Skip to main content

কবিতা বিশ্বে নন্দিত সংকলন ‘দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যের নির্বাচিত কবিতা’


গালে হাত, অধোমুখে ম্লান ম্লান ছায়া, এরকম পিছু ফিরে থাকা
কেমন অসহ্য মনে হয়
………
সক্ষম যুবক আমি, এই পৃথিবীর বুকে চেঁচিয়ে বলতে পারি -
আমার যা কিছু ত্রুটি সব নিয়ে আমি
ক্রমশ এগিয়ে যাব
ভুলের কাঁটার ঘায়ে গোলাপ ফুটেছে এ-তো
প্রামাণ্য নজির
এমন বিষণ্ণ ছবি শরীরে এঁকো না নারী, নিজেকে ছড়িয়ে দাও
গালে হাত, অধোমুখেকেমন অসহ্য মনে হয়
আমার ভেতরে এক দুরন্ত শিশুর ছবি, তুমি কি বোঝো না তার ভাষা ?
(কবিতা - ‘তুমি কি বোঝো না তার ভাষা’র অংশ বিশেষ)
বস্তুত এই একটি কবিতা - যা কিনা আবার বিশাল এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাও - গ্রন্থের নির্যাস নির্ধারণ করে দেয় কাব্যশৈলী এবং কবিতার ভাব, নির্মিতি ও অন্তর্নিহিত নান্দনিকতার নিরিখে। প্রসঙ্গত এই কবিতার পঙ্‌ক্তি বিন্যাস এবং যতি চিহ্নের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। কবি দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যের সম্প্রতি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যের নির্বাচিত কবিতা’। সার্বিক নবম সংকলন - যেখানে রয়েছে ইতিপূর্বে প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত গুচ্ছ কবিতার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এক গুচ্ছ অগ্রন্থিত কবিতা। সব মিলিয়ে ১৬০ পৃষ্ঠার এই আলোচ্য গ্রন্থে রয়েছে নয়টি বিভাগে বিন্যস্ত ১৬৪ টি কবিতা।
শিরোনামহীন ভূমিকায় কবির কিছু কথন গ্রন্থটির ভাবধারার সঙ্গে পাঠকের এক নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করে দেয়। ‘নির্বাচিত কবিতা অথবা শ্রেষ্ঠ কবিতা কাকে বলে কোন হিসেবে বলে তা আমি জানি না। ... কবিতা লিখতে ভালো লাগে, না লিখলে নিজেকে কেমন অসম্পূর্ণ মনে হয়। ... আমার কাছে কোনও শ্রেষ্ঠ কবিতা নেই, তাই শুধু ‘নির্বাচিত কবিতা’ নাম দিয়ে প্রকাশ করছি বাধ্য হয়ে। ...’ ভূমিকায় কবি মনের সারল্য, স্পষ্টবাদিতা এবং কবিতার প্রতি নিবেদন ফুটে ওঠে।
কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে কবি জীবনের কথা, গভীর জীবন বোধের সংলাপ - কিছু সরাসরি, কিছু কাব্যিক কথকতার ছোঁয়ায়। প্রায় প্রতিটি কবিতাই প্রথম পুরুষে লিখা। তাই ‘আমি’, ‘আমার’, ‘তুমি’, ‘তোমার’ আদি ধ্বনিত হয়েছে নিরন্তর। আছে স্বনামে সম্বোধিত কবিতাও (কবিতা - সম্পর্ক)। অনেক কবি, সাহিত্যিক, সমালোচকের ভাষায় প্রথম পুরুষে নান্দনিক কবিতা সৃষ্টি হয় না, হতে পারে নাএই ধারণাকে সমূলে নস্যাৎ করে দিয়েছেন কবি দিব্যেন্দু। একের পর এক কবিতার অবয়বে নান্দনিকতার ছয়লাপ।
‘সাপুড়িয়া বিধিবদ্ধ হলে, মৃত্যু জেনেছে দ্বার, খোলা দ্বার
বিপজ্জনক - এই হাতে আলো নেই, বেণুবেলা বিঘ্ন অতিশয়।
সুখে থেকো যাবৎ জীবন - এ আমার - এ তোমার -
বিপন্ন সারস, পারিপার্শ্বিকের দিকে আড় চোখে তাকাতে শেখেনি।
গাছ থেকে ছায়া ঝরে; ঝাড়বন্ধ বিলাসী গাছেরা
সংকল্পে অটল - এক ঘুঘু উড়ে গেল -
এ আবার কেমন পাহারাধারি......’
(কবিতা - ‘বোধিসত্ত্ব’-এর অংশ বিশেষ)
এ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে তাঁর ইতিপূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সৈকতে’ থেকে ১২ টি, ‘সৌর-শরীর থেকে’ থেকে ১৭ টি, ‘নীল সমুদ্দুর থেকে’ থেকে ১৯ টি, ‘উন্মোচিত স্মৃতি’ থেকে ২৭ টি, ‘অনন্ত নীরব’ থেকে ১৮ টি, ‘লাবণ্য-পাথর’ থেকে ৩০ টি, ‘নৈঃশব্দ্যের ধ্বনি’ থেকে ১৯ টি, ‘দ্বৈত সহবাস’ থেকে ৮ টি এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ১৪ টি কবিতা। স্বভাবতই বোধগম্য যে জানুয়ারি ২০১২তে প্রকাশিত কবির ‘লাবণ্য-পাথর’ কাব্যগ্রন্থেই রয়েছে কবির অধিকাংশ স্বনির্বাচিত কবিতার সম্ভার। এই পর্বে আছে একই শিরোনামে একটি অনন্য কবিতাও -
‘কে জানে কখনও আর ফিরে আসা
হয় কি না হয়
আংটি ছেড়ে খসে যাওয়া হে স্বাধীন লাবণ্য-পাথর -
যতটুকু যেতে চাও চলে যাও, এসময়ে আর
পিছু ফিরে তাকিয়ো না -
ফের যদি দেখা হয়, এসেছে সময় মনে করো, তবে
ঠিকঠাক ঘুরে যেয়ো
......
তবু কিছু থাকে, শেষের পরেও থাকে কিছু কথা -
থাকে অবশেষ। তাই
ফিরে ফিরে এভাবে আসবে জেনে
বারবার আসবে বলেই শুধু অপেক্ষায় থাকি -
খাঁজে বসা ঝকঝকে আংটির পাথর, তুমি
ফুটে উঠবে ফুল হয়ে, পাখি হয়ে
আশরীর জড়-আতান্তরে...
......
তাই, আমি আংটি হতে চাই -
লাবণ্য-পাথরে দ্যুতি হাসবে বলেই তাকে
জড়াবো দু’হাতে, তার
ছলকে ওঠা চমকে চমক নেমে আসে
ঠোঁটে, খাঁজে খাঁজে, চুমুকে চুমুকে
সেই ছটা ছড়াবে রোদ্দুর।‘
(কবিতা - ‘লাবণ্য-পাথর’ এর অংশ বিশেষ)।
শব্দের অসাধারণ প্রয়োগে এভাবেই একের পর এক কবিতা হয়ে উঠেছে কাব্যময়। কাব্যিক মায়াময়তায় ভাস্বর হয়ে রয়েছে বহু কবিতা। কবিতা পাঠকের পঠন যাপনের খোরাক।
পাকা বাঁধাইয়ে স্বচ্ছ নান্দনিক প্রচ্ছদ - সৌজন্যে সৃজন। হাইলাকান্দির ‘সাহিত্য প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি কবি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘বাবা ও মা স্বর্গীয় দিগিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও কমলা ভট্টাচার্যের স্মৃতির উদ্দেশে’নিটোল ছাপাই ও অক্ষর বিন্যাস। ‘প্রায়’ নির্ভুল বানানে সমৃদ্ধ এই সংকলনের কিছু কবিতায় কিছুটা স্রোতের বিপরীতে (হয়তো বা কবির মননে প্রাসঙ্গিক) কিছু শব্দ এসে জায়গা করেছে। যেমন - পায়তাড়া, গাড্ডা ইত্যাদি। দ্বিতীয় ব্লার্বে কবি পরিচিতি থাকলেও প্রথম ব্লার্বে প্রকাশকের তরফে গ্রন্থ পরিচিতি অনুপস্থিত, ফলত অসজ্জিত দ্বিতীয় প্রচ্ছদ।
কবিতার অভুবনায়িত বিশ্বে দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যের ‘নির্বাচিত কবিতা’ এক ব্যতিক্রমী গ্রন্থ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে নিঃসন্দেহে। পাঠক হৃদয়ে নন্দিত এই সংকলনের পঠন শেষে পাঠক ভবিষ্যতের আশায় পথ চেয়ে থাকবে এও নিশ্চিত।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। 
‘দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যের নির্বাচিত কবিতা’
দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৯৫৪১৪৬০৯২

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়