Skip to main content

অনুবাদ সাহিত্যের চমকপ্রদ সংকলন - ‘কাব্যবীথিকা’


অনুবাদ সাহিত্যের চমকপ্রদ সংকলন - ‘কাব্যবীথিকা’
 
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
 
ভাষার উদ্ভাবন ও তার প্রসার মানবেতিহাসের এক অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা অচেনা ভাষার অপরিচয় থেকে চেনা ভাষায় রূপান্তরের মাধ্যমে মানব অভিজ্ঞতার যে বৈচিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তা কিন্তু প্রমাণ করে মানবসৃষ্ট সাহিত্য দেশকালোত্তীর্ণ আর এখানেই অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের মানবিক ও শৈল্পিক সত্তাকে, অনুভব শক্তিকে ব্যপ্ত করার একটি প্রয়াস হচ্ছে অনুবাদ ভাষান্তরের বাধা পেরিয়ে ভৌগোলিক দূরত্বকে জয় করে বিশ্বমানবের অনুভবের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ এনে দেয় অনুবাদ বস্তুত একটি মানুষ শিশুকাল থেকেই অনুবাদের মাধ্যমে জগতকে চিনতে, জানতে শেখে। অভিনয় ও শব্দের তরজমার সুবাদেই ভাষার মাধ্যমে প্রকাশক্ষমতা গড়ে ওঠে আয়াসসাধ্য প্রচেষ্টার ফলে। মানুষ প্রধানত অনুবাদের মাধ্যমেই পারিপার্শ্বিক জগৎটাকে উপলব্ধি করতে পারে।
বাংলার সবচাইতে কাছের ভাষা হলো অসমিয়া। একই উৎস থেকে আগত সমকালীন উদ্‌ভাবনের মাধ্যমে এই দুই সহোদরা ভাষার উৎপত্তি যদিও চর্চা ও সহজলভ্যতার অভাবে উভয় ভাষার পাঠক পাঠিকারা উভয় ভাষার সাহিত্যরসের স্বাদ থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত। একমাত্র অনুবাদের মাধ্যমেই তাই একে অপরকে চেনার, জানার, সাহিত্যপিপাসা মেটানোর সুযোগটি তৈরি করা যায়। আজকের দিনে উভয় ভাষার সাহিত্যিক, অনুবাদকরা এই কাজে গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করে রেখেছেন। অনুবাদ আগেও হয়েছে তবু এই প্রবণতা এই মুহূর্তে ক্রমবর্ধমান।
সম্প্রতি একগুচ্ছ অসমিয়া কবিতার বাংলা অনুবাদ কবিতার সংকলন ‘কাব্যবীথিকা’ প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্যিক, অনুবাদক সত্যজিৎ চৌধুরীর সম্পাদনায়। সম্পাদকীয়তেও অনুবাদ সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা এবং বর্তমান প্রবণতা নিয়ে লিখেছেন সম্পাদক। ১০৭ পৃষ্ঠার এই অনুবাদ গ্রন্থে আছে মোট ৮৭ জন কবির সমসংখ্যক অসমিয়া কবিতার বাংলা অনুবাদ। এর মধ্যে ৮০ টি কবিতার অনুবাদ করেছেন হেলমিনা খাতুন এবং ৭ টি কবিতার অনুবাদ করেছেন সম্পাদক সত্যজিৎ চৌধুরী। শেষোক্তজন আবার কবি, অনুবাদক হেলমিনা খাতুনের একটি কবিতাও অনুবাদ করেছেন। আছে আজকের দিনের বেশ ক’জন প্রতিষ্ঠিত কবির কবিতা এবং অনেক নবীন কবিদের কবিতা। আছে হোমেন বরগোহাঞি, নীলিম কুমার, মণিকুন্তলা ভট্টাচার্য, কিশোর প্রাণজিৎ বরার মতো কবিদের কবিতাও।
হেলমিনা খাতুনের অনুবাদে অধিকাংশ কবিতার মাধুর্য যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে। কিছু শব্দ ও পঙ্‌ক্তির অপরূপ বিন্যাসে কবিতাগুলো যেমন একদিকে হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য তেমনি অন্যদিকে আপামর বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের পক্ষে কবিতার রসাস্বাদন করা হয়ে ওঠে সহজসাধ্য। অনূদিত হয়েও বজায় থেকেছে শব্দবিন্যাসের লালিত্য। কিছু পঙ্‌ক্তি তুলে ধরা যায় এভাবে -
আমার সত্তায়, আমার চেতনায়, জীবনের অনায়াস ছন্দ
সর্পিল গতিতে ভেসে যায় রাতের অন্ধকারের নদীতে
উত্তাল, উদ্দাম, বিমুক্ত।
(কবিতা - সাপ, কবি -  হোমেন বরগোহাঞি)
 
আলতো করে
তোমার জন্যই সাজিয়ে তুলেছি
আমার হৃদয়মহল
যেখানে আত্মগোপন করে
আমার একটি সাদা অশ্ব।
শুভ্রতার আঁচল আবৃত করে
তুমি আসবে মায়াবী জ্যোৎস্না রাতে পরির বেশে...।
(কবিতা - তুমি আমার বাস্তবের শিরোনাম, কবি - জিতেন চেতিয়া)।
 
সত্যজিৎ চৌধুরীর অনুবাদেও রয়েছে সেই একই অনায়াসলব্ধ অনাবিলতা -
আমার জীবনের লাজহীন জীবন তুমি
এক ঝাঁক চঞ্চলা আশার বৃষ্টি
তুমি না থাকলে...
কবিতার কচিপাতারা খসে পড়ে অজান্তে
বৈঠাহীন নৌকোটি ডুবে মাঝপথে।
(কবিতা - তুমি লাজহীন ফাগুন..., কবি - দীপ্তি কলিতা)
 
হাতে গোনা কিছু বানান ভুল এবং কিছু হুবহু অসমিয়া শব্দ এসেছে অজান্তেই, সংখ্যায় যা নিতান্তই নগণ্য। গ্রন্থটির আদ্যন্ত ‘অসমিয়া’ শব্দটি ‘অসমীয়া’ হিসেবে লিখা হয়েছে। এই শব্দটির বঙ্গানুবাদ আর করা হয়নি। স্পষ্ট ছাপাই ও বাঁধাই। অক্ষর, শব্দ ও পঙ্‌ক্তির যথাযথ বিন্যাস। পেপারব্যাক গ্রন্থের মানানসই এবং অর্থপূর্ণ প্রচ্ছদ সৈজন্যে শ্রাবন্তী চৌধুরী। কোলকাতার পৌষালী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির তত্ত্বাবধানে আছে সাহিত্য সংস্কৃতির মঞ্চ, অসম।
অনুবাদকদের এই প্রয়াস উভয় ভাষা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য অবদান নিঃসন্দেহে।
 
‘কাব্যবীথিকা’
সম্পাদক - সত্যজিৎ চৌধুরী
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪০২৬৯৮৩৫৫ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়