Skip to main content

মাটি ও মানুষের গল্প সংকলন - ‘ধুলামাটির আখ্যান’

 

ধুলামাটির আখ্যান’ - আক্ষরিক অর্থেই একেবারে মাটির সোঁদা গন্ধ মাখা একগুচ্ছ কাহিনির উপস্থাপনা সার্থক নামকরণ এ হচ্ছে প্রথম ভাগের কথা গ্রন্থটিতে দুটি ভাগ আছে প্রথম ভাগগল্পগাছা’ - ১৫ টি গল্পের সমাহার - ধুলামাটির গল্প দ্বিতীয় ভাগকোভিডকালের দহন কথা’ - ৮ টি গল্প - যেভাবে শিরোনামাঙ্কিত
বরাক উপত্যকার নবীন গল্পকার তৃণময় সেন বহু দিন ধরেই লিখে চলেছেন পত্র পত্রিকায় সেসব গল্প এবং নতুন গল্পের সংযোজনে এই গ্রন্থ - ১২৮ পৃষ্ঠার এক প্রত্যাশার ইতিকথা কলকাতার ‘একুশ শতক’ থেকে প্রকাশিত এবং গীতা প্রিন্টার্স থেকে মুদ্রিত গ্রন্থের দেবাশীষ সাহার স্বচ্ছ সুন্দর প্রচ্ছদ ওলটালেই গ্রন্থের ‘কথামুখ’। লিখেছেন খ্যাতিমান কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ। দুই পৃষ্ঠাজোড়া কথামুখে উঠে এসেছে পুরো গ্রন্থের নির্যাস। তিনি লিখছেন - ‘সাত ভাই চম্পার দেশ উত্তর পূর্ব ভারতে বঙ্গসাহিত্যের এক রত্নখনি বর্তমান। কথাসাহিত্যের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে বারবার সৃষ্টি হয়েছে নবীন সব পাঠকৃতি। দেখার চোখ পালটে গেছে, প্রবীণরা তাদের নির্ধারিত অভার শেষ করে ফিরে গেছেন প্যাভেলিয়নে। যখন পালটে যাচ্ছে কথাভাষা তখন ব্যাটন ধরার জন্য দৌড়তে শুরু করেছেন একঝাঁক নতুন কথাকার। রূপদক্ষ শিল্পীর আগমনে আবার উর্বর হয়েছে উত্তরপূর্বের শিল্পভূমি। ...... বাঙালিপ্রধান তিন জেলা কাছাড়, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জের প্রধান শহরসীমা থেকে নিরাপদ দূরত্বে বেড়ে ওঠা কথাকার তৃণময় সেন এখন দিল্লির বাসিন্দা, বহুজাতিকের কর্মচারী। দূরে থাকলেও তৃণময় উত্তরপূর্বের কথাসাহিত্যে এক অপরিহার্য নাম।‘......
প্রথম ভাগের ১৫ টি গল্পই গ্রাম বরাকের অন্তরমহল থেকে উঠে আসা প্রান্তবাসী গরিবগুর্বোদের নিত্যদিনের টানাপোড়েনের বেদনাবিধুর বর্ণনা। গল্পগুলোর হয়তো তেমন জমকালো পরিণতি নেই কিন্তু নিখুঁত বয়ানে উঠে এসেছে দিন আনি দিন খাই-দের এমন কিছু অভাবিত অশ্রুত কাহিনি যা অনায়াসে নড়িয়ে দেয় বিলাসী পাঠকের পঠনভিত। সংলাপে, ভাষায়, বাখানে, বুনোটে সরলপাঠ্য হিসেবে সহজেই সৃষ্টি করে দেয় পাঠস্পৃহা। গল্পগুলোতে বহুল ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে স্থানীয় ভাষার শব্দাবলি ও সংলাপ। জীবন্ত হয়ে উঠেছে চরিত্রসমূহ যদিও কিছু গল্পে চরিত্রের ভিড়ে হারিয়ে না যেতে সতর্ক থাকতে হয় পাঠকের। ভিন্ন ভিন্ন জাতি ধর্মের চরিত্রের উপস্থাপনের মুনশিয়ানায় সহজেই লেখকের বাস্তব বোধের পরিচয় মেলে। সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং অধ্যয়নসঞ্জাত উপলব্ধির অসামান্য মিশ্রণে গল্পগুলো মূর্ত হয়ে ওঠে পাঠকের দরবারে। অধিকাংশ গল্পেই রয়েছে সমাজের নানা অপরাধ, সরকারি শাসনযন্ত্রের নানাবিধ ফরমান এবং অনিয়ম, অবাঞ্ছিত নিয়মকানুনের প্রতি এক লুক্কায়িত প্রতিবাদ। এখানেই সার্থক একজন কথাকারের শৈল্পিক সত্তা।
দ্বিতীয় ভাগে কোভিডকালের এমন কিছু দিক প্রস্ফুটিত হয়েছে গল্পসমূহের মাধ্যমে যা হয়তো এতদিন সেভাবে কেউ ভেবেও দেখেননি। কিংবা বলা যায় একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের কিছু অসহায়তার গল্প। অতিমারি সময়ে যেসব কথা ও কাহিনি উঠে এসেছিল জনসমক্ষে তার বাইরে কিংবা তার ভিতর থেকে তৃণময় তুলে এনেছেন এক ভিন্নতর যাপনের অভাবিত ঘটনাবলি। তবে এই পর্যায়ের গল্পগুলোর সমাপ্তি রেখা টানার ব্যাপারে বোধ করি কিছুটা উদাসীনই থেকে গেলেন গল্পকার। সঠিক দিশা নির্ণয়ে কার্পণ্যের কারণে ‘সব ভালো যার শেষ ভালো’ আর হয়ে উঠেনি কিছু গল্প। কিছু গল্প শুধুই টুকরো টুকরো ঘটনাবলির বর্ণনামাত্র হয়ে রয়ে গেছে। অথচ এই পর্বেই রয়েছে ‘মুখদর্শন’-এর মতো অসাধারণ গল্প। চরিত্রের ভিড় এই পর্বেও পরিলক্ষিত হয়েছে।
ঝরঝরে ভাষা ও সাহিত্যগুণের মাঝে কাঁটার মতো রয়ে গেছে এক গুচ্ছ বানান ভুল। বিশেষ করে এল, এলে, এলাম আদির স্থলে আসল, আসলে, আসলাম জাতীয় শব্দ নিতান্তই পঠনকটু হয়েছে। একাধিক গল্পে ‘আনোয়ার’ চরিত্রের নাম ‘আনোর’ কেন হলো তাও বোঝা গেল না। তবে এসব কিছুকেই ছাপিয়ে গেছে গল্পকারের ভাবনা, উপলব্ধি এবং নিপুণ বুননের প্রক্রিয়াটি। একজন নবীন গল্পকারের কাছে এতটা প্রত্যাশা হয়ত থাকে না। কিন্তু তৃণময় সেই পর্যায় পেরিয়ে এসেছেন বহু আগেই। এরই ফল এই গ্রন্থ। প্রতিটি গল্পের শুরুতে শিরোনামের সঙ্গে মানানসই রেখাচিত্র পাঠকের মনে দাগ কাটতে বাধ্য। কিছু অণুগল্প ধাঁচের গল্পের পাশাপাশি বেশ কয়েক পৃষ্ঠাজোড়া কিছু গল্পও রয়েছে। কথামুখে উল্লিখিত আছে একাধিক বিশেষ গল্পের কথা। অন্যদের চাইতে আলাদা করে মনে দাগ কাটে সেসব গল্প।
পাকা বাঁধাইয়ের এই সংকলনের ছাপা ঝকঝকে, স্পষ্ট। শব্দ, বর্ণবিন্যাস যথাযথ। অলঙ্করণ সৌজন্যে মৌলি রায়। লেখক গ্রন্থটি উৎসরগ করেছেন তাঁর ঠাকুমা নিভা রাণী সেন এবং তাঁর গ্রামের ঝিল, বিল, প্রান্তর ও শৈশব-কৈশোরের সাক্ষী হারাং নদীকে। দ্বিতীয় ব্লার্বে গল্পকারের পরিচিতি থাকলেও প্রকাশকের পক্ষ থেকে প্রথম ব্লার্ব খালিই থেকে গেল।
সব মিলিয়ে এ সংকলন প্রত্যাশার পারদ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে পাঠকমনে - এ কথা হলফ করেই বলা যায়।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
 
‘ধুলামাটির আখ্যান’
তৃণময় সেন
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৭৮৩৮২৬১৮৬২

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...