Skip to main content

গল্পকথায় উৎকৃষ্ট সংযোজন - ‘কয়েক টুকরো ঈশান’


কয়েক টুকরো ঈশান’ - যথার্থ নামকরণ বেশি নয়, সাকুল্যে দশটি ছোটগল্প এবং অবধারিত ভাবে প্রতিটি গল্পের প্রেক্ষাপট এই ঈশান বাংলা - আরো সংক্ষিপ্ত করে বললে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা - যেখানকার আলো হাওয়ায় গল্পকারের বাস সাড়ে পাঁচ বাই সাড়ে আট সাইজে মোট ৮৮ পৃষ্ঠার এই মিনি গল্পগ্রন্থটিকে বাইরে থেকে দেখলে ভেতরের আঁচ এসে গায়ে (চোখে) লাগে না মোটেও
নীলদীপ চক্রবর্তী আসলে কবি না গল্পকার - ধন্দে পড়তে হয়। ইতিমধ্যে তাঁর তিনটি কাব্য সংকলন এবং এ নিয়ে দু’টি গল্প সংকলন - উভয় ক্ষেত্রেই চরম উৎকর্ষতা।
ভিন্ন স্বাদের দশটি গল্পের যে কোনও একটি পড়তে গেলে গল্পটি শেষ না করে উঠে যাওয়ার জো নেই পাঠকের। প্রতিটি গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদের গোছালো ভাষাসমৃদ্ধ বর্ণনা পাঠককে আটকে রেখে দেয় গল্পের ভেতর। নীলদীপের গল্পে ভাষার কারুকার্য, গল্পের যথাযথ বুনোট এবং দক্ষ হাতে খেই ধরে রাখার যে চাতুর্য সেটাই গল্পগুলোকে করে তোলে জীবন্ত। অনেকটা আমাদের বনফুল, বিভূতিরা কিংবা বন্ড, বুকোস্কির ধাঁচ লক্ষ করা যায় গল্পগুলোতে। স্থানীয় প্রেক্ষাপট এবং সমাজের বাস্তব সমস্যাকে উপেক্ষা না করে বরং এই সব অন্যায় অনিয়মকে চোখে আঙুল দিয়ে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন প্রতিটি গল্পে।
শিশুশ্রম ও শিশু মনস্তত্ত্বের উপর প্রথম গল্প ‘শেকড়ের টানে’। শিশু নায়ক শেষ পর্যন্ত শহরের অভিজাত মানুষের ভেতরের হিংসা দ্বেষকে দেখতে পেয়ে ফের ফিরে যায় তার গ্রামের আটপৌরে জীবনযাত্রায়। রেখে যায় কিছু জিজ্ঞাসা যা ভাবিয়ে তোলে পাঠক মন। এই ফিরে যাওয়ার আগ অবধি গল্প এগিয়ে চলে নিজস্ব ছন্দে, টুকরো টুকরো ঘটনারাজির নিখুঁত বয়ানে।
কলঙ্কিত এনআরসির অন্তর্নিহিত করুণ কাহিনি - ‘একটি কাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা’। নথির খোঁজে ব্যতিব্যস্ত তথাকথিত সিস্টেমের ভেতরকার অব্যবস্থার নিরিখে মানুষের নাকানিচোবানি খাওয়ার এক পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা।
অভিজাত এক অসমিয়া পরিবারের বাহ্যিক ঠাটবাটের অন্দরে লুকিয়ে থাকা আটপৌরে ব্যথার কাহিনিকে প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন ‘ও মালিক সারা জীবন কাঁদালি যখন’ গল্পে।
‘বিপন্ন সময় আর একটি নিছক প্রেমের গল্প’ গল্পটি নিয়ে ‘কসমোপলিটন’ শিরোনামে ভূমিকায় সাহিত্যিক তাপস পাল লিখছেন - “একটা ক্লিশে শব্দ ব্যবহার না করে পারছি না। মাস্টারস্ট্রোক। নীলদীপের মাস্টারস্ট্রোক হলো ‘বিপন্ন সময় আর একটি নিছক প্রেমের গল্প’। অসমিয়া ও মিয়া - এই দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ককে খুব যত্নের সঙ্গে তুলে ধরেছেন গল্পকার।’
একজন আদ্যোপান্ত মার্কস্‌বাদী মানুষ যখন পেটের তাগিদে, সংসারের তাগিদে পৌরহিত্যের মতো পেশায় পা ফেলতে বাধ্য হন তখন সিদ্ধান্ত আর মানসিক টানাপোড়েনের দ্বন্দ নিয়ে এক অসাধারণ প্রেক্ষাপটের গল্প - ‘গোর্কি ঠাকুরের বাবা’। গল্পের বুনোট বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।
‘খোলস ছাড়ার আগে ও পরে’ - এক নির্মোহ বাস্তবের গল্প। কিছু অকাট যুক্তিপূর্ণ কথা - বাক্য হয়তো সমাজের সব ধরণের পাঠকের কাছে সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে কিন্তু অকপট বাস্তবটাকে আবারো চমৎকার বুনোটে, ভাষার নৈপুণ্যে উপস্থাপন করেছেন এখানে। প্রথম অনুচ্ছেদ থেকে কিছুটা তুলে ধরার লোভ সম্বরণ করা গেল না - ‘… মহিউদ্দিন চাচার গলার আওয়াজ। সেই একই আওয়াজ প্রায় আশৈশব আকৈশোর পেরিয়ে এই শেষ যৌবনের গোধূলিতেও অমলিন, শুধু বয়সজনিত ভারিক্কি শ্লেষটুকু ছেড়ে দিলে এখনো নিজস্ব গরিমায় অনড়। আজ তাড়াতাড়ি উঠতেই হবে। শ্রাবণের সোমবার। প্যাচপ্যাচে গরম আর অসুস্থ গরুর বাট থেকে ছিরিক ছিরিক করে নিংড়ানো বৃষ্টির ছাট গতকাল থেকেই অতৃপ্ত যৌনতার মতো আধভেজা করছে শহরটাকে।” মাঝখনটায় আছে - “আচ্ছা, সত্যিই কি ভক্তি মানুষকে মন্দির পর্যন্ত নিয়ে যায় ? না কি কাম, লালসা এসবও নিয়ে যায় ? মানুষকে, মন্দির পর্যন্ত। ভাগ্যিস শবনম এসব জানে না, বা মাথা ঘামায় না। রাতের একাকী বিছানাকে দ্বৈত মালিকানার বৈধ বা অবৈধ স্তরে উঠিয়ে নেবার জন্যও কি ও যায় ? মন্দিরে ?” এই গল্পের শেষটা যদিও খানিক দ্রুত লয়ে চলে এসেছে বলে মনে হয় তথাপি গল্পকার গল্পের শিরোনাম তথা গল্পের থীমকে বজায় রাখতে পেরেছেন পুরোপুরি।
মানব মনের আরেকটি গভীর মনস্তত্ত্বের গল্প ‘শুঁয়োপোকার সংসারের গলিপথ’।
‘হস্তীর পায়ে বেড়ি’ উজান আসামের গভীর বনানী ও বন্যপ্রাণীসম্বলিত বিশাল এলাকায় বন্যহস্তীর আচার আচরণ ও আজকের মিশ্র মানবিকতার ককটেলে এক অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ গল্প। টানটান তার বুনোট - যথারীতি শক্ত হাতে খেইটি ধরে রেখে।
গোয়েন্দা গল্প ‘মৎস্য বিভ্রাট’। চমৎকার একটি আখ্যান যার শেষটায় অপরাধী এক বিচিত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ধরা পড়লেও আসল গোয়েন্দা যে কে সেটা নির্ধারণ করাই শক্ত হয়ে পড়ে। শক্ত কাঠামোর এই গল্পটিতে আদপে গল্পকারই যে আসল গোয়েন্দা সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেষ গল্প - ‘কালগর্ভ’। অনেকটা প্রথম গল্পেরই ছায়া। কিন্তু ফর্মাটটি নতুনত্বের দাবি জানায়। পালাক্রমে সাধু ও চলতি ভাষার একাধিক পর্ব দুই বন্ধুর জবানিতে সাজিয়ে এক সুস্বাদু পরিবেশন - যদিও গল্পের থীম বেদনাদায়ক। হারানো অতীতকে খুঁজে না পেয়ে উদ্ভূত এক বিষণ্ণতার কাহিনি। শেষ পৃষ্ঠায় গল্পের সূত্র ধরে গল্পকারের উক্তি - “অতীতকে রোমন্থন করে সুখস্মৃতি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সশরীরে সুখের অতীতে ফিরে যাবার ভাবনা নিষ্ফল মাত্র।”
প্রতিটি গল্পের অবয়ব ধরাছোঁয়ার মধ্যে। নাতিদীর্ঘ। এক পঠনে শেষ করার মতো। এই কারণেই নীলদীপের গল্প পঠনযোগ্য এবং উপভোগ্য। পাঠান্তে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেননি কোথাও।
সমাজের নানা ঘাত প্রতিঘাতের বয়ানসমৃদ্ধ গল্পগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছেন আরেক কবি ও গল্পকার কমলিকা মজুমদার। প্রচ্ছদ চিত্রে সেই ভাবধারাটি চমৎকার ভাবে ফুটে উঠলেও নামলিপির ‘কালার স্কীম’ যথাযথ হয়নি। গুয়াহাটির উঁই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন - ‘ঈশান বাংলার সাহিত্য-স্বাস্থ্য নিয়ে যিনি ভাবেন - বাসব রায়কে’। ছাপার ভুল / বানান ভুল নিতান্তই নগণ্য। পেপার ব্যাক গ্রন্থটির ভেতরের হরফ আরো একটু বড় হলে ভালো হতো - বিশেষ করে গল্পের শিরোনামের সাথে পুরো গল্পের হরফের সাইজের বৈসাদৃশ্য মিটে যেত।
সব শেষে এটা হলফ করে বলাই যায় - ‘গল্প লিখার কৌশল’ কিংবা ‘গল্প পাঠের সুখ’ হিসেবে নীলদীপ চক্রবর্তীর ‘কয়েক টুকরো ঈশান’ এক ‘একক’ হিসেবে স্থান পাওয়ার যোগ্য।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

‘কয়েক টুকরো ঈশান’
নীলদীপ চক্রবর্তী
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪০১১০১৬৪৩

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়