাখান

বিধুভূষণ ভটে কইরাম/সিলেটি বাখান”

জানা মতে এতদিন এটাই ছিল মহাভারতের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পূর্ণ সংস্করণ। সিলেটি ‘ছিলক’ বা ‘শিলক’ (অর্থাৎ শ্লোক) স্টাইলে লেখা এই ‘বাখানে’ দ্বৈপায়ন বন্দনা - লেখকের ভণিতা - গীতা এবং কুরু উপাখ্যান থেকে মহাভারত মাহাত্ম্য পর্যন্ত বয়ান করা হয়েছে মাত্র হাজার খানেক শব্দের মধ্যে।

কিন্তু এবার ঘরের কাছে আরশিনগর। আমাদের কাছের মানুষ কবি তথা সাহিত্যিক মনোমোহন মিশ্র লিখেছেন ‘কুট্টি মহাভারত’। সিলেটিতে কুট্টি মানে ছোট্ট। মাত্র ৭৫০ শব্দেই বর্ণিত হয়েছে মহাভারত। সুতরাং এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এটাই হবে মহাভারতের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ। 

আর একেবারে সম্প্রতি বরাক বঙ্গের সাহিত্য ভুবন থেকে প্রকাশিত হলো অভিজিৎ চক্রবর্তীর ‘সিলেটি মহাভারত’। আনুমানিক আড়াই হাজার শব্দর মধ্যে এটি লিখিত। 

বইয়ের প্রথমেই লেখক স্মরণ করেছেন শিলচর রামকৃষ্ণ মিশনের সদ্যপ্রয়াত অধ্যক্ষ সত্যস্থানন্দজী মহারাজ এবং মিশনের প্রাক্তন গ্রন্থকারিক শ্রী শিবশংকর ভট্টাচার্যকে। এরপর সুন্দর একটি সিলেটি কবিতার মাধ্যমে বিনয় প্রকাশ করেছেন সিলেটি রামায়ণের রচয়িতা সুন্দরীমোহন দাস এবং এই বইএর মুদ্রক শিলচর সানগ্রাফিক্সের কর্ণধার শ্রী পুণ্যপ্রিয় চৌধুরীর উদ্দেশে তাঁর প্রেরণার উৎস হিসেবে। বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর বোনকে।

আদ্যোপান্ত পয়ার ও লাচাড়ি ছন্দে লিখা এই বইয়ের ভূমিকা অর্থাৎ ‘মঙ্গলাচরণ’ করেছেন ষোল লাইনের এক চমৎকার লাচাড়ির মাধ্যমে। মূল মহাভারত শুরু হয়েছে এইভাবে -

হস্তিনাপুরর রাজা চন্দ্রবংশ জাতো। 

শান্তনু, শিকারো গিয়া দেখা বনপথো।।

অতীব সুন্দরী কইন্যা গঙ্গা দেবী সনে।

বিবাহ কইরা তাইনরে আনিলা ভবনে।।

এর পর মূল মহাভারতকে ৪টি লাচাড়ি এবং ৩টি পয়ারে মোট ২৮ পৃষ্ঠায় তিনি চমৎকার ছন্দগাথায় লিপিবদ্ধ করেছেন। অথচ কোথাও তিনি ‘কাশীরাম দাস কহে  - - - ‘ ধরণের শব্দবন্ধ ব্যবহার করেননি। এক একটি পর্বকে অত্যন্ত সুচারু ভাবে স্বল্পকথায় লাচাড়ি পয়ারের সুতোয় বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়েছেন গ্রন্থকার। মঙ্গলাচরণ থেকে শেষ লাইনটি পর্যন্ত ভগবৎ পদে তাঁর নিঃস্বার্থ সমর্পণ পাঠককে এক অনাবিল ঐশ্বরিক মহিমায় সুষমামণ্ডিত করে রাখে। গ্রন্থকারের ভাষায় -

মহাভারতোর কথা লাচাড়ি পয়ারে।

ইখানো ওউ ইতি টানলাম সিলেটি ভাষান্তরে।

ভাব-ভক্তি, শক্তি নাই আমি গুণহীন।

হকল ওউ তান ইচ্ছায় আমি যাঁর ইচ্ছাধীন।

যদি ভুল ভাল কিছু হয় তবে হে কিষ্ণ অন্তপ্রাণ

স্বগুণে নির্গুণরে দিও মহত্বের প্রমাণ।।   

নিজের মতো করে একটি সমাপ্তিও টেনেছেন শ্রী চক্রবর্তী যেখানে আজকের দিনে ধর্মাধর্মের যে টানাপোড়েন তার প্রতি মহাভারতের শিক্ষার বাতাবরণে নিজের ব্যাখ্যাটি নিয়ে তিনি লিখছেন -

ধর্ম সত্য, মিথ্যা নয়

অপকর্ম কি ধর্ম হয় ?

জয় কিংবা পরাজয় ইহা নির্ধারিত।

সুকর্ম ধর্মেরই বর্ম

জাতি হিংসা এ অধর্ম

ভেদাভেদ, মাইর দাঙ্গা যাউক বা নিপাতো।

সব মিলিয়ে সিলেটের ভাষাগত অপিনিহিতিযুক্ত আঞ্চলিক শব্দের কিছু ব্যবহারের বাইরে এক কথায় নিখুঁত এক পূর্ণাঙ্গ মহাভারতের সংক্ষিপ্ত রূপ আমাদের উপহার দিয়েছেন শ্রী অভিজিৎ চক্রবর্তী। বইটির প্রকাশক অনির্বান (ইমন) চক্রবর্তী এবং অভিষেক (অনিক) চক্রবর্তী। 


‘সিলেটি মহাভারত’

মূল্য - ১০০ টাকা।

যোগাযোগ - ৯৮৬৪৩৬০৪১৭ 

- - - - - - - - - - - -

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়