Skip to main content

গরজে, আয়োজনে দৃষ্টিনন্দন ‘প্রবাহ’ - শারদ পর্যায় ২০২৩


শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পত্রিকা সম্পাদকদের সেই যে দৌড়ঝাঁপ তার অবসানে উৎসবের আমেজে ঘটে তাঁদের দায়মুক্তি। এবং এর পরের দায় শুধুই পাঠকের। এই দায় মোচন হতে হতে পেরিয়ে যায় হেমন্ত, পেরিয়ে যায় হয়তো বা শীতকালও।
পত্রিকা প্রকাশের এমনই দায় নিয়ে সাহিত্যিক জহর দেবনাথের সম্পাদনায় অন্যান্য বারের মতো এবারেও ত্রিপুরার ধলাই জেলার কুলাই থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রবাহ’ পত্রিকার শারদ পর্যায় ২০২৩ - সার্বিক ২৫ তম সংখ্যা। চমকপ্রদ প্রচ্ছদটি প্রথম প্রেমের মতোই লেগে থাকে চোখে। নেশা ধরায় ভেতরের পৃষ্ঠাগুলোতে প্রবেশ করার। প্রচ্ছদের সৌজন্যে পুস্পল দেব। পত্রিকার আয়তন বড়ো হওয়ায় গায়ে গতরে ভারী না হলেও আয়োজন নেহাত কম নয়। ৬৬ পৃষ্ঠার পত্রিকাটিতে রয়েছে ৭৫টি কবিতা, ৮টি ছোটগল্প, ৫টি অণুগল্প, ১টি বড়গল্প এবং ৭টি প্রবন্ধ।
সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা পড়া শেষ করে কবিতা পাঠ শুরু করে কিছুটা এগোতেই পাঠকমননে ধরা পড়বে - এবারের থীম - ‘সবার উপরে মানুষ সত্য ……’। আজকের দিনে এই কথাটি যেন আরোও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সুতরাং যথার্থ ভাবনাপ্রসূত এই বিষয় এতে কোনও সন্দেহ নেই। স্বভাবতই প্রতিটি রচনা এই থীমের উপরেই লেখা হয়েছে। এবং এর ফলে, বলতে দ্বিধা নেই পদ্য বিভাগ কিছুটা হলেও দুর্বল হয়েছে। এর একটা সম্ভাব্য কারণ এই হতে পারে যে থীমনির্ভর কবিতা লেখা একদিকে যেমন তুলনামূলকভাবে এক কঠিন কাজ তেমনি কবিমনে লাগাম পরালে কবিতার উৎকর্ষ কিছুটা হলেও ম্লান হতে বাধ্য। কবি মন চিরকালীন এক উড়ন্ত বলাকার মতো অবাধ বিচরণেই স্বতঃস্ফুর্ত। তবু প্রশংসার স্থান এটাই যে একটি সংখ্যায় ৭৫টি কবিতার অন্তর্ভুক্তি এক অতি সাহসী এবং চমকপ্রদ প্রাপ্তি। কবিতায় কলম ধরেছেন যাঁরা তাঁরা হলেন - মণিকা বড়ুয়া, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, স্বপ্না চৌধুরী (ভট্টাচার্য), অপাংশু দেবনাথ, শর্মিষ্ঠা মাজি, হরিদাস দেবনাথ, নারায়ণ মোদক, চৈতালী ধরিত্রীকন্যা, ড. ব্রজগোপাল মজুমদার, সঞ্জীব দে, অভীককুমার দে, দীপ্তি চৌধুরী ঘোষ, নিশীথ রঞ্জন পাল, বিজন বোস, কল্যাণী ভট্টাচার্য, ভীষ্মদেব মণ্ডল, শশাঙ্কশেখর পাল, চৈতালী সান্যাল, বিমল মণ্ডল, বীরেন্দ্রনাথ মহাপাত্র, পুস্পিতা চট্টোপাধ্যায়, বিধানেন্দু পুরকাইত, সৌহার্দ্য সিরাজ, জয়ন্তী দেবনাথ, মৌসম সামন্ত, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, পদ্মশ্রী মজুমদার, পরিমল কর্মকার, সন্দীপ সাহু, অমৃকা মজুমদার, হারাধন বৈরাগী, নিরঞ্জন দাস, মীনা কুমারী দেবী, সঞ্জয় সোম, কিশোর কুমার অধিকারী, রত্না দেব, রণজিৎ রায়, জাহিদ রুদ্র, বাপ্পাদিত্য দে, রোজী নাথ, সুজিত দে, বিশ্বজিৎ নাগ, সুচিত্রা দাস, শুকদেব দে, গোবিন্দ ধর, সৌরভ পাত্র, ইলা দাস, ছোটন গুপ্ত, প্রদীপ কুমার সামন্ত, দেবশ্রী দে, খোকন সাহা, পার্থ দত্ত, শান্তা চক্রবর্তী, শ্যামলকান্তি দে, সানী ভট্টাচার্য, অঞ্জনা খাওয়াড়ে, রসরাজ নাথ, রতন রায়চৌধুরী, প্রসেনজিৎ কুমার পাল, রাজীব চন্দ্র পাল, বিউটি শুক্লদাস, কার্তিক দেবনাথ, দীপক রঞ্জন কর, মন্টু দাস, অমূল্য ভৌমিক, বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী, ভার্গব অধিকারী, অসীমচন্দ্র পাল, কাজলকান্তি রায়, প্রসেনজিৎ রায়, নিমাই মাইতি, নীহার রঞ্জন দেবনাথ, সৌরভ দেবনাথ, তরুণ মিত্র ও খোকন সাহা। দেখাই যাচ্ছে নামি দামি কবি সহ নবীন ও প্রবীণের এক চমৎকার সংযোজন। এ আয়োজন প্রশংসার দাবি রাখে।
সব ধরণের গল্প মিলিয়ে রয়েছে মোট ১৪টি গল্প। লিখেছেন সমরেন্দ্র বিশ্বাস, পান্না দেবনাথ, দিব্যেন্দু নাথ, পার্থসারথি চন্দ, মিঠুন রায়, জবা চৌধুরী, সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ, অলক দাশগুপ্ত, সুস্মিতা দেবনাথ, ওমর খালেদ রুমি, স্বাতী দত্ত, স্বর্ণকমলিকা চক্রবর্তী, শুভাশীষ রায় ও রীতা ঘোষ। ভালো মন্দ মিলিয়ে রয়েছে গল্পগুলি। প্রতিটি গল্পেই গল্পের বুনোট, ছাঁচ ও ভাষার সাবলীলতাকে ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে বিষয়। তারই মধ্যে পান্না ও মিঠুনের অণুগল্প, সুস্মিতা ও রুমির ছোটগল্প এবং রীতা ঘোষের বড়গল্প ভাবপ্রধান হলেও তুলনামূলকভাবে সুলিখিত। স্বাতী দত্তের গল্পে দুই বক্তার কথার মধ্যে কোনও বিরাম না থাকায় পাঠ দুরূহ হয়েছে। স্বর্ণকমলিকার গল্পে অনুবাদ গল্পের ছোঁয়া এলেও উল্লেখ নেই তার।
সংখ্যার অন্যান্য বিভাগের তুলনায় প্রবন্ধ বিভাগ এগিয়ে রয়েছে খানিকটা হলেও। বিষয় ভাবনার উপর লিখিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে বিশেষোল্লেখের দাবি রাখে জ্যোতির্ময় রায়, সৌম্যদীপ দেব ও সবিতা দেবনাথের প্রবন্ধ। সৌম্যদীপের নিবন্ধে ‘ভরত’-এর স্থানে ‘ভারত’ ছাপা হয়েছে। কাজী মিনারা বেগমের রচনাটি কবিতা না প্রবন্ধ এ নিয়ে সম্পাদকও হয়তো ছিলেন সংশয়ে। এছাড়াও এ বিভাগে কলম ধরেছেন দেবোপম রায়, পহেলী মুখার্জি ও শেখর ভট্টাচার্য।
শারদীয় এই সংখ্যাটি এক বিশাল আয়োজন সন্দেহ নেই তাতে। তবে সব চাইতে উল্লেখ্য সংখ্যার অক্ষরবিন্যাস, অলংকরণ ছাপাই ও ভাবনা। বানানের উপর অধিক মনোযোগী হওয়ার সুযোগ রয়েছে পরবর্তীতে। পত্রিকা প্রকাশে সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকায় এদিকটা প্রায়শ থেকে যায় অবহেলিত, যার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পত্রিকার সার্বিক মানদণ্ডের উপর প্রতিফলিত হয়। তাছাড়া সূচিপত্র ও সংখ্যার বিবরণ (টাইটেল ভার্সো) - এ দুটি বিভাগের মধে কিছুটা গ্যাপ থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় ক্ষণিক বিভ্রান্তির সুযোগ রয়ে যায়।
সব মিলিয়ে বিষয় ভাবনায়, আয়োজনে ও গরজে এক দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা - শারদ পর্যায় ‘প্রবাহ’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ৩০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৪১৪৯৪৩৮০২ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়