Skip to main content

প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রত্যয়ের পত্রিকা – ‘সীমান্ত’


নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের গোসাইগাঁও শাখা থেকে নিয়মিত বেরোয় মুখপত্র তথা সাহিত্য পত্রিকা ‘সীমান্ত’। এর সর্বশেষ সংযোজন অষ্টম সংখ্যা, জানুয়ারি ২০২২। সম্পাদক বন্দন দেব। সম্পাদকীয় দপ্তরে সহসম্পাদক দেবাশীষ দে’র বাইরেও আছেন স্বপ্না বল, কৃষ্ণকান্ত সূত্রধর, রীতা দেবনাথ মুখার্জী এবং শ্যামল দেবনাথ। ১০৯ পৃষ্ঠার ব্যাপক আয়োজনে সন্নিবিষ্ট হয়েছে সাহিত্যের ভিন্ন ধারার রচনার পাশাপাশি শাখা সংবাদ এবং সদস্যসূচি। আছে ৯ টি প্রবন্ধ, ১৬ টি কবিতা, ৬ টি ছোটগল্প, ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ বিভাগে তিনটি বিশেষ অণু নিবন্ধ এবং ‘কচিকাঁচাদের বিভাগ’-এ ৪ টি কবিতা।
শাখা কর্মাধ্যক্ষের প্রতিবেদনের বাইরে সম্পাদকীয়তে আছে শাখা সম্মেলনের উদ্দেশ্য বর্ণনার পাশাপাশি পত্রিকা নিয়ে গভীর প্রত্যয়ের সুর – ‘একটা সময় এই ‘সীমান্ত’ই হবে সময়ের এক বাংলা ভাষার কালজয়ী মূল্যবান দলিল যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেখাবে এক আশার আলোর মসৃণ পথ।’
প্রবন্ধ বিভাগে ‘বড়ো-কছারী জনগোষ্ঠীর আদি কথা ও কয়েকটি সামাজিক প্রথা’ শিরোনামে অধ্যাপক দেবাশীষ ভট্টাচার্য তুলে ধরেছেন বড়ো-কছারীদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সহ যাপন কথার এক সংক্ষিপ্ত অথচ সার্বিক বাখান। ডঃ দীপক কুমার রায় সমাজে ‘লৌকিক দেবদেবীর ঐতিহ্য’ নিয়ে লিখেছেন বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ। নেতাজী সুভাষের উপর আছে দু’টি প্রবন্ধ। লিখেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভাদুড়ী এবং মীনাক্ষী চক্রবর্তী (সোম)। তত্ত্ব ও তথ্যের সমন্বয়ে উভয় রচনাই সুখপাঠ্য। ‘শোনা গল্প আবার শুনি’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবিতা বসু তুলে এনেছেন স্বামী চেতনানন্দজীর সংকলক গ্রন্থ ‘গল্প মালিকা’ থেকে স্বামী মুক্তেশ্বরানন্দের লিখা দু’টি ভিন্ন স্বাদের গল্প। বৈচিত্র্য আছে বৈকি। ভ্রমণের প্রেক্ষাপটে ৫১ টি শক্তিপীঠের বর্ণনা দিয়েছেন নির্মলেন্দু রায় তাঁর ‘কনখলের দক্ষযজ্ঞ, বাঙালির শক্তি সাধনা এবং ভূ-ভারতের একান্ন সতীপীঠ’ প্রবন্ধে। পড়ে যেতে হয় এক পঠনে। এছাড়াও ফেসবুকের সাহিত্য চর্চা, আন্তর্জাতিক নারী দিবস এবং বৈধব্য প্রথা নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন যথাক্রমে রতন বসাক, কামাখ্যাপ্রসাদ শর্মা এবং চৈতি।
দুই ভাগে সজ্জিত কবিতা বিভাগে সন্নিবিষ্ট হয়েছে যাঁদের কবিতা তাঁরা হলেন রফিকুল হাসান, অমর ধাড়া, বাবুল চন্দ্র দেব, উত্তম বিশ্বাস, ইভা দাশগুপ্ত, লেখা মন্ডল, শেফালী ব্রহ্ম, গৌতম বসু, সঞ্জিত ভট্টাচার্য, কমলিকা শর্মা, তরুণ কুমার আচার্য, জয়ন্ত দে, বাপন দে, বন্দন দেব, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী এবং আলতাফ মজুমদার। কবিতা বিভাগে আধুনিক কবিতার চাইতে প্রাচীন কাব্যশৈলীরই ভার বেশি অনুভূত হলো। দু’একটি ব্যতিক্রমের বাইরে ভাব, ছন্দ, কোমলতা, কবিতাময়তাকে ছাপিয়ে গেছে বর্ণনাত্মক উচ্চারণ।
গল্প বিভাগে প্রথম গল্পটি তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জাহাজ ডুবি’। এক সাগর যাত্রার বৃত্তান্ত এবং দুর্ঘটনাজনিত মনোবিকারের সংমিশ্রণে লিখিত টানটান কাহিনি। বিদেশি কিংবা দেশীয় কোনো নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ গল্পের আদল পূর্ণমাত্রায়। যেহেতু কোথাও তেমন উল্লেখ নেই তাই ধরেই নেওয়া যায় এ সংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন এই গল্প। তনিমা পাত্রের গল্প ‘নতুন ভোরের আলো’। চমৎকার থীম। ভালোবাসা এবং ভালোবাসাহীনতার ককটেল। শৈলীও ভালো। তবু বুনোটে কোথাও এক অতৃপ্তি রয়ে গেল। খানিক বিস্তৃত হলে হয়তো গল্পময়তা এসে ধরা দিত সঠিক ধারায়। ‘ডি’ নামে প্রকাশিত পশতু ভাষায় লিখা গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট ইংরেজ সাংবাদিক তথা গল্পকার ও অনুবাদক জারগুনা কারগার। এই গল্পটির বাংলা অনুবাদ করেছেন এ অঞ্চলের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, কবি ও অনুবাদক তপন মহন্ত। শিরোনাম ‘সিদ্ধান্ত’। গল্পটি আফগান উগ্রপন্থার তাণ্ডবের উপর লিখিত একটি মনোগ্রাহী গল্প যদিও এই অনুবাদে যেন মূল গল্পের ভাব কিছুটা ব্যাহত হয়েছে ভাষা ও বর্ণনার যথোচিত প্রকাশের অভাবে। ‘সে তার মেয়ের কাছে গেলেন’ জাতীয় একাধিক বাক্য রয়েছে গল্পে। সাথে ছাপার ভুল আর বানান ভুলের তাণ্ডবে সুখপাঠ্য হয়ে ওঠেনি এই গল্প। অশোক কুমার রায়ের ‘কোভিড ফাইটার’ কোভিড সময়ের মর্মস্পর্শী একটি মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে লিখা বেশ গোছালো একটি গল্প। কিছু কাঁচা হাতের শব্দ (শরীর হাতিয়ে দিয়েছে বারবার) এবং সেই ছাপা ও বানান ভুলের আধিক্য থাকলেও এসব গল্প ভবিষ্যতের জন্য এক একটি দলিল হওয়ার যোগ্য। হাস্যরসের আদলে (‘বিয়ের সময় সব মেয়েই চন্দ্রমুখী, কিছুদিন পর সূর্যমুখী আর শেষ জীবনে জ্বালামুখী’) স্মৃতিমেদুরতার গল্প ‘স্মৃতি’ লিখেছেন অবনীন্দ্র কুমার নন্দী। (পক্ষপাত দোষ মার্জনীয়)। সামাজিক অবক্ষয় ও তার থেকে বেরিয়ে আসার প্রত্যয়ভরা অণুগল্প ‘শিশিরকণা’ লিখেছেন মনতোষ মিশ্র। উপরোক্ত দু’টি বর্ণনাত্মক গল্প হয়তো সে অর্থে ঠিক গল্প হয়ে ওঠেনি তবু একটা বার্তা পৌঁছে যায় সমাজে। নাই বা হলো ভাষা সাহিত্যের গতবাঁধা প্রয়োগ।
কচিকাঁচাদের বিভাগে চারটি সুন্দর কবিতা লিখেছেন রবিনা সরকার, পিয়া কুন্ডু, সুপ্রিয়া দে সরকার এবং বর্ণালী দেবনাথ। বোধ করি শিশু কবিতায় আজকাল নারী কবিরাই (যদিও লিঙ্গায়ন অনুচিত) অগ্রগামী।
দু’টি চমৎকার ভ্রমণ কাহিনি রয়েছে এই সংখ্যায়। নস্টালজিক বাংলাদেশ ভ্রমণের কাহিনি লিখেছেন সুদীপ মুখার্জী এবং বেশ কিছু সাদা কালো ছবির সমাহারে আন্দামান ভ্রমণের কাহিনি লিখেছেন চিন্ময় কুমার বল। সুখপাঠ্য উভয়েই।
সাময়িক প্রসঙ্গে ওমিক্রণ নিয়ে আছে দু’টি অণু রচনা। লিখেছেন ডাঃ জয়ন্ত বিশ্বশর্মা এবং অন্য রচনাটি নেওয়া হয়েছে দেবাশিস সেনগুপ্তের লিখা দুর্গাপুর শাখা সাহিত্য হোয়াটস্‌এপ গ্রুপের সৌজন্যে। এছাড়া স্বাস্থ্য নিয়ে পরমাণু নিবন্ধ লিখেছেন কৃষ্ণকান্ত সূত্রধর। এর বাইরে নীরবে, সূচিপত্রে অনুল্লেখিত থেকেও বিশ্ববিখ্যাত মনীষীদের উক্তি সংগ্রহ করে ভেতরের একাধিক পাতায় সন্নিবিষ্ট করেছেন দয়ানন্দ ভট্টাচার্য।
প্রচ্ছদ ছবি গৌতম দে সরকার। প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা চিন্ময় কুমার বল। 
গোসাইগাঁও-এর মতো ভৌগোলিক অবস্থানে থেকে এরকম একটি বিশাল সাহিত্য সম্ভার প্রকাশ করা যে কতটা দুরূহ তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। তাই পত্রিকার মানের চাইতেও পত্রিকা প্রকাশের গরজ ও দায়বদ্ধতাই এখানে শেষ কথা। তবু ভবিষ্যতে ছাপা ও বানান ভুলের ব্যাপারটিতে অধিক মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানানো যেতেই পারে সম্পাদকীয় দপ্তরের কাছে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘সীমান্ত’
নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন
গোসাইগাঁও শাখা
মূল্য – অনুল্লেখিত
যোগাযোগ – ৭০০২০১০৩৪৭, ৬০০১৩৪১৭৩৪

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়