Skip to main content

উত্তরণের দায়ভার নিয়ে উন্মোচিত - শারদীয় সংখ্যা ‘তৃতীয় ভুবনের সাহিত্য’


যথাসময়েই প্রকাশিত হয়েছে এবারের অর্থাৎ ১৪৩০ বাংলার পূজা সংখ্যা ‘তৃতীয় ভুবনের সাহিত্য’। ভারে - প্রতিবারের ন্যায় এবারও ওজনদার হয়েছে পূজা সংখ্যা হিসেবে গোটা উত্তরপূর্বের অন্যান্য পত্রিকার চাইতে। ধারে - কতটা শানিত হল একবার দেখে নেয়া যাক।
এই পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হতে হতে এবার অষ্টম সংখ্যায় পদার্পণ করল যদিও এই অঞ্চলের (সম্পাদকের মতে তৃতীয় ভুবনের) পাঠক তথা কবি-সাহিত্যিকদের নজরে তা কতটা আসে তা বোঝার উপায় নেই। কারণ কোথাও এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না। এর অন্যতম একটি কারণ হল এই যে অনেকেরই এই ‘তৃতীয় ভুবন’ শব্দটিতে ঘোর আপত্তি রয়েছে। তাঁদের মতে সাহিত্যের ভুবনায়ন সঠিক নয়। অথচ স্পষ্ট একটি বিভাজন যে রয়েছে তা কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার্য নয়। বৌদ্ধিক মহলে এবং উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টির আঙিনায় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এবং ভাষা সাহিত্যের প্রয়োগজনিত উৎকর্ষে বাংলাদেশের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে এক উল্লেখনীয় বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায় এই অঞ্চলের সাহিত্যের। তাছাড়া উত্তরপূর্বের এই সাহিত্যভুবনের ভাষার বিরাট বৈচিত্র্য, বহু ভাষাভাষী মানুষের উপস্থিতির প্রভাবমুক্ত হতে পারে না এ অঞ্চলের সাহিত্য। সেই হিসেবে তৃতীয় না হলেও এক ব্যতিক্রমী ভুবন যে তা অনস্বীকার্য।
সম্পাদকের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালনের অঙ্গ হিসেবে বেশ কিছু নতুন কবি লেখকের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে এবারের সংখ্যায়। গদ্য ও পদ্যের বিন্যাসে ২৭১ পৃষ্ঠার বিশাল সম্ভার। নিয়মিত পূজা সংখ্যা হিসেবে উত্তর পূর্বের সর্ববৃহৎ নিঃসন্দেহে। লেখক কবিদের সূচিতে চোখ রাখা যাক - কলম ধরেছেন আশুতোষ দাস, সুশান্ত ভট্টাচার্য, শিখা দাশগুপ্ত, অরুণ চট্টোপাধ্যায়, শিবানী গুপ্ত, শিপ্রা শর্মা, ঋতা চন্দ, দেবলীনা সেনগুপ্ত, মন্টু দাস, সুদীপ ভট্টাচার্য, মীনাক্ষি চক্রবর্তী সোম, সত্যব্রত চৌধুরী, শঙ্করী চক্রবর্তী, আদিমা মজুমদার, অরূপ কুমার ভূঞা, চান্দ্রেয়ী দেব, রঞ্জিতা চক্রবর্তী, জয়িতা চক্রবর্তী, জয়শ্রী ভট্টাচার্য, পূর্ণিমা রাণী দে, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, ড. গীতা সাহা, ছন্দা দাম, শান্তনু মজুমদার, সুবল চক্রবর্তী, রাজকুমার ধর, রাহুল দাস শাস্ত্রী, মণিকা বড়ুয়া, সুমি দাস, গীতা মুখার্জি, শুক্লা চন্দ, অভিষেক সেন, সুচরিতা সিংহ, পূরবী নাথ, বিপ্লব গোস্বামী, শুক্লা মিশ্র, সীমা ঘোষ, মাশুক আহমেদ, বাহারুল ইসলাম মজুমদার, বনশ্রী চৌধুরী, ডালিয়া সিংহ, প্রতিমা শুক্লবৈদ্য, সমীরণ চক্রবর্তী, ডাঃ প্রদীপ দে, সন্তোষ কুমার দত্ত, পরিমল কর্মকার, সম্পাদক নারায়ণ মোদক, বিমলেন্দু চক্রবর্তী, কস্তুরী হোম চৌধুরী, শতদল আচার্য, বন্দনা সেনগুপ্ত, সহযোগী সম্পাদক গৌতম চৌধুরী, শিপ্রা পুরকায়স্থ ও রতন চন্দ। প্রবীণ থেকে নবীনের সঠিক অনুপাত। পূর্ববর্তী সংখ্যাসমূহের তুলনায় বেশ কয়েকজন নতুন কবি লেখকদের অন্তর্ভুক্তি নিঃসন্দেহে বিস্তৃত করে তুলেছে পরিসর। বরাবরের মতোই সব কবি লেখকদের সাদা কালো ছবিও সন্নিবিষ্ট হয়েছে তাঁদের রচনার শুরুতে। কিছু কবিতা, কিছু প্রবন্ধ ও গদ্য থেকে কিছু উৎকৃষ্ট উদ্ধৃতি তুলে ধরার লোভ শুধু আলোচনার পরিসরের কথা মাথায় রেখে সংবরণ করা হল।   
পত্রিকায় কিছু প্রবীণ কবি লেখকের গদ্য পদ্যে বরাবরের মতোই সেকেলে ছাপ বজায় থেকেছে যদিও আধুনিক আঙ্গিকের একাধিক গদ্য ও পদ্যের অন্তর্ভুক্তিতে পূর্ববর্তী সংখ্যাসমূহের চাইতে ধারেও তাই উত্তরণ ঘটেছে সংখ্যায়। প্রবীণ কবি সাহিত্যিকের পুরাতন ধাঁচের লেখালেখিকেও একেবারে বাদ দিতে পারেন না একজন দায়বদ্ধ সম্পাদক - এটাও মানতেই হবে। তাছাড়া সাহিত্য হোক কিংবা সংস্কৃতি - নতুন এসে পুরাতনকে একেবারেই নিঃশেষ করে দেবে এমন ভাবনাও সঠিক নয়। এ সংখ্যায় কিছু গদ্য, কিছু কবিতা - বলা ভালো - অধিকাংশই সুপাঠ্য, সুলিখিত এবং গুণগত মানে অনেকটাই উচ্চতায় উপস্থাপিত হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন উত্তর পূর্বের পাঠকদের কাছে এই পত্রিকাটি ব্যাপক আকারে পঠিত হওয়া প্রয়োজন তেমনি উত্তর পূর্বের এই বিশাল সাহিত্যক্ষেত্রকে, বিশেষ করে ত্রিপুরাকে আরোও বেশি করে স্থান দিতে হবে পরবর্তীতে। বরাক ও ব্রহ্মপুত্র, নাগাল্যান্ড, মেঘালয়কে সন্নিবিষ্ট করে ভুবনের সংজ্ঞাকে যাথার্থ্য প্রদান করতে হবে। সর্বাঙ্গীন সাহিত্যক্ষেত্রে আজকের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ কাজটি দুরূহ নিঃসন্দেহে। তবু এমন দায়ভার যে শুধু নারায়ণ মোদকের মতো পোড় খাওয়া সম্পাদকদের পক্ষেই সম্ভব তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাহলেই প্রকৃতার্থে সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে পত্রিকার এই নামকরণ।
বিভিন্ন আঙ্গিকেই এই পত্রিকাটি ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। এ সংখ্যার উৎসর্গও ব্যতিক্রমী। ‘যাঁরা সফলতার শিখরে পৌঁছে দিতে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ করে ভারতের মুখ সারা বিশ্বে উজ্জ্বল করেছেন ইসরোর বৈজ্ঞানিকদের আমরা নতমস্তকে জানাই অভিনন্দন’। এই উৎসর্গের মাধ্যমে এই ভাবনাটি স্পষ্ট হয়ে উঠল যে সাহিত্য বা সাহিত্যিক শুধু একই আঙ্গিকে দায়বদ্ধ না হয়ে সমাজ, বিজ্ঞান, দেশপ্রেম আদি পারিপার্শ্বিকতায়ও সর্বান্তঃকরণে দায়বদ্ধ থাকেন। সম্পাদকীয়তেও বহু ব্যবস্থা-অব্যবস্থার জ্বলন্ত নিদর্শন তুলে ধরেছেন সম্পাদক। সোজাসাপটা এমন সম্পাদকীয় পত্রিকার মান বাড়িয়েছে বহুগুণ। উদ্ধৃতি না দিয়ে এমন বিরল সম্পাদকীয় তুলে রাখা হলো পত্রিকা পাঠকের জন্য।
এত বিশাল এবং সময়ভিত্তিক আয়োজনে বিভিন্ন কারণে একশোভাগ শুদ্ধতা আশা করা যায় না। এবং এর ব্যত্যয় ঘটেনি এবারও। ফলত গত সংখ্যার তুলনায় এবারে বানান ও ছাপার ভুলের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। এর বাইরে সেমি হার্ডবোর্ড বাঁধাই, অক্ষর বিন্যাস ও পত্রিকার অলংকরণ মাঝারি মানের। সুদীপ ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদ নান্দনিক হলেও নামলিপির ফন্টসাইজ বড়ো হওয়া প্রয়োজন ছিল। সব মিলিয়ে নানাবিধ বৈচিত্র্যসম্পন্ন এক অবশ্যপাঠ্য পূজাবার্ষিকী - বিজ্ঞাপনবিহীন ‘তৃতীয় ভুবনের সাহিত্য’ - পড়তে হয়, নাহলে অজানা থেকে যায় এই ভুবনের সাহিত্য-বিশ্ব।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫০৭৬০৬৯ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়