Skip to main content

সোনার মাটি


- না না; এমনিতে আপনার বৌদির হাসিটিও, চমৎকার আমি অস্বীকার করছি না খুব যত্ন করে ঈশ্বর প্রদত্ত সুন্দর দাঁত দুপাটির পরিচর্যা করেন নিয়মিত বলতে গেলে আপনার বৌদিকে বিয়ের আগে দেখতে গিয়ে ওই অমলিন শুভ্র হাসিটি দেখেই আমি মজে গিয়েছিলাম হ্যাঁ, দেখতে শুনতেও খারাপ কিছু ছিল না আজও সেই জেল্লা ধরে রাখতে পেরেছে অনেকটাই তবে ওই মিতাবৌদির ব্যাপারটা একটু আলাদা বুঝলেন ?
আমি মাথা নাড়ি বুঝেছি বুঝতে পারছি পরিতোষদা নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করছেন মিতা বৌদি কে তা আমি জানি না তবে নামটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে পরিতোষদার ঠোঁটের কোনায় ছড়িয়ে পড়া ঈষৎ মুচকি হাসির ছোঁয়া আমার নজর এড়ায়নি বস্তুত পরিতোষদার মতো বাচিক শিল্পীর কথায় এক জাদু আছে তাঁর কথায় সাধারণ কথাও অসাধারণ হয়ে ওঠে তবে আমার দুঃখ হয় এটা ভেবেই যে বাগাড়ম্বরের বাইরে মঞ্চে বা সমাজে বাচিক শিল্পী হিসেবে তিনি স্থান পেলেন না মূলত তাঁর নিজেরই দোষে বলতে হবে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন সব সময় ঘর আর অফিস এ নিয়েই তাঁর জগৎ অথচ তাঁর এই বাচিক শিল্পকে পাবলিক করলে মঞ্চ কাঁপাতেন নিশ্চিত তা - অমন একজন সঙ্গী পেলে প্রাতঃভ্রমণ ব্যাপারটা যে মধুময় হয়ে উঠবে তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে ?
প্রায় মাস খানেক আগের কথা ফ্ল্যাটে এক প্রাইভেট স্বাস্থ্য-পরীক্ষার দল এসেছে খুবই কম খরচে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার আয়োজন হয়েছে খবর পেয়ে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম আমিও নামি প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে ভরসাযোগ্য এদিকে কদিন থেকেই শরীরে একটু আধটু ব্যথা বেদনার প্রকোপ তাই ভাবলাম একটু রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিই প্যাকেজে বাইরের তুলনায় খুবই কম টাকার মধ্যে বেশ কিছু পরীক্ষার জন্য রক্ত নিয়ে গেল ওরা বলল পরদিন সন্ধ্যায় এসে রিপোর্ট দিয়ে যাবে কিন্তু পরের সন্ধ্যায় সিক্যুরিটি রুমে খবর নিয়ে জানা গেল আসেনি ওরা একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম তবে কি এমনি এমনি গচ্চা গেল এতগুলো টাকা ? কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না তবে এই দুশ্চিন্তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না তার পরদিন দুপুরেই এসে সবার রিপোর্ট জমা দিয়ে গেছে আমি অফিসে থাকায় স্বভাবতই রিপোর্টগুলো পেতে সন্ধে গড়িয়ে রাত 
এসব রিপোর্ট করতলগত হলে দেখার আর তর সয় না যথারীতি রিপোর্ট হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই চশমাটি লাগিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরলাম তিন পাতার রিপোর্টখানা সব কিছু মোটামুটি ঠিকই আছে একটা পরিতৃপ্তির ঘোরের মধ্যে পাতা উল্টে যাচ্ছি, হঠাৎ এক জায়গায় এসে আটকে গেল চোখ এ কী ? এ তো দেখছি সর্বনাশ হয়ে গেছে কী করে হলো এমনটা ? বিপদ আসন্ন মনে হচ্ছে যে কোনও মুহূর্তে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা একশোর আশেপাশে যে কোলেস্টেরল লেভেল থাকার কথা তা পাঁচশো ছাড়িয়ে গেছে খারাপ কোলেস্টেরল বেড়েছে দেদার, ভালো কোলেস্টেরল একেবারেই তলানিতে বেশ ঘাবড়ে গেলাম ভালো করে আবার দেখলাম সব কিছু না ঠিকই পড়েছি এমনকি রিপোর্টের তলায় লিখেছে অস্বাভাবিক মাত্রায় কোলেস্টেরল পাওয়ায় দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয়েছে রিপোর্ট রেখেই এবার শরণাপন্ন হলাম গুগলের জানতে পারলাম যখন তখন হার্ট অ্যাটাকের একটা ঝুঁকির মধ্যে আছি মানসিক দিক দিয়ে সচরাচর আমি ভীষণ চাঙ্গা থাকি তাই এই ঝটকাটা সয়ে নিলাম অভ্যাসবশত অন্য কেউ হলে হয়তো …… হৃদয়ঘটিত কিছু ঘটেই যেতে পারত সেই মুহূর্তেই 
পরদিন অফিসের কাজে আর কিছুতেই মন লাগাতে পারছিলাম না সব সময় একটা ভয় যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে বার চারেক বুকের বাঁদিকে হাত রেখে হৃদয়ের সাড়া পাওয়ার চেষ্টা করেছি ছন্দে ব্যাঘাত ঘটলেই এক আশঙ্কার ছায়া ছেয়ে ফেলে অন্তর এমনি কোনওক্রমে দিনটা কাটিয়ে একটু তাড়াতাড়িই ফিরে এলাম অফিস থেকে সন্ধ্যায় পড়িমরি করে ছুটলাম ডাক্তারের কাছে পরীক্ষানিরীক্ষা করে, লাইফস্টাইলের নাড়িনক্ষত্র জেনে ডাক্তারবাবু একটি ওষুধ লিখে দিলেন আর বললেন - ‘খুব হাঁটুন
সেই থেকে শুরু নিত্যদিনের প্রাতঃকালীন ছোটাছুটি কিন্তু একা একা কি আর হাঁটা যায় তেমন ? কেমন যেন বোকার মতো লাগে, অসহায় লাগে আর একা থাকলে রাজ্যের যত চিন্তা এসে ভর করে মাথায় খানিকটা হাঁটলেই মনে হয় কখন ফিরব কিন্তু এখন তো যে পরিস্থিতি তাতে হাঁটতে হবে দেদার তাই মনে মনে উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজছিলাম - যে সঙ্গী দীর্ঘকালীন হাঁটাহাঁটিতে অভ্যস্ত প্রথম কয়েকদিন প্রাতঃভ্রমণের পথে মনে মনে খুঁজতে থাকলাম সেই সম্ভাব্য সঙ্গীকে আর কয়েক দিনের মধ্যেই সেই সূত্র ধরে পেয়েও গেলাম পরিতোষদাকে পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন একদিন তাঁর ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে যেতে তিনিও বেরিয়ে এলেন দেখেছি তাঁকে আগেও, তবু পরিচয় নেই বলে সেভাবে মনেও রাখিনি এখন কে আর কাকে মনে রাখে ? সত্যি কথা বললে নিজের ফ্ল্যাটেরই অনেককে চিনি না আসতে যেতে অনেকেই হ্যালো হাই করেন, মুচকি হাসেন, গুড মর্নিং, গুড ইভনিং ইত্যাদি সৌজন্যসূচক কথাবার্তা বলেন আমিও অন্ধকারে থেকেই প্রত্যুত্তর দিয়ে সামান্য মুচকি হাসির বাহানায় লুকিয়ে রাখি আমার দৈন্য আসলে আজকের জীবনযাত্রাই যে এর জন্য দায়ী তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই সারা দিনের ব্যস্ততার শেষে সামাজিকতার সুযোগটুকু আর থাকে কই
পরিতোষদাকে দেখে মনে হল আমার চাইতে হয়ত সামান্য বড়ই হবেন বয়সে কপালের পাশে চুলে পাক ধরেছে আমার অকালপক্ক চুলগুলোরই মতো পঞ্চাশ পেরিয়েছেন সম্ভবত তবে ষাটের কম স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ বটে চেহারায়, কথাবার্তায় একটা ভদ্রজনোচিত উপস্থাপন আছে 
এদিন যেচেই পরিচয় করে নিলাম প্রথম পরিচয়েই তাঁর খোলামেলা বাচন ভঙ্গি আমার খুবই পছন্দ হয়ে গেল ভীষণ আন্তরিক মানুষটি কয়েক দিনের মধ্যেই পরিচিতির বহর বাড়তে বাড়তে সুপরিচিত হয়ে গেলাম দুজন গোটা পথ জুড়ে তিনিই সাধারণত বলেন, আমি শুধুই শ্রোতা মাথা নাড়ি উপর-নীচে কিংবা পাশাপাশি ছোট্ট দুএকটা কথা বলি হয়ত - এই যা নিত্য নতুন কথায়, গল্পে পরিতোষদা আমার প্রাতঃভ্রমণে যেন প্রাণসঞ্চার করে দিয়েছেন এই এক মাসে হাঁটার সুফলও টের পাচ্ছি শরীরের দিক দিয়ে আগের চাইতে অনেকটা হাল্কা অনুভব করছি কোলেস্টেরলের এতদিনের ভারিক্কি চাল এখন বুঝতে পারছি ক্রমশ তিন মাস পর আবার রক্ত পরীক্ষা করালে পুরো ব্যাপারটা বোঝা যাবে আপাতত পরিতোষদার সান্নিধ্যে সকাল বেলার সুখময় হাঁটাহাঁটির বাইরে আর কিচ্ছু করার নেই
- বুঝলেন মশাই ? কাল এক সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গেল
পরিতোষদা এবার সবিস্তারে বলতে শুরু করেছেন আমিও নিমগ্ন শ্রোতার মতো একবার সামনের দিকে আর একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে হাঁটছি শহরের এদিকটা এখনও যথেষ্ট সবুজ নগরায়নের ঝাপটা এসে লাগেনি বলে প্রদূষণ নেই বললেই চলে ভোরের হাওয়া তাই বয়ে আনে নির্ভেজাল অক্সিজেন তবে এই হাঁটা পথে একটু দেখে শুনে চলতে হয় বইকী এমনিতে মসৃণ পথ হোঁচট খাওয়ার ভয় নেই তবে অবাক হই দেখে যে প্রায় প্রতি রাতেই মনে হয় যেন এক ঝড় বয়ে যায় রাস্তাটির উপর দিয়ে সংলগ্ন পাহাড়ের দিক থেকে খসে আসে মাটির চাঙড়, নানা আকারের - নানা আয়তনের পাথর, জল-কাদা রাতে হয়ত পাহাড়ে বৃষ্টিপাত হয় তাই এমন হয়ে থাকে প্রায়শ তাই একটু খেয়াল রেখে পথ চলতে হয় তাছাড়া আছে বাঁদরের উৎপাত দলে দলে বাঁদর বেরিয়ে এসে এ গাছে ও গাছে লম্ফঝম্ফ করতে থাকে, কখনও রাস্তা পেরোয় দল বেঁধে কখনও আবার দুচারটে দলছুট বাঁদরও এদিকে ওদিকে দোড়াদৌড়ি করতে থাকে তাই বেশ সতর্ক হয়ে চলতে হয় কথার মধ্যে ব্যাঘাত জন্মায় স্বাভাবিক ভাবেই
বাঁদরগুলোর মানুষসুলভ চালচলন দেখে অবাক হয়ে যাই কখনও দেখি দুপায়ের উপর ভর করে সামনের পা দুটো বুকের কাছে এনে জড়ো করে রেখে মানুষের মতোই হাঁটতে থাকে অবলীলায় দেখে কেমন এক বিবর্তনের ছবি ধরা দেয় চোখের সামনে আর আছে বাঁদরামি যাকে বলে দুষ্টুমিতে এদের জুড়ি মেলা ভার মহিলাদের দেখলেই মুখ ভেংচে দেয় কখনও ভয় দেখায় মহিলাদের ভীত সন্ত্রস্ত হাবভাবে মিশে থাকে সলজ্জ ভালোলাগাও এসব দেখতে দেখতে বয়ে যায় সময় এদের সান্নিধ্যে এলে পরিতোষদার কথার গতিও ক্ষীণ হয়ে আসে এবং স্বভাবতই চলারও বেশ কদিন ধরে দেখছি ব্যাপারটা বাঁদরগুলো যখন বাচ্চাদের পিঠে কিংবা কোলে করে বসে আদর করে তখন পরিতোষদার চলার গতি ক্ষীণ হতে হতে এক সময় স্তব্ধ হয়ে যায় পুরোপুরি অপলক চোখে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন বাঁদরদের এই বাৎসল্য এই মায়ার খেলা বাধ্য হয়ে আমিও দাঁড়িয়ে পড়ি তাঁর সঙ্গে বাঁদরগুলো সসম্মানে, সসন্তানে বিদেয় নিলে তবেই আবার পথ চলতে শুরু করেন পরিতোষদা - এবং পাশাপাশি আমিও   
- কাল তো বন্ধ ছিল তাই পরশুই অফিস থেকে কিছু ফাইলপত্র নিয়ে এসেছিলাম ঘরে
হারানো খেই ঠিক খুঁজে পেয়েছেন পরিতোষদা
- তো সেগুলো নিয়ে বসে রয়েছি আমার বেডরুমের চেয়ার টেবিলে কাজ করছি আপনার বৌদি ড্রইংরুম সংলগ্ন কিচেনে ব্যস্ত দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় তখনও হয়নি রান্নাবান্না হয়ত সবে শুরু হয়েছে এমন সময় শুনতে পেলাম মিতা বৌদির আওয়াজ ওহ্, মিতা বৌদির পরিচয়টা আপনাকে দেওয়া হয়নি মিতা বৌদিরা আমাদের ফ্ল্যাটের দোতলায় থাকেন ঠিক আমাদের উপরে আমার গিন্নির বিশেষ বান্ধবী এখানে আসার পরই পরিচয় আপনার বৌদি মানে আমার গিন্নির নামটি হচ্ছে সখী সেই সূত্র ধরেই নাকি দুজনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি মোটেও সখী আর মিতার মধ্যে তো বন্ধুত্ব হবেই এটাই স্বাভাবিক নয়কি ?
বলেই হো হো করে হেসে উঠে পরিতোষদা প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকালেন আমার দিকে পরিতোষদার ভাষাজ্ঞানও অসাধারণ কথার মধ্যে রুচিশীল শব্দাবলির চমৎকার প্রয়োগ করতে পারেন যত দিন যাচ্ছে আমি যেন তাঁর ফ্যান হয়ে যাচ্ছি এবারও তাঁর কথায় সামান্য হেসে মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম পরিতোষদা কথায় মন দিলেন -
- আসলে মিতা বৌদির আওয়াজটা বুঝলেন - খুব মিষ্টি ওই অনেকটা ধরুন জলতরঙ্গ বাজনার মতো মিষ্টিমধুর তবে তাঁর সবচাইতে আকর্ষণীয় যেটা তা হল তাঁর মধুর হাসি ফিগারটাও ধরে রেখেছেন জব্বর
পরিতোষদা এগোচ্ছেন তরতরিয়ে মুখের রাখঢাক নেই তেমন আসলে অন্তর খোলা মানুষগুলো এমনই হয় নাহলে এই এক মাসের পরিচয়ে আমাকে এতটা কাছের বলে ভেবে নিয়ে সব কিছু অকপটে বলতে পারে কেউ ? এত দিনে আমি যেন হয়ে উঠেছি তাঁর অতি আপনজন, কাছের মানুষ কথার স্বচ্ছন্দ আবেশে আমি এতক্ষণে বেশ একটা জম্পেশ সত্য কাহিনির অন্দরে ঢুকে পড়েছি ভেতরের ঔৎসুক্য বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে
- যেমন তাঁর আকর্ষণীয় চেহারা তেমনি জ্যামিতি মেনে বিকশিত শ্বেতশুভ্র দাঁতের পাটি মাঝে মাঝে এদিক ওদিক যাতায়াতের ফাঁকে মুখোমুখি হলে হেসে কথা বলেন আমি চেষ্টা করি আলতো কথার ফাঁকে এমন কিছু বলার যাতে করে তাঁর মোহনীয় হাসিটির দেখা পাওয়া যায় স্বল্পকালীন এই সুখ আলাপনে আমিও নীরবে অবগাহন করি এক ভালো লাগার যাপনে মাঝে মাঝেই দুই বান্ধবীও অবসরের ফাঁকে একে অপরের ঘরে মগ্ন হয়ে ওঠেন আড্ডায় দিনের বেলা আমি সচরাচর থাকি না ঘরে কিন্তু বন্ধের দিন মিতা বৌদি এলে কেমন এক ভালো লাগায় ভরে ওঠে আমারও এই চঞ্চল চিত্ত 
তবে কাল যতটা না তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে আমি মোহিত হয়েছি তার চেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি চমকে উঠেছি সেদিন তাঁর কথার প্রসঙ্গ শুনে ড্রইংরুমের দরজা খোলার শব্দ হল শুনতে পেলাম এবং সাথে সাথেই মিতা বৌদির স্পষ্ট আওয়াজ - কী গো সখী, তুমি নাকি মাটি কিনেছ ?
আমি চমকে উঠলাম আপনার বৌদি মাটি কিনেছেন ? এ কী শুনছি আমি ? খানিকটা চমকে গিয়ে কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সখী বলল - হ্যাঁ গো ঠিকই শুনেছ বসো
এবার আমার সত্যি সত্যি ভড়কে যাবার পালা, বুঝলেন ? এ কী বলছে সখী - মানে আপনার বৌদি আরকি
- হ্যাঁ দাদা, বুঝতে পেরেছি আপনি বলুন
- কী আর বলব ভাই ? আমি তো আকাশ থেকে পড়েছি কথার কোনও সূত্রই পাচ্ছি না অথচ হঠাৎ করে মিতা বৌদি আসতেই আমার পক্ষে উঠে গিয়ে তাঁদের সামনে চলে আসাটা উচিত হবে না মোটেও এসব একটু বুঝে শুনে চলতে হয় বুঝলেন ? মহিলারা, বিশেষ করে বিবাহিত মহিলারা সাধারণত খুবই সন্দেহপ্রবণ হয়ে থাকেন এ তো আপনার জানাই আর আমার মতো নিঃসন্তান পুরুষের ক্ষেত্রে এটা চরম গোয়েন্দাগিরিতে নারী জাতি জন্মগত পারদর্শী কত বার যে আমাকে অযথা হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে তার আর ইয়ত্তা নেই অবশ্য মাঝে মাঝে নিজেরই দোষে ফেঁসে যাই
আবারও সেই প্রাণখোলা হাসি আজ জানতে পারলাম পরিতোষদা নিঃসন্তান হঠাৎ করে চমকে উঠলাম নিজেই নিজের চিন্তার সূত্র ধরে তার মানে এই নিঃসন্তান হওয়ার জন্যই পরিতোষদা রাস্তায় বাঁদরের সন্তানপ্রেম দেখে, ওদের আদর করার বহর দেখে অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন চলার মধ্যেই পিতৃহৃদয় বোধ করি উদ্বেল হয়ে উঠত বাৎসল্য রসে আমার মনের মধ্যে পরিতোষদার জন্য কেমন এক দুঃখবোধের জন্ম হল ক্ষণিক - যদিও তাঁর হাসির শব্দে সহজেই বেরিয়ে এলাম সে ঘোর থেকে 
- এই সেদিন যেমন একটা মিটিং সেরে আসার পথে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে
নব উদ্যমে ফের শুরু করেছেন পরিতোষদা......
- খুব চা খেতে ইচ্ছে করছিল বলে একটা চায়ের স্টলে ঢুকেছি আজকাল নিখাদ চায়ের দোকানগুলোও যেন কৌলীন্য হারিয়ে বিলুপ্ত হওয়ার পথে ফাস্ট ফুড এসে যেন অধিকার করে নিয়েছে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলোকে রাত হলে তো এ শহরে যত মদের দোকান দেখতে পাবেন তার সিকিভাগও পাবেন না চায়ের দোকান অথচ দেখুন একদিন এসব চায়ের দোকানে কত সরস আড্ডা হতো, কত কত সাহিত্যবাসর বসে যেত দস্তুর মতো বরেণ্য লোকেরাও এসে আড্ডা জমাতেন চায়ের দোকানের পেতে রাখা চেয়ারে বসে
তা অনেক খুঁজে পেতে শেষটায় একটি মিষ্টির দোকানের বাইরে আলাদা করে চায়ের কেটলি বসানো জায়গাটি দেখে ঢুকে পড়লাম দোকানচত্বরে ঢুকতেই দেখি সেখানে দাঁড়িয়ে এক মহিলা - মহিলা নাকি মেয়ে তা বোঝারও তো সাধ্য নেই আজকাল - অত্যন্ত দৃষ্টিকটু একটি পোশাক পরে চা পান করছেন ঊর্ধ্ব অঙ্গ অনেকটাই দৃশ্যমান হয়ে আছে তাঁর এবং এ পোশাক ইচ্ছাকৃত ভাবেই তিনি পরিধান করেছেন ভেতরে তাঁর বিন্দুমাত্র লজ্জা বা অনুশোচনা নেই যদিও আমার নিজেরই যেন কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল কোনোরকমে সামলে নিয়ে ভাবলাম - আমার আর কী ? এ তো তাঁরই দৈন্য তবে ভেতরে ভেতরে কেমন এক ঘৃণার উদ্রেক হল জানেন ? এঁদের দেখানো পথেই তো মেয়েছেলেদের পোশাক পরিচ্ছদ এখন স্লীভলেস-এর গণ্ডি পেরিয়ে থাইলেস-এ এসে পৌঁছে গেছে কালক্রমে আরো কত কিছু যে দেখতে হবে শালীনতার পরিভাষাটাই বদলে যাচ্ছে জানেন ?
তা আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে চা পানের পর্ব শেষ করে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে তবে কি জানেন ভাই, ভগবান বোধ করি পুরুষ মানুষের মস্তিষ্ক আর হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছেন যত জৈবিক তাড়না আর এরই জেরে দোকান থেকে বেরিয়ে আসার আগে অন্তত বার চারেক আড়চোখে দেখেও নিয়েছিলাম সেই মহিলা-মেয়েকে নিজেরই অনিচ্ছায়, অজান্তে অথচ দেখুন বয়স তো আর কম হল না তবু মানসিক সতর্কতার বারোটা বাজিয়ে পথচলতি আদ্দেক বয়সের মেয়েছেলের দিকে চোখ পড়ে কেন ? আসলে পুরুষ জাতি জৈবিক ভাবেই সুন্দরের পিয়াসি প্রকৃতি ও নারীদেহের সৌন্দর্য তাই সহজেই চোখ ও মনকে আকর্ষণ করে নিয়ত এ নিয়ে খুব বিব্রত বোধ করি জানেন ? কেমন এক অপরাধবোধ জেগে ওঠে নিজেরই অন্দরে শেষমেশ এটা স্বভাবজাত প্রকৃতি হিসেবেই মেনে নিয়েছি আজকাল আর নিজেকে এতটা দোষী বলে মনে হয় না মনে হয় এই অপরাধবোধের যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি অনেকটাই বলা যায় হার মেনেছি নিজের কাছে নিজেই
আবার তাকালেন আমার দিকে মনে মনে খানিকটা জরিপ করে নিলেন হয়ত আমি কীভাবে নিচ্ছি তাঁর এই খোলামেলা আত্মপ্রকাশ সম্ভবত আমাকে নিরীক্ষণ করে নিশ্চিন্ত হলেন তাই আবার শুরু করলেন -
- তো ঘরে এসে দিন দুয়েক পরে ব্যাপারটা নিয়ে খুব উষ্মা প্রকাশ করলাম আপনার বৌদির কাছে - কথায় কথায় সমাজ কী করে রসাতলে যাচ্ছে সেসব কথাই আরকি ওই আড়ালে বার চারেক দেখার কথা আর স্বাভাবিক ভাবেই এল না কথায় সব কিছু কি আর খুলে বলা যায় বলুন ? অথচ কী আশ্চর্য জানেন ? কয়েক দিন পর অন্য এক কথার সূত্র ধরে আপনার বৌদি সরাসরি আমাকে বলে দিলেন - নিজে আর কম কী রাস্তায়, দোকানে দাঁড়িয়ে স্বল্প পোশাকের মহিলাদের দিকে তো তুমিও তাকাও
আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তাই মনেই করতে পারছিলাম না কোন কথার কথা বলছে সখী অথচ প্রাঞ্জল ভাবে কী অপার মুনশিয়ানায় আপনার বৌদি সেদিনের আমারই বলা সব কথার খেই ধরিয়ে দিয়ে বিঁধলেন আমাকে আমি তাঁর বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হতে ভাবলাম - স্ত্রীয়াশ্চরিত্রং দেবা ন জানন্তি কী কুক্ষণেই না সহজ সরল মনে কথাটি পেড়েছিলাম তার কানে
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে চলে এসেছি আমরা ইতিমধ্যে এবার ফেরার পালা কথাটা পরিতোষদাকে মনে করিয়ে দিতেই বললেন -
- হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, ফিরি বলে এবার উল্টোমুখে চলতে শুরু করেই ফিরে এলেন অসমাপ্ত প্রসঙ্গে -
- হ্যাঁ, যা বলছিলাম কান পেতে স্পষ্ট শুনলাম মিতাবৌদির প্রশ্নের উত্তরে সখীহ্যাঁবলেছে এবং এর পর দুজনে কথাবার্তার স্বরগ্রাম এতটাই নীচে নামিয়ে দিয়েছে যে আর শত চেষ্টা করেও কিছু শুনতে পারছিলাম না আমি গভীর ভাবনার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছি ইতিমধ্যে সখী মাটি কিনেছে ? কোথায় ? কত দাম দিয়ে ? টাকা পেল কোথায় ? আমাকে জানালোই বা না কেন ? এমন হাজারো প্রশ্ন এসে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে যেন আপাতত অন্য কিছু ভাবতেই পারছি না আর কথার গভীরতা মাপার কোনও প্রচেষ্টাই করতে ইচ্ছে করছে না মনের মধ্যে একটাই জিজ্ঞাসা - সখী এত বড় ব্যাপারটা গোপনে সেরে নিল কিন্তু আমাকে জানানোর প্রয়োজনই বোধ করল না ? অথচ সখী জানে আমার বরাবরই এক টুকরো মাটি কিনে ঘর বানানোর শখ ছিল কত কথা হয়েছিল এক সময় এ নিয়ে তার সাথে ইচ্ছে ছিল নতুন ঘরের সামনে পিছনে কিছু খালি জায়গা থাকবে ফুলের গাছ লাগাব, সবজি বাগান করব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে কোদালবাজি করে শরীরটাকেও চাঙ্গা রাখব আর বাসস্থানের সৌন্দর্য গায়ে মেখে অবসর জীবন কাটাব জায়গা একটু বেশি থাকলে পিছনের দিকে একটা ছোট্ট পুকুরও থাকবে যেখানে খেলা করে বেড়াবে ছোট ছোট মাছ
অবসর সময়ে কত দিন এমন একটি ঘরের ছবিও এঁকেছি জানেন ? দুটো বেডরুম, একটা ডাইনিং - কিচেনের সামনেই এক পাশে ড্রইং রুম আর অন্য দিকে গ্যারেজ মাঝে এক টুকরো ব্যালকনি - গ্রিল লাগানো, যেখানে বসে বাঞ্ছারামের মতো গাছগাছালির দেখভাল করব ঘটনাচক্রে সে আহ্লাদ আর পূরণ হয়নি এখন ফ্ল্যাট বাড়িতেই গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে এই অমোঘ সত্যটা জেনেও মাটি কেনার আগে একবার আমার সঙ্গে আলোচনা করাটা প্রয়োজন মনে করল না সখী ? এ তো ঘোর ষড়যন্ত্র হৃদয়ে হাজার দুঃখ ব্যথার তোলপাড়
আমার সন্দেহের তির গিয়ে পড়ল সখীর ছোটমামার উপর অত্যন্ত স্নেহ করেন সখীকে এবং স্বভাবতই আমাকেও আসলে জগতের সব ছোটমামারা এমনই হন বোধ করি আমার ছোটমামাও এমনই ছিলেন যতদিন বেঁচেছিলেন চোখে করে রাখতেন যেন আমাকে চাইলে আকাশের চাঁদও পেড়ে দিতেন বোধ করি তাই ভাবলাম বিশাল ব্যাবসায়ী এই মামাই নিশ্চয় সখীকে এ ব্যাপারে মদত দিয়েছেন - যদিও সখী কিংবা আমি তাঁর কাছ থেকে স্নেহ আর আশীর্বাদের বাইরে কিছুই চাইনি কোনোদিন তাহলে সখীর এবার এমন কী হলো যে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সম্পূর্ণ আমার অগোচরে ?
এবার একটু নিজেকে শান্ত করে ভাবলাম এ আমার ভুল ধারণাও তো হতে পারে আসলে চিন্তা করে করে কিছুই যেন মেলাতে পারছিলাম না শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইলাম কখন মিতা বৌদি উঠে যান আর কখন উপযুক্ত সময় হয় আপনার বৌদিকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করার
পরিতোষদার বলার আবহে, শিল্পে আমি গল্পের মধ্যে আকণ্ঠ মজ্জিত হয়ে রয়েছিলাম এবার আমার চিন্তা হল ফেরত পথে আমরা ঘরে পৌঁছে যাবার আগে তাঁর এইমাটি কেনাপর্ব শেষ হবে তো ? নাহলে ভেতরে একটা জিজ্ঞাসা থেকে যাবে এই ব্যাপারটি আমার খুব নাপসন্দ্ এর জন্য আমি না তো কোনো টিভি সিরিয়্যাল দেখি না কোনো ধারাবাহিক রচনা পড়ি আমার খেই হারিয়ে যায় সতত তাই পুরো গল্পের স্বাদ পেতে পারি না তিনি সামান্য বিরাম দিতেই তাই বলে উঠলাম - এর পর ?
- এর পর এল সেই উপযুক্ত সময় ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে গিন্নি যখন চায়ের কাপ নিয়ে এ ঘরে এলেন তখন সাহস করে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম কথাটি - ‘শুনলাম তুমি নাকি নতুন মাটি কিনেছ ?’
হাতের কাপটি আমার সামনে নামিয়ে রাখে শীতের শেষে কালনাগিনীর জেগে ওঠার মতো কুণ্ডলী ছেড়ে দীর্ঘ ফণা উঁচিয়ে প্রথমে শিকার নিয়ে খেলা করার মতো ভঙ্গিতে বললেন - কোথায় শুনলে ? , দুপুরে আমাদের কথায় আড়ি পেতেছিলে তার মানে ?
আমি আবারও ব্যাকফুটে যেন কুণ্ডলীর মধ্যে প্রবেশ করছি ধীরে ধীরে আমতা আমতা করে কিছুটা বলতে যেতেই থামিয়ে দিলেন - আর কী কী শুনেছ শুনি ? আমি দেখছি মিতা এলেই তোমার চুকচুকটা বেড়ে যায় আজকাল কানটা আমাদের কথার মধ্যেই পেতে রাখো কে জানে লবিতে এসে আড়চোখে তাকাও কিনা বিশ্বাস নেই তোমাদের
আমার তখন দংশন জ্বালায় অস্থির হবার পালা মিতা বৌদিকে ভেতরে ভেতরে যে পছন্দ করি, একটা ভালো লাগার আমেজ যে অনুভব করি সে কথাটিও যথারীতি পৌঁছে গেছে গোয়ান্দাগিন্নির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অবধি সত্যি কী বিচিত্র সৃষ্টি বিধাতার
নিজেকে কী করে নির্দোষ, নিরপরাধ, গোবেচারা স্থাপন করব সেই চিন্তা করতে থাকার মধ্যেই এবার শেষ দংশনে প্রবৃত্ত হলো কালনাগিনী আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ব্যালকনির দিকে যেতে যেতে বলল - চলো দেখাব তোমাকে মাটি
আমি তো এবার সত্যিই চমকে উঠেছি ব্যালকনি থেকে যে খালি পড়ে থাকা মাটিটি দেখা যায় তার দাম তো আকাশছোঁয়া কোটি টাকার এক একটি খালি প্লট এমন জায়গায় গিন্নি মাটি কিনেছেন, আমারই অগোচরে ? আমার দুচোখের মণি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে পা দুটো যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে
এমন অবস্থাতেই টানতে টানতে আমাকে ব্যালকনিতে নিয়ে এসে একটা নতুন টবের পাশে সদ্য কিনে আনা একটি থলিতে কিছু উর্বর মাটি দেখিয়ে বললেন - এই যে দ্যাখো আমার নতুন মাটি
###
ব্যালকনিতে অসংখ্য গাছগাছালির সংসার গিন্নির হাতের পরশমণির ছোঁয়ায় তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে সব এক সন্তানহীনা নারীর সারা দিনের সন্তানসম পরিচর্যায় আমি মাঝে মাঝেই ব্যালকনিতে এসে দেখি এসব নিভৃতে কথা বলি তাদের সঙ্গে, সবার চোখ এড়িয়ে ভালো লাগে আমারও অথচ আজ মিতাবৌদির একটি কথায় আমি এসব ভালো লাগার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমার সখীকে সন্দেহের চোখে দেখলাম ?
ততক্ষণে উদ্ধত কালনাগিনী তার ফণা নামিয়ে শেকড়চ্যুত লতার মতো নিমেষে নেতিয়ে পড়েছে আমার বুকে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে এক রিক্ত নারীর নিভৃতে লালিত শোকের বিন্দু বিন্দু তপ্ত অশ্রু অনুশোচনায় বিদ্ধ হতে হতে সখীর দুটি হাত আমার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে শুধু বলতে পারলাম -
- “আমার প্রিয় সখী, তোমার এ সোনার মাটি ভরে উঠুক সোনার ফসলে
###
দেখলাম পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের কোণটি মুছে নিলেন পরিতোষদা আমিও উল্টোদিকে তাকিয়ে হাতের চেটো দিয়ে তাই করলাম

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়