Skip to main content

নিটোল ব্যঞ্জনার কাব্যগ্রন্থ - ‘গান্ধারী বাঁধন খোল’


প্রতিবার দৃঢ়তা ভাঙে
বিষণ্ণ রাত
চায়ের চুমুকে
ওড়ে রাজহাঁস,
অবহেলিত পোড়ো বাড়িতে
কুসুমকুমারীর গায় মান্দাস
 
নিলাম হয়ে গেছে ভিটেমাটি
 
যন্ত্রসভ্যতার রূপটানে
শ্যাওলার বিভ্রম
বিসর্জনের বাজনা বাজে
গ্রিসের সমুদ্রতীরে
(কবিতা - বিভ্রম)
এভাবেই ব্যাঞ্জনায়, রূপকে একের পর এক সেজে ওঠে মন্টু দাস-এর কবিতা প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘গান্ধারী বাঁধন খোল’। পাকা বাঁধাইয়ে ৭২ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থে রয়েছে মোট ৬৫ টি কবিতা। অধিকাংশ কবিতাই হ্রস্ব অবয়বের। কিছু পৃষ্ঠাজোড়া কবিতা থাকলেও আকারে ছোট কবিতাগুলোই অধিকতর আবেদনময়। প্রায় প্রতিটি কবিতাই প্রথম পুরুষে লিখা। অর্থাৎ প্রকারান্তরে অনেকটা আত্মকথারই প্রকাশ যদিও সেই কথার বাঁধন অনেকটা গান্ধারীর অক্ষিবন্ধনের মতোই। কবি যেন তাঁর কবিতায় প্রয়াস করেছেন বহু কথা বলতে। অথচ সেইসব না বলা কথারা বিভ্রম হয়ে আত্মগোপন করে আছে কবিতার শরীরে। ব্যাঞ্জনায় ব্যাঞ্জনায় বহুস্বৈরিক ভাবনারা খেলা করে বেড়িয়েছে একের পর এক কবিতায়। কবিমন সতত ভ্রাম্যমান। বিশ্ব জুড়ে তাঁর পরিভ্রমণ। কবি আজকের অসুস্থ পৃথিবীকে দেখেছেন কাছে থেকে। ভিটেমাটিচ্যুত যাযাবর জীবন যাপনের খণ্ডচিত্র তাঁর অনুভবে অনুভবে। সেই বিচিত্র ভাবনাদের চোখ মেলে দেখার অনুভব কথা হয়ে পাখনা মেলতে চেয়েছে কবিতার অন্তরমহলে -
এ কোন দুর্নিবার বেদনা, নিশীথ সূর্যের
বুকে আলোড়ন তোলে,
ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে
লুব্ধ হায়েনারা,
 
গান্ধার মেসোপটেমিয়া
বারুদে ভরে যায়
শান্তির জন্য যুদ্ধ বাঁধে
ছোট্ট লিবিয়ায়। ...
(কবিতা - অসুস্থ পৃথিবী)
কবির হৃদয়ের হাজারো ভাবনারা অজস্র রূপক হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে তার স্বল্পকথার কবিতায় -
অনন্ত জিজ্ঞাসায় ডুবে থাকে ভাষা
পূর্ণিমার চাঁদ খোঁজে নিষিদ্ধ বর্ণমালা।
 
তারপর একে একে
পাথরের খাঁজে
নির্মিত হয় ইতিহাস।
 
বিস্তর কলঙ্করাশি
চাপা পড়ে যায়,
ইতিহাসকার আপন খেয়ালে লিখে যায়,
বিপন্ন কাহিনি।
(কবিতা - ইতিহাস-১)
ত্রিপুরার কবি মন্টু দাস। আসাম সংলগ্ন সীমান্তে তাঁর বাসস্থান। যে জায়গাটি ভৌগোলিক দিক দিয়ে আজ আন্তর্জাতিক সীমান্তেরও কাছাকাছি। দ্বিখণ্ডিত বাংলার সুখ দুঃখ তাই উঠে এসেছে কবির কবিতায়। যেমন উঠে এসেছে ত্রিপুরা ও আসামের স্থানিক বর্ণনা। নস্টালজিক কবি তাই লিখে রাখেন ইতিহাস -
বেড়ার ওপারে মন ছুটে চলে
এক মগ্ন বিলাপ ভাসে অতীতের ডানায়
সাদা বক পাখা মেলে উড়ে উড়ে যায়
বাংলার মাটির গন্ধ আমাকে ভাসায়। ...
(কবিতা - অসীমান্তিক)। কিংবা -
ইচ্ছে ছিল বর্ষার দিনে
হাকালুকি কিংবা মনুমুখে
উত্তাল জলরাশি দেখে দেখে
কবিতার খাতায় আঁচড় কাটব -
জাটিঙ্গার তীরে
পাথরে বসে লিখব ইতিহাস।
 
কিছুই হলো না,
হয়তো আবার দেখা হবে
বরাকের তীরে
বিস্তীর্ণ ধানের খেতে
অথবা জম্পুই চূড়ায় বেতলিংশিবে
দূরবিন হাতে।
(কবিতা - ফিরে যাব)।
বাঁধন খোলার কাব্যগ্রন্থে আছে কাব্যবৈচিত্র্য। কিছু কোমলাঙ্গের কবিতায় ধরা পড়ে কবির পার্থিব ভাব ভালোবাসার অনাবিল ছবি। মিশে যায় গরজে, দায়বদ্ধতায়। কিছু পঙ্‌ক্তি যেন কবিতায় ছড়িয়ে দেয় প্রেম ও প্রকৃতির চিরন্তন আবেগ, আবেশ, আমেজ, আকণ্ঠ উদ্‌বেগ -
তোমার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ কখনো কেড়ে নেয়
আমার সোনার ধান -
আমার প্রাণপ্রিয় শিশু
কখনো দাঁড়াবার ভূমিটুকুও
আকণ্ঠ মর্মবেদনা তোলপাড় করে
বহতা প্রতিশ্রতি
ভাঙাবাঁধ পেরিয়ে যায় সতর্কে
বারে বারে লুঠ হয়
খোলা আকাশের নীচে
আমার সোনার ধান।
(কবিতা - সোনার ধান)। কিংবা আরোও আরোও বহু কবিতা -
কিছু কবিতা বিশেষ করে দাগ কাটে পাঠশেষে। উল্লেখযোগ্য - শেখানো সংগীত, নির্জনতার আড়ালে, অনশন, মানবসমুদ্র তীরে, বেহুলা ভেলা, দহন, অতঃপর প্রাণিত ইত্যাদি।
নিরন্তর বাঁধন খোলার প্রয়াসে কখন যেন পড়তে পড়তে পৌঁছে যেতে হয় সমাপ্তিরেখায়। এক ঘোর লাগা আবেশে রেশ থেকে যায় কবিতার। প্রতিটি কবিতা সুসংহত, সুবিন্যস্ত এবং পরিমিত। কোথাও বাহুল্য নেই।
চমৎকার প্রচ্ছদের সৌজন্যে মৃণাল শীল। বস্তুত এই প্রচ্ছদ কাছে টেনে নেয় পাঠককে। বহ্নিশিখা পাবলিকেশ্বন - ধর্মনগর, ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত এবং ভারতী অফসেট, কোলকাতা থেকে মুদ্রিত এই গ্রন্থের যথাযথ বর্ণস্থাপনার কৃতিত্বে অক্ষরবৃত্ত, কোলকাতা। অনবধানতায় কিছু শব্দের বানান ভুল থেকে গেছে যদিও তা সংখ্যায় নগণ্য। ইতিহাস-১ শিরোনামের কবিতা আছে যদিও -২ নেই। তেমনি সময়-৩ আছে যদিও -১ কিংবা -২ নেই। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন ‘বিশিষ্ট কবি অমরেন্দ্র শর্মা এবং পীযূষ রাউত-কে’।
ভূমিকাহীন এই কাব্যগ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে রয়েছে কবির কবিতা নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত ব্লার্ব। সব মিলিয়ে এক সুখপঠনের কাব্যগ্রন্থ মন্টু দাস-এর ‘গান্ধারী বাঁধন খোল’।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘গান্ধারী বাঁধন খোল’
মন্টু দাস
মূল্য - ৯০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০৫৩৯৬৬৩৯

Comments

  1. ভূমিকা পড়ে খুব ভালো লাগলো!

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়