লিখেছিলেন কোনও এক অজ্ঞাত কবি - ‘আমি গাছপাখি হব পরজনমে’। পাখিজীবন নিয়ে মানুষের ভাবনার বিরাম নেই কদাপি। আপাত ভাবনায় পাখিজীবন সুখের জীবন। যথেচ্ছ উড়ে যাওয়ার স্বাধীনতা যে আছে! পৃথিবীর বুকে যত দিন প্রকৃতি আছে, গাছগাছালি আছে - খাদ্য কিংবা বাসস্থানের অভাব নেই। ‘তার মতো সুখ কোথাও কি আছে’ ? এমন বিন্দাস সুখী জীবনের হাতছানিতেই তো মানুষ ছুটে বেড়ায় আজীবন।
কিন্তু আদপেই কি তা ? পাখিরা কি সত্যিই সুখী ? ‘পাখির চোখ’-এ কেমন রূপ ধরা পড়ে এ পৃথিবীর ? পাখিদের মন জুড়ে কোন ভাবনা খেলে বেড়ায় নিয়ত ? সবই অজানা। আসলে, গ্রন্থের ভূমিকা শেষে - ‘পাখিদের সম্পর্কে আমরা আর কতটুকু জানি’ - বলতে গেলে এই ট্যাগলাইনটিই আলোচ্য গ্রন্থের নির্যাস। কমল বসু লিখিত গল্প সংকলন ‘পাখি সব করে রব’। বিখ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি থেকে নেওয়া এবং স্বভাবতই গ্রন্থের বিষয়ের সঙ্গে আগাপাশতলা প্রাসঙ্গিক।
১২৭ পৃষ্ঠার গ্রন্থের ১১৭ পৃষ্ঠা জুড়ে মোট ২০টি গল্পের সমাহার। আড়াই থেকে এগারো পৃষ্ঠা জোড়া গল্পগুলির সঙ্গে রয়েছে প্রাসঙ্গিক রেখাচিত্র যা পঠনক্রিয়ায় যুক্ত করেছে আলাদা পঠনসুখ। আমাদের চেনা জানা পরিমণ্ডলের সতত চোখে দেখা পাখিদের নিয়ে লিখা গল্পগুলোতে লুকিয়ে রয়েছে এমন কিছু অজানা তথ্য, কল্পিত কথোপকথন যা প্রতিটি গল্পকে করে তুলেছে সহজপাঠ্য, সহজবোধ্য এবং শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের পাঠকের কাছে নির্মল, সানন্দ পাঠযোগ্য।
এক একটি গল্প পড়তে গিয়ে পাখিদের কাণ্ডকারখানা নিয়ে চমকে উঠতে হয়, ভাবতে বাধ্য হতে হয় পাঠককে। সঙ্গে গল্পকারের সুচিন্তিত সংযোজন, কল্পিত সংলাপ অবধারিতভাবেই চাগিয়ে তোলে পাঠস্পৃহা। পাখিদের হর্ষ বিষাদের সঙ্গী হতে হয় গল্পের সরল ও সুসজ্জিত বুনোটের গুণে। পরোপকারী পায়রাকে নিয়ে লিখা নাতিদীর্ঘ প্রথম গল্প ‘বিজনবাবুর পায়রা’তেই পাওয়া যায় গল্পকারের দক্ষ বুননক্ষমতার নিদর্শন। এই গল্প পাঠের পর পাঠকের কাছে এগিয়ে যাওয়ার বাইরে কিছুই করার থাকে না। দ্বিতীয় গল্প ‘কাকস্য পরিবেদনা’ আবার একটু ভিন্ন ধাঁচের। এখানে গল্পের বুনোটকে ছাপিয়ে গেছে লেখকের পক্ষীপ্রেম তথা তাঁর পক্ষী বিশারদ গুণের পরিচিতি। বুনোট ও ভাবনার যুগলবন্দিতে অনবদ্য হয়ে ওঠা কিছু গল্পের মধ্যে রয়েছে ‘রতনপুরের বক’, ‘বসন্ত বৌরি’, ‘অবন পাখি’, ‘কুহু বসন্ত’, ‘সাদি আর লালু’, ‘নাইটজার পাখি’, ‘বাসভূমি’ ইত্যাদি। ‘হায় চিল’, ‘খাঁচার পাখি’, ‘বাগানের বুলবুল’ গল্পগুলিও সুচিন্তিত, সুলিখিত ও সুন্দর।
বিভিন্ন গল্পের মধ্য দিয়ে সুচারু রূপে পরিস্ফুট হয়েছে পাখি-মানুষের দ্বৈত অনুভূতির যুগলবন্দি। উল্লেখ্য, কষ্টদায়ক গল্প ‘তিতিরের কান্না’, রহস্যগল্প ‘হুতুম’ ও ‘লক্ষ্মী মাসি’, অনুশোচনার গল্প ‘সুদর্শনবাবুর পাখি’, সুখের গল্প ‘কাছে থাকা’ ইত্যাদি। ‘নোটন পায়রা নিখোঁজ’ ও ‘কুটুস পুটুস’ এই দু’টি গল্প ঠিক গল্প হয়ে না উঠলেও, পড়লে পাখিদের ভাবনা ও কাণ্ডকারখানার বিচিত্র হদিশ পাওয়া যায় নিঃসন্দেহে। সুচিন্তিত বুনোট এখানেও বজায় রয়েছে যথাযথ।
‘ওস্তাদের মার শেষ রাত’-এর মতোই গল্পকার তাঁর অপূর্ব ভাবনা ও লিখনশৈলীর মাধ্যমে দুর্দান্ত প্লট সাজিয়েছেন শেষ গল্প ‘হুস’-এ। কাক ও পায়রাকে নিয়ে অনবদ্য একটি গল্প যা পড়তেই হবে না থেমে। এখানেই লেখকের যাবতীয় নৈপুণ্য। নতুন নতুন প্লট ও ভাবনাকে সঙ্গে নিয়ে একের পর এক গল্প পাঠের শেষে এ যেন ‘শেষ পাতে মিষ্টান্ন’। অতএব পাঠশেষে পাখিদের রব থেকে কলরব অবধি যে পাঠকের মননে গুঞ্জরিত হতে থাকবে বহু দিন তাতে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়।
পাকা বাঁধাই, ছাপা, অক্ষর বিন্যাস সবই যথাযথ। কিছু বানান ভুল থেকে গেছে, বিশেষ করে ৫০ থেকে ১০০ পৃষ্ঠার মধ্যে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার পছন্দসই প্রচ্ছদের সৌজন্যে তন্ময় বিশ্বাস। অলংকরণে লেখক নিজে।
গ্রন্থের বিষয় বিচিত্র এবং ব্যতিক্রমী। স্বভাবতই গভীর অধ্যয়ন, অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অবিহনে বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণের মাধ্যমে এক একটি রচনাকে গল্পের আদলে সাজিয়ে পাঠকের দরবারে পরিবেশন করা এবং আর পাঁচটি গল্প লিখার মধ্যে ফারাক বিস্তর। কলকাতার পত্রপাঠ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কমল বসুর ‘পাখি সব করে রব’ তাই ব্যতিক্রমী প্রয়াস নিঃসন্দেহে।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
'পাখি সব করে রব'
কমল বসু
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০৪৪০৯৯৭৬৮
Comments
Post a Comment