সবগুলো বর্ষা একই রকম হয় না। কিছু বেয়াড়া বর্ষা
কুক্ষিগত করে নেয় আদ্ধেক শরৎ। এবার যদিও তেমনটি হয়নি। বৃষ্টিবিহীন শরতের সকাল
বেলার আমেজ গায়ে মেখে যাদের দিন শুরু হয় তারা ভাগ্যবান, পয়মন্ত।
রেলে করে যমুনাপার স্টেশনে বা বাস
ধরে স্টেশন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ডে নেমে প্রায় দু’মাইল পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়
স্বপনপুর। আসলে প্রীতমের গৃহশহর থেকে ট্রেনে সরাসরি এখানে আসার কোনো
উপায় নেই। তাই বাসে করে আসাই সহজতর পথ।
স্বচ্ছ শরতের এক নির্ঝঞ্ঝাট সকালে বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে ওরা দু’জন সরাসরি ঢুকে গেল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন চা-জলখাবারের সারি সারি দোকানগুলোর একটিতে। প্রীতমের সঙ্গে আজ উৎপলও এসেছে। দুই বন্ধু মিলে দু’দিনের জন্য বন্ধু অজিতের বোন শ্রীলেখার বিয়েতে জমিয়ে ফুর্তি করার অভিপ্রায়ে বেরিয়েছে। বিবাহ নামক বন্ধনে জড়িয়ে পড়ার আগে এই বয়সে এই যৌবনযাপন বড্ড উপভোগ করে প্রীতম। যেন এক বন্ধনহীন উড়ন্ত বেদুইন। উৎপলও বাকচাতুর্যে কম যায় না। বলতে গেলে নন-স্টপ বকবক করেই চলেছে। প্রীতম আবার খানিকটা স্বল্পবাক। খুব সতর্ক নজর রেখে চলে বাইরে বেরোলে। তার চোখালো দৃষ্টির বাইরে থেকে থাকে না কিছুই।
দোকানগুলোর কাছে পৌঁছোতেই দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোকরা কর্মচারীগুলো হাঁকডাক শুরু করে দিল - আসুন দাদা, আসুন। চা, পুরি, পরোটা, গরম গরম ভাত …।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় সবগুলো দোকানের একই ছিরিছাঁদ। বাইরে একটি টেবিলের উপর সবগুলো পদ সাজিয়ে রাখা আছে যত্ন করে, ভোক্তার রসনা বাড়িয়ে তোলার মতো করে। এক নজরে সবগুলো দোকানের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে এরই মধ্যে অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন একটি দোকানে ঢুকে পড়ল প্রীতমরা। বাইরে ঘরে খরিদ্দার জোটানোর কাজে নিযুক্ত দু’টি ছেলের বাইরেও ভেতরে পরিবেশনকারী আরোও দু’জন লোক রয়েছেন। অস্থায়ী কাউন্টারের পিছনে চেয়ারে বসে আছেন ভুঁড়িওয়ালা ম্যানেজার কিংবা মালিক। তাঁকে দেখলেই বোঝা যায় এ লাইনে বহুদিন ধরে তাঁর পসার। প্রীতমরা ঢুকতেই যেন প্রাণচঞ্চল হয়ে পড়ে গোটা দোকানঘর বা হোটেল কাম রেস্টুরেন্ট। পেড়ে রাখা টেবিলগুলোর মধ্য থেকে একটা বেছে নিয়ে একটি ছোকরা চেয়ারগুলো ঠিকঠাক করে তাদের আহ্বান করল - বসুন দাদা। কী খাবেন বলুন। বাইরে জল রাখা আছে, হাত মুখ ধুয়ে নিন। তাদের এই ব্যস্ততা দেখে কিছুটা বিব্রত বোধ করে প্রীতম। উৎপলও খানিক অস্বস্তি বোধে আক্রান্ত বলে মনে হল। প্রীতম একটি চেয়ারে বসে ধীর কণ্ঠে উৎপলকে বলে - দেখছিস না, খদ্দের নেই একেবারেই। তাই কেউ এলে তাদের ওরা ভগবানের মতোই পুজো করতে চায়। এতেই তো তাদের পেটপূর্তি, সংসার সামলানোর উপায়। কী খাবি বল।
একটি করে লাগেজ এনেছে দু’জনেই। কাউন্টারের পাশে মাটিতেই সেগুলো রেখে হাত মুখ ধুতে টেবিলের উপর রাখা জলভর্তি জগটি হাতে নিয়ে বাইরে বেরোতে গিয়ে ধীর কণ্ঠে উৎপল বলে - এখানেই ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া ভালো হবে মনে হয়। প্রীতম শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না।
বাইরে বেরোনোর পথেই একফালি বারান্দার এক দিকে একটি কাঠের টেবিলের উপর আলাদা আলাদা পাত্রে সাজিয়ে রাখা আছে কিছু ফুলকো লুচি, ঘুগনি, সাদা ঝরঝরে ভাত - যা থেকে সামান্য ধোঁয়া তখনও উড়ছে। কিছু পাত্র ঢাকনি দিয়ে ঢাকা আছে; সম্ভবত ভাতের সঙ্গের ডাল এবং সবজি ও অন্যান্য তরকারি। একটি পাত্রে কিছু বড় মাছের টুকরো আদ্ধেক ভাজা করে রাখা এবং একটি পাত্রে গোটা গোটা ছোট মাছ ভাজা। কতক্ষণ থেকে না জানি এগুলো এভাবেই খোলা পড়ে রয়েছে। ধুলো বালি এসে জমা হচ্ছে নির্ঘাত। ছোট মাছগুলো দেখে প্রীতমের বুভুক্ষা চাগাড় দিয়ে উঠছে যেন। ওদিকে উৎপল তো চিরপেটুক। মুখে যদিও বলছে না কিছুই তবু পদগুলোর দিকে তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে হাসি পেয়ে যায় প্রীতমের। বলে - কী রে, ভাত খাবি ?
অর্ডার নেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন মালিক - কর্মচারী। উৎপল আমতা আমতা করে শেষটায়
নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ খানিকটা প্রত্যয়ের সুরেই বলে - না রে। এখন তো প্রায় এগারোটা বেজে গেল। ওদের ঘরে পৌঁছে ফ্রেশ হতে হতে তো দুপুরের খাবার সময় হয়েই যাবে। তার চাইতে এখানে ব্রেকফাস্টটাই সেরে নেওয়া ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে। তুই কী বলিস ?
উৎপলের প্রশ্নে সায় দেয় প্রীতম। মালিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে - জলখাবার কী হবে ?
- আজ্ঞে, পুরি-সবজি নিয়ে নিন। গরম গরম ভেজে দিচ্ছি।
- চা হবে ? জানতে চায় প্রীতম।
- হবে। কী চা খাবেন ? দুধ চা নাকি লিকার ?
- লাল চা-ই নেব।
- চিনি খাবেন তো ?
- হ্যাঁ। আগে পুরিটা দিন, তারপর চা।
- ঠিক আছে। বলেই সবাই মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ক্রেতা ভগবানকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে।
খানিকটা সময় লাগবে। প্রীতমরা ফের বাইরে বেরিয়ে এল। আশেপাশে একটু উঁকি মেরে দেখতে চাইল জায়গাটা। পিছনে খানিকটা উঁচু লাইন ধরে রেলের ট্র্যাক। সামনে বাসরাস্তা। পিচগুলো উঠে উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। বাস রাস্তার ওপারে সারি সারি বসত ঘর। কাঁচা-পাকা। দু’একটি দোতলা ঘরও চোখে পড়ল। লোকজন খুব একটা নেই। বোঝাই যাচ্ছে এখানে বাস কিংবা ট্রেন এলেই কর্মব্যস্ততা বেড়ে ওঠে। এর বাইরে আপাত নির্জনতাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি। প্রীতমরা জানে ওই রেললাইনটি স্টেশন পেরিয়ে যেদিকে গেছে ওদিকেই কিছু পথ হেঁটে গিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরতে হবে তাদের। গ্রামের রাস্তায় হাঁটাচলা করতে ভালোই লাগে প্রীতমের। সবুজের সান্নিধ্যে সাড়া জাগে প্রাণে। অনেক অনেক গ্রামে ঘুরতে গিয়েছে প্রীতম। কিছু কর্মসূত্রে, কিছু এমনি - বেড়ানোর উদ্দেশে। এ রাস্তার হদিশ পুরোটাই জেনে রেখেছে অজিতের থেকে। এবার কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়াই ভালো। দোকানের দিকে পা বাড়াতেই হাঁক পাড়ে কর্মচারী ছেলেটি - দাদা, হয়ে গেছে। এসে পড়ুন।
ফিরে এসে হোটেলে ঢোকার মুহূর্তে আবার চোখ যায় ছোট ছোট মাছগুলোর দিকে। মাছগুলোকে দেখে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। উৎসাহী উৎপল ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করে - এগুলো কী মাছ ?
- আজ্ঞে এগুলোকে এখানে
‘মিছরি মাছ’ বলে। খেতে খুব সুস্বাদু কিনা ? অনেকটা ব্রহ্মপুত্রের বোরিয়লা মাছের
মতো। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীতে খুব পাওয়া যায় এগুলো। বলতে গেলে মিছরি মাছ
যমুনার এক বিশেষ মাছ। তবে এ মাছ বাইরে যায় না। কারণ ডাঙায় এ মাছ বেশিক্ষণ বাঁচে
না। তাছাড়া যমুনা তো ছোট নদী তাই এত বেশিও হয় না যে বাইরে চালান করা যায়। খাবেন
নাকি স্যার ? দু’প্লেট ভেজে দিই তাহলে ?
প্রীতম ও উৎপল চাওয়াচাওয়ি করে পরস্পরের দিকে। নির্বাক উৎপলের চোখে মুখে লুক্কায়িত খুশির ঝিলিক প্রীতমের চোখ এড়ায় না। উৎপলকে নির্বাক রেখেই প্রীতম বলে -
- এক কাজ করুন। এক প্লেটই দিন। দু’ভাগ করে দু’জনকে দিলেই হবে।
- ঠিক আছে স্যার। - আবার সাময়িক কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায় হোটেলের অন্দরমহলে। ইতিমধ্যে বাইরে আবারও হোটেল বয়দের মুখরতা বেড়েছে। বোধ হয় আবারও একটি বাস এসে পৌঁছেছে। কারণ কোনো ট্রেন আসার তো শব্দ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া খানিকক্ষণ আগে একটি মালগাড়ি বেরিয়ে গেছে তীব্রবেগে। বাস থেকে বেশ ক’জন যাত্রী নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁকডাক শুরু হল ছেলেছোকরাদের - আগের মতোই। একজন যাত্রী এসে ঢুকলেন প্রীতমদের হোটেলে। এবার তাঁকে নিয়েও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মালিক-কর্মচারী।
ইতিমধ্যে পুরি-সবজি শেষ হয়ে চা এসে গেছে প্রীতমদের টেবিলে। বয় এসে বলল - স্যার, চা-টা খেয়ে নিন। মাছ ভাজা হচ্ছে।
প্রীতম বলল - মাছ ভাজা দেওয়ার পর আবার দু’কাপ চা দিয়ে যাবে, কেমন ?
- ঠিক আছে স্যার।
বসে বসে প্রীতম ভাবে এই মাছগুলো সত্যিই বিশেষ। এক একটি নদীর এক এক রকম বিশেষত্ব। বোরিয়লা মাছ প্রীতম খেয়েছে। অতি সুস্বাদু নাছ। চার-পাঁচটি মাছ ভাজা হলে এক থালা ভাত সাবাড় করে দেওয়া যায় অনায়াসে। তেমনি হয়তো এই যমুনার মিছরি মাছ। নদীগুলোও যেন মানুষের মতো। একই নামের একাধিক নদী। কোথায় সেই উত্তর ভারতের নদী যমুনা আর কোথায় এই অজ্ঞাত অজ সব গ্রামের পর গ্রামের বুক চিরে প্রবাহিত অখ্যাত এই যমুনা।
ভাবতে ভাবতেই এসে গেল মাছ ভাজার প্লেট। এগুলোও চমৎকার। অনেকটা বোরিয়লারই মতো। তবে তার আকৃতিতে কিছু ফারাক আছে। ভেজে খাওয়ার উপযুক্ত বটে।
জম্পেশ করে মেছো চা-জলখাবারের পর এবার বিল মিটিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল উভয়েই। অজিত যেমনটি বলেছে সে হিসেবে প্রায় দু’মাইল পথ এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। বর্ষাশেষে ধুলোহীন পথে যেতে মন্দ লাগার কথা নয়। শরতের প্রারম্ভে গরমের দাপট অনেকটাই কমে এসেছে। রেললাইন ধরে এগোয় ওরা। পিঠে ব্যাগ নিয়ে স্বচ্ছন্দে এগোতে থাকে কখনো লাইনের পাশ দিয়ে, কখনো স্লিপারের উপর পা রেখে - সন্তর্পণে। নিজেদের মধ্যে চলতে থাকে রাজ্যের বিষয়বহির্ভূত কথোপকথন। উৎপল আবার কথা বলতে একটু বেশিই পছন্দ করে। বলে - “আশ্বিনে কিন্তু বিয়ে হতে সচরাচর দেখ যায় না। কী বলিস” ?
- হ্যাঁ। তবে আমার দিদির হয়েছিল, জানিস তো ?
- তাই ?
- হ্যাঁ। তবে অজিতের বোনের বিয়ে আশ্বিনে হওয়াতে ওর কিছুটা অসুবিধেই হল বলা যায়।
- কী করে ?
- সামনে পুজো। এখন কেনাকাটার মরশুম। এমনিতেই অজিতের ইলেক্ট্রিক সামগ্রীর দোকান তেমন রমরমিয়ে তো আর চলে না। সেক্ষেত্রে এ সময়টাই ওদের জন্য মোক্ষম সময়। তাই বললাম আরকি।
- তা সত্যি। তবে আমি ভাবছি কি এই বোনের বিয়ে হয়ে গেলে অজিতও আমাদের মতো ‘রেডি টু মেরি’ হয়ে যাবে। কী বলিস ?
হাসে প্রীতম। এই বয়সে বিয়ে বাড়িতে থাকতে যাওয়ার মধ্যে আলাদা একটা আমেজ আছে। তা যতটা না বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড় তার চাইতেও বেশি কিছু একটা প্রাপ্তিসুখের প্রত্যাশা। সেটা সবার ক্ষেত্রেই এক, বিশেষ করে প্রীতমদের বয়সের ছেলেদের জন্য।
উৎপল প্রীতমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে - দেখ, যমুনার ব্রিজ এসে গেছি। এবার অজিতের কথা মতো বাঁয়ে মোড় নিয়ে এগোতে হবে। প্রীতম সবে কল্পরাজ্যে পা রেখেছিল। উৎপলের কথায় জেগে ওঠে বলে - হ্যাঁ, চল। ওই তো রাস্তা নেমে গেছে। ওদিকটাই হবে।
রেলের লাইন থেকে নেমে এবার গ্রামের পথে পা বাড়ায় দু’জনে। অজিত সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে আগে থেকেই। কখন কোন দিকে বাঁক নিতে হবে, কত দূর এগোলে কী পাবে সব কিছু। প্রীতমের কল্পনায় কিন্তু একটাই অদেখা ছবি ঘুরপাক খাচ্ছে সেই তখন থেকে। অজিতের বলা নদীটির কথা। যমুনার কথা। বাঁশের সাঁকো দিয়ে পেরোতে হবে নদী। প্রীতম আসলে চিরদিনই নদী অন্ত প্রাণ। অসম্ভব এক ভালো লাগা তার নদীকে ঘিরে। চেনা অচেনার বালাই নেই। নদী পেলেই হল। ইচ্ছে হয় বসে থাকে অনন্ত সময় ধরে।
নদীর পাশ দিয়েই পায়ে হাঁটা চওড়া পথ যদিও এটি বাঁধ নয়। তাই মাঝে মাঝেই বেশ খানিকটা দূরে চলে যায় নদী থেকে। আবার চলে আসে কাছে। এবার মনে হচ্ছে সাঁকো থাকা জায়গাটির কাছাকাছি ওরা চলে এসেছে। অজিতের বয়ান অনুযায়ী এমনটাই হওয়ার কথা। এতক্ষণে পথটি চলে এসেছে একেবারে নদীর কাছাকাছি। নদীর এপারে ওপারে অসংখ্য বাঁশবন। উঁচু উঁচু বাঁশ গাছগুলোর উপরের দিকটা নুয়ে পড়েছে নদীর উপর। যেন নির্জনতার সুযোগ নিয়ে কানে কানে, হৃদয়ে হৃদয়ে নিভৃতে দু’দণ্ড প্রাণের কথা বলে নিতে চাইছে। ডান দিকে নদী, বাঁদিকে একের পর এক গ্রামবাসীদের মাটির ঘর। গ্রামের এই শান্ত, স্নিগ্ধ রূপে অভিভূত প্রীতম। কোথা থেকে যেন একরাশ ভালো লাগা, একগুচ্ছ চেনা আবহ এসে আচ্ছন্ন করে ফেলছে ক্রমশ। অগুনতি সব ফল ফুলের গাছ ঘরগুলোর সামনে। চেনা অচেনা ফুলের সৌরভে ছেয়ে আছে চরাচর। নদী এখানে কিছুটা সরু হয়ে বইছে। বোধ করি সাঁকো পেরিয়ে গ্রামবাসীদের যাতায়াতের সুবিধেটুকু করে দিতে। বাকপটু উৎপলও যেন নির্বাক হয়ে গেছে এসব দেখে।
প্রীতম ভাবছে এত চেনা কেন লাগছে
এই জায়গাটি। অথচ আগে তো কখনও আসেনি এখানে। মনে হচ্ছে যেন এ তার বহু যুগের পরিচিত
এক পরিবেশ। এখনই বলে দিতে পারবে এর পর কোথায় কী আছে।
‘সামনেই সাঁকো আছে’ - অজান্তেই বেরিয়ে এল প্রীতমের মুখ থেকে।
উৎপল অবাক হয়ে যায় প্রীতমের কথা শুনে।
- তুই কী করে জানলি ?
- আমার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সব আমার জানা। কেন এমন হচ্ছে রে উৎপল ? আমি কি আগে এসেছি কখনও এখানে ?
অদ্ভুত প্রশ্ন। উৎপল কী করে জানবে ? ফ্যালফ্যাল করে তাকায় প্রীতমের দিকে। প্রীতমের চেহারায় কেমন এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করে উৎপল। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
- দ্যাখ, দ্যাখ। বাঁশের গাছগুলো কেমন আনত হয়ে এসে চুমু খেতে চাইছে নদীর বুকে। এই নদী এই গ্রামের প্রাণ বুঝলি ? শুধু এই গ্রামই নয়, তার চলার পথে সবাইকেই এভাবে প্রেম বিলিয়ে চলেছে এই নদী। দিয়েই যায় শুধু। প্রতিদান চায়নি কখনও।
উৎপল অবাক হয়ে ভাবে এত কথা কী করে জানে প্রীতম ? অজিতের মুখে নদীটির কথা শুনেছে যদিও এভাবে তার মূল্যায়ন করতে শোনেনি কখনও।
- ওই যে সাঁকো।
উৎপল দেখে সামনেই নদী পারাপারের সাঁকো। দু’টি বাঁশ জোড়া দিয়ে তৈরি, হাতল থাকা সাঁকো। এ জায়গাটি হল স্বপনপুর গ্রামের প্রবেশদ্বার। নদী পেরোলেই স্বপনপুর গ্রাম শুরু। কেমন এক ঘোরের মধ্যে থেকেই সাঁকো পেরিয়ে এল প্রীতম। ওপারের নদীঘেঁষা পথটি ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। ফিরে ফিরে তাকাতে থাকে তাই বারবার।
উৎপল সাবধান করে দেয় - হাতলটি ধরে থাক ভালো করে প্রীতম। ভালো করে সামনের দিকে আর নীচের দিকে তাকিয়ে এগোবি। এদিক ওদিক তাকাবি না একদম। প্রীতমের মাথায় কী চলছে সে নিজেই জানে না। এভাবেই সাঁকো পেরিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেকটি গ্রামের সীমানায় প্রবেশ করতেই প্রীতমের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। কেটে গেল ঘোর। এবার প্রীতম অবাক হয়ে গেল নিজেই। কেন এমন হল ? হঠাৎ মাথায় এল এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসা। তবে কি প্রীতম আগের জন্মে ...... ? না, এসব ভেবে কোনও লাভ নেই। পুনর্জন্ম বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তাহলেও কিছুই তো আর প্রমাণ নেই। তাই এ নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। তবু যেন এক পিছুটান ...
সামনে এগোতেই সবুজ ধানের
বিস্তীর্ণ মাঠ চোখে পড়ল। অর্থাৎ নদীর এপারেই আছে খেতি জমি। জনবসতির বেশির ভাগই
ওপারে - যেখানটা পেরিয়ে এল ওরা। সরু পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে দুপুরে
অজিতের ঘরে শহরের দুই বন্ধুর পা পড়তেই বিয়েবাড়ি জুড়ে হইচই। ব্যস্ততার মধ্যেও অজিত
এসে যতটা সম্ভব খোঁজখবর নিচ্ছে। চা-পর্ব শেষে আলাপে কথায় ধীরে ধীরে পরিবারের সবার
সঙ্গে পরিচিত হয়ে প্রাথমিক জড়তা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে দু’জনে। বোন শ্রীলেখাকে বহু
দিন আগে দেখেছিল প্রীতম। আজ কনের সাজে দেখে খুব ভালো লাগল। লাজুক শ্রীলেখা এসে
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে প্রীতম আর উৎপলকে। অজিত ব্যস্ত সব দিক সামলাতে। তাই বেশি
সময় দিতে পারছে না ওদের। বলে - ভাই, যখন যা দরকার হয় বলবি। ছোট ভাই দু’টি রয়েছে। গ্রামে এসেছিস, কষ্ট হবে
তোদের। তবু যে এলি এতটা পথ হেঁটে। বলে তার দুই বৌদির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। হাসিমুখে আপ্যায়ন করলেন
বৌদিরা।
প্রীতম বলে - সত্যি বহু দিন পর গ্রামে এলাম রে অজিত। কী যে অপরূপ এক মায়াময় তোদের এই গ্রামটি। মনে হয় যেন কত দিনের চেনা। সবুজে সবুজে এমন মাখামাখি দেখিনি অনেক দিন হল। আর সবার উপর মোহময়ী যমুনা। চোখ জুড়িয়ে যায় যেদিকে তাকাই। তোদের গ্রামের প্রেমে পড়ে গেছি ভাই।
- আপাতত গ্রামের প্রেমেই থাক।
রাতে বরযাত্রীরা এলে আবার তোর প্রেম কোনদিকে গড়ায় সেটাই ভাবছি। রসিকতা করে অজিত।
উৎপল ফোঁড়ন কাটে - আমিও চিন্তিত প্রীতমকে নিয়ে। আসতে গিয়ে পথে যে রূপ দেখেছি।
- আহা, নিজে যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। তোর সব জানা আছে আমাদের। রাতে সাবধানে থাকবি। এক রাতের জন্য এসে আবার কোনো প্রেমঘটিত কেলেঙ্কারিতে যেন জড়িয়ে না যাস। এমন খুনি হাসিতে কে যে খুন হয় রাতে।
হাসিতে, আড্ডায়, এদিক ওদিক স্বল্প দূরত্বের ঘোরাঘুরিতে মশগুল হয়ে কেটে যায় দিন। রাতে নির্বিঘ্নে বিয়ে সারা হলে ঘুমোতে যায় শেষ রাতে। সকালে উঠতে স্বভাবতই বেশ দেরি হল। ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে। বিকেলের আগে ফিরতে না পারলে শেষ বাস ধরা যাবে না। দুপুরের খাওয়া তাই তাড়াতাড়ি সেরে নিয়ে কন্যা বিদায়ের আগেই বিদায় নেয় দুই বন্ধু। তবু ভেবে রাখা সময় থেকে অনেকটাই দেরি হয়ে গেল। অজিত এগিয়ে দিতে আসে সাঁকোর মুখ অবধি। মন ভার অজিতের। একটু পরেই কন্যাবিদায়।
বস্তুত কাল থেকেই প্রীতম শুধু
প্রহর গুনছিল কখন আবার ফিরে আসবে এই নদীটির ধারে - যেখানে মনে হয় যেন বাঁধা পড়ে
আছে সে, জন্ম জন্মান্তরের কোনও এক দুর্জ্ঞেয় বন্ধনে। এবার অজিত ফিরে যেতেই আবার
সাঁকো পেরিয়ে ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে গেল নিমিষে। এ কেমন এক মায়ার বাঁধন বুঝে উঠতে
পারে না প্রীতম। চলতে চায় না দু’পা। থমকে থাকে দেহ মন। মনে হয় এখানেই কোথাও লুকিয়ে
আছে তার আপন ঘরদুয়ার। মনে পড়ে মা-বাবার কথা। এ পৃথিবী ছেড়ে কবেই বিদায় নিয়েছেন
তাঁরা। নদীর ধারে খেলা করছে ছোট ছোট শিশুরা। দেখে মনে হয় কত আপনজন ওরা। নদীর ঢালে
নানা রকম শাকসবজির খেত। মাচানের উপর মিষ্টি কুমড়োর হলুদ ফুল এসেছে, সর্ষে পালং-এর
চারা ডাগর হয়ে উঠছে। কিছু গোরু ছাগল বাঁধা আছে, খড় চিবোচ্ছে আপন মনে। একটি শ্মশানও
দেখা গেল। জীবনের শেষ গন্তব্য। যমুনার জলে বিধৌত হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার সুবন্দোবস্ত।
শ্লথ হয়ে পড়েছে আনমনা প্রীতমের চলার গতি। উৎপল এগিয়ে যায় বার বার। তার পর ফিরে দেখে অনেকটাই
পিছিয়ে পড়েছে প্রীতম। দাঁড়ায় খানিকটা। প্রীতম বলে - এখানে বসে
জিরিয়ে নিই খানিকটা ? অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি কিনা।
- কিন্তু দেরি হলে বাস পাব না যে। তাছাড়া এখানে বসার জায়গা কোথায় ? - উৎকণ্ঠা উৎপলের চোখে মুখে।
কিছু না বলে নদীর দিকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রীতম দেখতে থাকে তার সমাহিত চলার ছন্দ। প্রীতমের সারা শরীর বেয়ে খেলে যায় এক অজানা বিষণ্ণ স্রোত। বুঝে উঠতে পারে না এ বিষণ্ণতার উৎস কোথায়। চলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে প্রীতম। ইচ্ছে হয় এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে জীবনভর। কী এক অমোঘ আকর্ষণ যেন আটকে রেখেছে তাকে জোর করে।
ভীত, উৎকণ্ঠিত উৎপল এবার তাকে হাত ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে যেতে থাকে। ইতিমধ্যেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। শেষ বাস চলে গেলে ভোগান্তি আছে কপালে। এভাবে হাতে হাত ধরে এগোতে এগোতে এক সময় রেলের পুল দেখতে পেল ওরা। জোর পা চালিয়ে মোড় পেরিয়ে ফের রেললাইন ধরে এগোতে থাকে বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নদী পেরিয়ে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে প্রীতমের ঘোর কাটতে শুরু করেছে। তবু আসার পথে যে উদ্দীপনা নিয়ে ওরা এসেছিল এখন তার সিকিভাগও নেই। তাই পথ যেন আর শেষ হতে চায় না। শরতের বেলা ছোট হতে শুরু করেছে। রোদ এখন পড়ন্ত প্রায়।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেই বুঝতে পারল ওরা যা আশঙ্কা করেছিল সেটাই বাস্তব হয়েছে। নির্জন বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া দোকানে খবর নিয়ে জানতে পারল কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে গেছে শেষ বাস। মুষড়ে পড়ল উৎপল। প্রীতমের এমন অবস্থায় এবার কী হবে ? ওদের দেখে একটি হোটেল থেকে একজন এগিয়ে এসে বলল - ট্রেন আসবে ঘন্টাখানেক পর। আপনারা ট্রেন ধরে যেতে পারবেন।
ঘুরপথে ট্রেন ধরে গিয়ে পৌঁছোতে অনেকটাই দেরি হবে। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও তো নেই। মানসিক ভাবে অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল দুই বন্ধু। উৎপল ভাবছে তাড়াতাড়ি করে প্রীতমকে নিয়ে গিয়ে ঘরে পৌঁছে দিতে পারলেই রক্ষে। প্রীতমের ব্যাপারটা বড্ড ঘোরালো লাগছে। বলল - ট্রেন আসার যখন দেরি আছে তাহলে চল এক এক কাপ চা হয়ে যাক। সম্মতি জানায় প্রীতম। আসার পথে যে দোকানে ওরা প্রাতঃরাশ সেরেছিল সেটি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই অন্য একটি দোকানে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিল।
নতুন দোকানের মালিক কাম বয় চায়ের দোকানি এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল চা তৈরিতে। জিজ্ঞেস করল - আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন ? এখন কোথায় যাবেন ?
- গিয়েছিলাম
স্বপনপুর। এখন সাতগাঁ যাব। - উৎপল জবাব দেয়।
তাহলে তো ট্রেনে করে বেলিমুখ অবধি গিয়ে অন্যভাবে যেতে হবে।
- হ্যাঁ। তাই করতে হবে। রাত হবে পৌঁছোতে।
চা-পর্ব শেষে বিল মিটিয়ে প্রীতম বলে - একটা সিগারেট খাব। বলে পাশের পান দোকানে গিয়ে দু’টি সিগারেট কিনে একটা উৎপলকে দিয়ে সিগারেট ধরায় প্রীতম। আধজ্বলা দেশলাই কাঠিটি এগিয়ে ধরে উৎপলের দিকে। একটি দেশলাই কাঠি থেকে দুই বন্ধুর এই সিগারেট ধরানোর মধ্যে চিরদিনই লুকিয়ে থাকে এক অকৃত্রিম আন্তরিকতার প্রমাণ। প্রীতমকে স্বাভাবিক দেখে ভেতরে ভেতরে অনেকটা আশ্বস্ত হয় উৎপল। চায়ের দোকানে রেখে আসা ব্যাগদু’টি নিয়ে এসে সিগারেট শেষ হলে ওরা পা বাড়ায় স্টেশনের দিকে।
দূর থেকে দেখাই যাচ্ছে স্টেশন। বড় জোর তিনশো মিটারখানেক দূরত্ব হবে। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় ওরা স্টেশনে। এই লাইনে দু’জনই যাতায়াত করেছে একাধিক বার। আসতে যেতে রেলগাড়ি থেকেই দেখেছে স্টেশনটি। উভয়েই আজ প্রথম বারের মতো পা ফেলল এখানে। এক নৈসর্গিক দৃশ্য আছে স্টেশনটির আশেপাশে। শেষ বিকেলের নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ায় খুব ফুরফুরে লাগছে যেন নিজেদের। প্রায় চারটি লাইন আছে এখানে। শেষ লাইনে ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি পরিত্যক্ত কামরা। সেগুলোর ফাঁক দিয়ে লাগোয়া বাড়িঘরগুলো দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি ঘরের সামনে থোকা থোকা ফুলের গাছ। রং-বেরং এর ফুল ফুটে আছে। চোখে পড়ে আবছা। সন্ধ্যা নামেনি এখনও। ধীরে ধীরে যাত্রীরা আসতে শুরু করেছেন স্টেশনে। এসব জায়গার স্টেশনগুলো অন্য সময় ফাঁকাই পড়ে থাকে। গাড়ি আসার সময় হলেই সরগরম হয়ে পড়ে। এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো দাঁড়ায় না এখানে। শুধুমাত্র যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোই দাঁড়ায়। ফলে নিক্তি ধরে দিনে চার ছ’বার লোকজনের আনাগোনা প্রত্যক্ষ করে স্টেশনটি। টিকিটঘর পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপর থাকা একটি বেঞ্চে বসে পড়ে ওরা। এই স্বপনপুর যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতে খুব ইচ্ছে করছে উৎপলের। কিন্তু প্রীতমের অস্বাভাবিক আচরণের কথা মনে এসে পড়ছে বার বার। তাই অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে উৎপল।
- বেলিমুখ পৌঁছে কী করে যাব বল তো ?
- আমার মনে হয় পানহাটি সাতগাঁ লোক্যাল পেয়েও যেতে পারি। - প্রীতম বলে।
- পেলে তো ভালোই। কিন্তু না পেলে কী হবে ? রাতে কি ছোট গাড়ি কিছু পাব ?
প্রীতম নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলে - কিছু একটা তো
ম্যানেজ হবেই। তাছাড়া রাতেও কিছু গাড়ি থাকেই স্টেশনের পাশে। চিন্তা করিস না। কিছু একটা হয়ে যাবে। তুই যা, টিকিট কাউন্টার
খুলেছে বোধ হয়। নিয়ে আয় গিয়ে।
উৎপল গিয়ে দু’টি টিকিট নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে গাড়ি আসার প্রথম ঘন্টি পড়ে গেছে। এবার টিকিট নিয়ে আসতে আসতে দ্বিতীয় ঘন্টিও পড়ল। মোটামুটি স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা। উৎপল বলে - চল খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। তাহলে ফাঁকা পাব।
ওরা আরোও একটু পিছিয়ে যায়। ইতিমধ্যে সন্ধে প্রায় হয়েই আসছে। দূর থেকে গাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। যমুনাপার স্টেশন ব্যস্তমুখর হয়ে উঠল। যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে যে যার পছন্দের জায়গায় অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল। দু’চার জন এসে দাঁড়িয়েছেন প্রীতমদের পাশে। ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে অবশেষে গাড়ি এসে দাঁড়াল স্টেশনে।
হুড়মুড় করে কিছু যাত্রী প্ল্যাটফর্মে নেমে আসতেই উঠে পড়ল প্রীতমরা। তড়িঘড়ি বসার সিট খুঁজতে থাকল। প্রত্যাশামতো সিট প্রায় খালিই ছিল। একটি খোপে ওরা জানালার ধার ঘেঁষে বসল মুখোমুখি। গাড়িতে জানালার পাশের সিটটি সব যাত্রীরই প্রিয়। যারা পরে এল তারা প্রীতমদের দেখে সামনে এগিয়ে গেল। মোটামুটি নিশ্চিন্তে গল্প করে যাওয়া যাবে ভেবে গুছিয়ে বসতে না বসতেই ছেড়ে দিল গাড়ি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল দু’জনই। টিকিটঘর পেরিয়ে এবার প্ল্যাটফর্মের অপর পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু’একজন যাত্রী নির্গমন পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার আবছা আঁধার দূর করতে জ্বলে উঠেছে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটপোস্টগুলোর উপর লাগানো বিজলিবাতি। ওরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।
গাড়ি তখনও প্ল্যাটফর্ম ছাড়েনি। প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে এসে গেছে সম্ভবত। প্রীতম যাচ্ছে সামনের দিকে, উৎপল পিছন পিছন। প্রীতম দেখতে পেল লোকজন আর নেই প্ল্যাটফর্মের এই শেষ প্রান্তে। ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত একজন লোক শুধু একটি বাচ্চা ছেলেকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন চলন্ত গাড়ির দিকে। হয়তো কাউকে তুলে দিতে এসেছেন। গাড়ি তাদের কাছে আসতেই হঠাত প্রীতম এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতটি প্রাণপণে বাইরে বের করে চিৎকার করে উঠল -
- বা…বা… ... ...
হতভম্ব উৎপল চমকে গিয়ে বেসামাল প্রীতমকে জড়িয়ে ধরল। অবাক হয়ে দেখল মুহূর্তের মধ্যেই প্রীতমের পুরো শরীর ঘেমে একেবারে ভিজে জল হয়ে গেছে। চোখদু’টো বিস্ফারিত হয়ে আছে। জোর করে সিটে বসিয়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে খানিকটা জল ছিটিয়ে দিল প্রীতমের চোখে মুখে। গাড়ি ততক্ষণে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে একের পর এক গ্রাম প্রান্তর ছাড়িয়ে।
অসাড় প্রীতম যেন বিধ্বস্ত এক ভবঘুরের মতো বসে আছে সিটে। পকেট থেকে রুমাল বের করে তার মুখ কপাল মুছিয়ে দেয় উৎপল। অনেকটা সময় এভাবে বসে থাকার পর ধীরে ধীরে একটু সুস্থ বোধ হওয়াতে নিজেই অস্পষ্ট স্বরে স্বগতোক্তির মতো বলে প্রীতম -
- স্পষ্ট দেখলাম
!!
- কী ?
- বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে।
স্বচ্ছ শরতের এক নির্ঝঞ্ঝাট সকালে বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে ওরা দু’জন সরাসরি ঢুকে গেল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন চা-জলখাবারের সারি সারি দোকানগুলোর একটিতে। প্রীতমের সঙ্গে আজ উৎপলও এসেছে। দুই বন্ধু মিলে দু’দিনের জন্য বন্ধু অজিতের বোন শ্রীলেখার বিয়েতে জমিয়ে ফুর্তি করার অভিপ্রায়ে বেরিয়েছে। বিবাহ নামক বন্ধনে জড়িয়ে পড়ার আগে এই বয়সে এই যৌবনযাপন বড্ড উপভোগ করে প্রীতম। যেন এক বন্ধনহীন উড়ন্ত বেদুইন। উৎপলও বাকচাতুর্যে কম যায় না। বলতে গেলে নন-স্টপ বকবক করেই চলেছে। প্রীতম আবার খানিকটা স্বল্পবাক। খুব সতর্ক নজর রেখে চলে বাইরে বেরোলে। তার চোখালো দৃষ্টির বাইরে থেকে থাকে না কিছুই।
দোকানগুলোর কাছে পৌঁছোতেই দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোকরা কর্মচারীগুলো হাঁকডাক শুরু করে দিল - আসুন দাদা, আসুন। চা, পুরি, পরোটা, গরম গরম ভাত …।
একটি করে লাগেজ এনেছে দু’জনেই। কাউন্টারের পাশে মাটিতেই সেগুলো রেখে হাত মুখ ধুতে টেবিলের উপর রাখা জলভর্তি জগটি হাতে নিয়ে বাইরে বেরোতে গিয়ে ধীর কণ্ঠে উৎপল বলে - এখানেই ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া ভালো হবে মনে হয়। প্রীতম শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না।
বাইরে বেরোনোর পথেই একফালি বারান্দার এক দিকে একটি কাঠের টেবিলের উপর আলাদা আলাদা পাত্রে সাজিয়ে রাখা আছে কিছু ফুলকো লুচি, ঘুগনি, সাদা ঝরঝরে ভাত - যা থেকে সামান্য ধোঁয়া তখনও উড়ছে। কিছু পাত্র ঢাকনি দিয়ে ঢাকা আছে; সম্ভবত ভাতের সঙ্গের ডাল এবং সবজি ও অন্যান্য তরকারি। একটি পাত্রে কিছু বড় মাছের টুকরো আদ্ধেক ভাজা করে রাখা এবং একটি পাত্রে গোটা গোটা ছোট মাছ ভাজা। কতক্ষণ থেকে না জানি এগুলো এভাবেই খোলা পড়ে রয়েছে। ধুলো বালি এসে জমা হচ্ছে নির্ঘাত। ছোট মাছগুলো দেখে প্রীতমের বুভুক্ষা চাগাড় দিয়ে উঠছে যেন। ওদিকে উৎপল তো চিরপেটুক। মুখে যদিও বলছে না কিছুই তবু পদগুলোর দিকে তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে হাসি পেয়ে যায় প্রীতমের। বলে - কী রে, ভাত খাবি ?
- চা হবে ? জানতে চায় প্রীতম।
- হবে। কী চা খাবেন ? দুধ চা নাকি লিকার ?
- চিনি খাবেন তো ?
- ঠিক আছে। বলেই সবাই মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ক্রেতা ভগবানকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে।
খানিকটা সময় লাগবে। প্রীতমরা ফের বাইরে বেরিয়ে এল। আশেপাশে একটু উঁকি মেরে দেখতে চাইল জায়গাটা। পিছনে খানিকটা উঁচু লাইন ধরে রেলের ট্র্যাক। সামনে বাসরাস্তা। পিচগুলো উঠে উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। বাস রাস্তার ওপারে সারি সারি বসত ঘর। কাঁচা-পাকা। দু’একটি দোতলা ঘরও চোখে পড়ল। লোকজন খুব একটা নেই। বোঝাই যাচ্ছে এখানে বাস কিংবা ট্রেন এলেই কর্মব্যস্ততা বেড়ে ওঠে। এর বাইরে আপাত নির্জনতাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি। প্রীতমরা জানে ওই রেললাইনটি স্টেশন পেরিয়ে যেদিকে গেছে ওদিকেই কিছু পথ হেঁটে গিয়ে গ্রামের রাস্তা ধরতে হবে তাদের। গ্রামের রাস্তায় হাঁটাচলা করতে ভালোই লাগে প্রীতমের। সবুজের সান্নিধ্যে সাড়া জাগে প্রাণে। অনেক অনেক গ্রামে ঘুরতে গিয়েছে প্রীতম। কিছু কর্মসূত্রে, কিছু এমনি - বেড়ানোর উদ্দেশে। এ রাস্তার হদিশ পুরোটাই জেনে রেখেছে অজিতের থেকে। এবার কিছু খেয়ে বেরিয়ে পড়াই ভালো। দোকানের দিকে পা বাড়াতেই হাঁক পাড়ে কর্মচারী ছেলেটি - দাদা, হয়ে গেছে। এসে পড়ুন।
ফিরে এসে হোটেলে ঢোকার মুহূর্তে আবার চোখ যায় ছোট ছোট মাছগুলোর দিকে। মাছগুলোকে দেখে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। উৎসাহী উৎপল ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করে - এগুলো কী মাছ ?
প্রীতম ও উৎপল চাওয়াচাওয়ি করে পরস্পরের দিকে। নির্বাক উৎপলের চোখে মুখে লুক্কায়িত খুশির ঝিলিক প্রীতমের চোখ এড়ায় না। উৎপলকে নির্বাক রেখেই প্রীতম বলে -
- এক কাজ করুন। এক প্লেটই দিন। দু’ভাগ করে দু’জনকে দিলেই হবে।
- ঠিক আছে স্যার। - আবার সাময়িক কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায় হোটেলের অন্দরমহলে। ইতিমধ্যে বাইরে আবারও হোটেল বয়দের মুখরতা বেড়েছে। বোধ হয় আবারও একটি বাস এসে পৌঁছেছে। কারণ কোনো ট্রেন আসার তো শব্দ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া খানিকক্ষণ আগে একটি মালগাড়ি বেরিয়ে গেছে তীব্রবেগে। বাস থেকে বেশ ক’জন যাত্রী নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁকডাক শুরু হল ছেলেছোকরাদের - আগের মতোই। একজন যাত্রী এসে ঢুকলেন প্রীতমদের হোটেলে। এবার তাঁকে নিয়েও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মালিক-কর্মচারী।
ইতিমধ্যে পুরি-সবজি শেষ হয়ে চা এসে গেছে প্রীতমদের টেবিলে। বয় এসে বলল - স্যার, চা-টা খেয়ে নিন। মাছ ভাজা হচ্ছে।
প্রীতম বলল - মাছ ভাজা দেওয়ার পর আবার দু’কাপ চা দিয়ে যাবে, কেমন ?
- ঠিক আছে স্যার।
বসে বসে প্রীতম ভাবে এই মাছগুলো সত্যিই বিশেষ। এক একটি নদীর এক এক রকম বিশেষত্ব। বোরিয়লা মাছ প্রীতম খেয়েছে। অতি সুস্বাদু নাছ। চার-পাঁচটি মাছ ভাজা হলে এক থালা ভাত সাবাড় করে দেওয়া যায় অনায়াসে। তেমনি হয়তো এই যমুনার মিছরি মাছ। নদীগুলোও যেন মানুষের মতো। একই নামের একাধিক নদী। কোথায় সেই উত্তর ভারতের নদী যমুনা আর কোথায় এই অজ্ঞাত অজ সব গ্রামের পর গ্রামের বুক চিরে প্রবাহিত অখ্যাত এই যমুনা।
ভাবতে ভাবতেই এসে গেল মাছ ভাজার প্লেট। এগুলোও চমৎকার। অনেকটা বোরিয়লারই মতো। তবে তার আকৃতিতে কিছু ফারাক আছে। ভেজে খাওয়ার উপযুক্ত বটে।
জম্পেশ করে মেছো চা-জলখাবারের পর এবার বিল মিটিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল উভয়েই। অজিত যেমনটি বলেছে সে হিসেবে প্রায় দু’মাইল পথ এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। বর্ষাশেষে ধুলোহীন পথে যেতে মন্দ লাগার কথা নয়। শরতের প্রারম্ভে গরমের দাপট অনেকটাই কমে এসেছে। রেললাইন ধরে এগোয় ওরা। পিঠে ব্যাগ নিয়ে স্বচ্ছন্দে এগোতে থাকে কখনো লাইনের পাশ দিয়ে, কখনো স্লিপারের উপর পা রেখে - সন্তর্পণে। নিজেদের মধ্যে চলতে থাকে রাজ্যের বিষয়বহির্ভূত কথোপকথন। উৎপল আবার কথা বলতে একটু বেশিই পছন্দ করে। বলে - “আশ্বিনে কিন্তু বিয়ে হতে সচরাচর দেখ যায় না। কী বলিস” ?
- হ্যাঁ। তবে আমার দিদির হয়েছিল, জানিস তো ?
- তাই ?
- হ্যাঁ। তবে অজিতের বোনের বিয়ে আশ্বিনে হওয়াতে ওর কিছুটা অসুবিধেই হল বলা যায়।
- কী করে ?
- সামনে পুজো। এখন কেনাকাটার মরশুম। এমনিতেই অজিতের ইলেক্ট্রিক সামগ্রীর দোকান তেমন রমরমিয়ে তো আর চলে না। সেক্ষেত্রে এ সময়টাই ওদের জন্য মোক্ষম সময়। তাই বললাম আরকি।
- তা সত্যি। তবে আমি ভাবছি কি এই বোনের বিয়ে হয়ে গেলে অজিতও আমাদের মতো ‘রেডি টু মেরি’ হয়ে যাবে। কী বলিস ?
হাসে প্রীতম। এই বয়সে বিয়ে বাড়িতে থাকতে যাওয়ার মধ্যে আলাদা একটা আমেজ আছে। তা যতটা না বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড় তার চাইতেও বেশি কিছু একটা প্রাপ্তিসুখের প্রত্যাশা। সেটা সবার ক্ষেত্রেই এক, বিশেষ করে প্রীতমদের বয়সের ছেলেদের জন্য।
উৎপল প্রীতমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে - দেখ, যমুনার ব্রিজ এসে গেছি। এবার অজিতের কথা মতো বাঁয়ে মোড় নিয়ে এগোতে হবে। প্রীতম সবে কল্পরাজ্যে পা রেখেছিল। উৎপলের কথায় জেগে ওঠে বলে - হ্যাঁ, চল। ওই তো রাস্তা নেমে গেছে। ওদিকটাই হবে।
রেলের লাইন থেকে নেমে এবার গ্রামের পথে পা বাড়ায় দু’জনে। অজিত সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে আগে থেকেই। কখন কোন দিকে বাঁক নিতে হবে, কত দূর এগোলে কী পাবে সব কিছু। প্রীতমের কল্পনায় কিন্তু একটাই অদেখা ছবি ঘুরপাক খাচ্ছে সেই তখন থেকে। অজিতের বলা নদীটির কথা। যমুনার কথা। বাঁশের সাঁকো দিয়ে পেরোতে হবে নদী। প্রীতম আসলে চিরদিনই নদী অন্ত প্রাণ। অসম্ভব এক ভালো লাগা তার নদীকে ঘিরে। চেনা অচেনার বালাই নেই। নদী পেলেই হল। ইচ্ছে হয় বসে থাকে অনন্ত সময় ধরে।
নদীর পাশ দিয়েই পায়ে হাঁটা চওড়া পথ যদিও এটি বাঁধ নয়। তাই মাঝে মাঝেই বেশ খানিকটা দূরে চলে যায় নদী থেকে। আবার চলে আসে কাছে। এবার মনে হচ্ছে সাঁকো থাকা জায়গাটির কাছাকাছি ওরা চলে এসেছে। অজিতের বয়ান অনুযায়ী এমনটাই হওয়ার কথা। এতক্ষণে পথটি চলে এসেছে একেবারে নদীর কাছাকাছি। নদীর এপারে ওপারে অসংখ্য বাঁশবন। উঁচু উঁচু বাঁশ গাছগুলোর উপরের দিকটা নুয়ে পড়েছে নদীর উপর। যেন নির্জনতার সুযোগ নিয়ে কানে কানে, হৃদয়ে হৃদয়ে নিভৃতে দু’দণ্ড প্রাণের কথা বলে নিতে চাইছে। ডান দিকে নদী, বাঁদিকে একের পর এক গ্রামবাসীদের মাটির ঘর। গ্রামের এই শান্ত, স্নিগ্ধ রূপে অভিভূত প্রীতম। কোথা থেকে যেন একরাশ ভালো লাগা, একগুচ্ছ চেনা আবহ এসে আচ্ছন্ন করে ফেলছে ক্রমশ। অগুনতি সব ফল ফুলের গাছ ঘরগুলোর সামনে। চেনা অচেনা ফুলের সৌরভে ছেয়ে আছে চরাচর। নদী এখানে কিছুটা সরু হয়ে বইছে। বোধ করি সাঁকো পেরিয়ে গ্রামবাসীদের যাতায়াতের সুবিধেটুকু করে দিতে। বাকপটু উৎপলও যেন নির্বাক হয়ে গেছে এসব দেখে।
‘সামনেই সাঁকো আছে’ - অজান্তেই বেরিয়ে এল প্রীতমের মুখ থেকে।
উৎপল অবাক হয়ে যায় প্রীতমের কথা শুনে।
- তুই কী করে জানলি ?
- আমার মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সব আমার জানা। কেন এমন হচ্ছে রে উৎপল ? আমি কি আগে এসেছি কখনও এখানে ?
অদ্ভুত প্রশ্ন। উৎপল কী করে জানবে ? ফ্যালফ্যাল করে তাকায় প্রীতমের দিকে। প্রীতমের চেহারায় কেমন এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করে উৎপল। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।
- দ্যাখ, দ্যাখ। বাঁশের গাছগুলো কেমন আনত হয়ে এসে চুমু খেতে চাইছে নদীর বুকে। এই নদী এই গ্রামের প্রাণ বুঝলি ? শুধু এই গ্রামই নয়, তার চলার পথে সবাইকেই এভাবে প্রেম বিলিয়ে চলেছে এই নদী। দিয়েই যায় শুধু। প্রতিদান চায়নি কখনও।
উৎপল অবাক হয়ে ভাবে এত কথা কী করে জানে প্রীতম ? অজিতের মুখে নদীটির কথা শুনেছে যদিও এভাবে তার মূল্যায়ন করতে শোনেনি কখনও।
- ওই যে সাঁকো।
উৎপল দেখে সামনেই নদী পারাপারের সাঁকো। দু’টি বাঁশ জোড়া দিয়ে তৈরি, হাতল থাকা সাঁকো। এ জায়গাটি হল স্বপনপুর গ্রামের প্রবেশদ্বার। নদী পেরোলেই স্বপনপুর গ্রাম শুরু। কেমন এক ঘোরের মধ্যে থেকেই সাঁকো পেরিয়ে এল প্রীতম। ওপারের নদীঘেঁষা পথটি ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। ফিরে ফিরে তাকাতে থাকে তাই বারবার।
উৎপল সাবধান করে দেয় - হাতলটি ধরে থাক ভালো করে প্রীতম। ভালো করে সামনের দিকে আর নীচের দিকে তাকিয়ে এগোবি। এদিক ওদিক তাকাবি না একদম। প্রীতমের মাথায় কী চলছে সে নিজেই জানে না। এভাবেই সাঁকো পেরিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেকটি গ্রামের সীমানায় প্রবেশ করতেই প্রীতমের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। কেটে গেল ঘোর। এবার প্রীতম অবাক হয়ে গেল নিজেই। কেন এমন হল ? হঠাৎ মাথায় এল এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসা। তবে কি প্রীতম আগের জন্মে ...... ? না, এসব ভেবে কোনও লাভ নেই। পুনর্জন্ম বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তাহলেও কিছুই তো আর প্রমাণ নেই। তাই এ নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। তবু যেন এক পিছুটান ...
প্রীতম বলে - সত্যি বহু দিন পর গ্রামে এলাম রে অজিত। কী যে অপরূপ এক মায়াময় তোদের এই গ্রামটি। মনে হয় যেন কত দিনের চেনা। সবুজে সবুজে এমন মাখামাখি দেখিনি অনেক দিন হল। আর সবার উপর মোহময়ী যমুনা। চোখ জুড়িয়ে যায় যেদিকে তাকাই। তোদের গ্রামের প্রেমে পড়ে গেছি ভাই।
উৎপল ফোঁড়ন কাটে - আমিও চিন্তিত প্রীতমকে নিয়ে। আসতে গিয়ে পথে যে রূপ দেখেছি।
- আহা, নিজে যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। তোর সব জানা আছে আমাদের। রাতে সাবধানে থাকবি। এক রাতের জন্য এসে আবার কোনো প্রেমঘটিত কেলেঙ্কারিতে যেন জড়িয়ে না যাস। এমন খুনি হাসিতে কে যে খুন হয় রাতে।
হাসিতে, আড্ডায়, এদিক ওদিক স্বল্প দূরত্বের ঘোরাঘুরিতে মশগুল হয়ে কেটে যায় দিন। রাতে নির্বিঘ্নে বিয়ে সারা হলে ঘুমোতে যায় শেষ রাতে। সকালে উঠতে স্বভাবতই বেশ দেরি হল। ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে। বিকেলের আগে ফিরতে না পারলে শেষ বাস ধরা যাবে না। দুপুরের খাওয়া তাই তাড়াতাড়ি সেরে নিয়ে কন্যা বিদায়ের আগেই বিদায় নেয় দুই বন্ধু। তবু ভেবে রাখা সময় থেকে অনেকটাই দেরি হয়ে গেল। অজিত এগিয়ে দিতে আসে সাঁকোর মুখ অবধি। মন ভার অজিতের। একটু পরেই কন্যাবিদায়।
- কিন্তু দেরি হলে বাস পাব না যে। তাছাড়া এখানে বসার জায়গা কোথায় ? - উৎকণ্ঠা উৎপলের চোখে মুখে।
কিছু না বলে নদীর দিকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রীতম দেখতে থাকে তার সমাহিত চলার ছন্দ। প্রীতমের সারা শরীর বেয়ে খেলে যায় এক অজানা বিষণ্ণ স্রোত। বুঝে উঠতে পারে না এ বিষণ্ণতার উৎস কোথায়। চলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে প্রীতম। ইচ্ছে হয় এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে জীবনভর। কী এক অমোঘ আকর্ষণ যেন আটকে রেখেছে তাকে জোর করে।
ভীত, উৎকণ্ঠিত উৎপল এবার তাকে হাত ধরে একপ্রকার টেনে নিয়ে যেতে থাকে। ইতিমধ্যেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। শেষ বাস চলে গেলে ভোগান্তি আছে কপালে। এভাবে হাতে হাত ধরে এগোতে এগোতে এক সময় রেলের পুল দেখতে পেল ওরা। জোর পা চালিয়ে মোড় পেরিয়ে ফের রেললাইন ধরে এগোতে থাকে বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নদী পেরিয়ে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে প্রীতমের ঘোর কাটতে শুরু করেছে। তবু আসার পথে যে উদ্দীপনা নিয়ে ওরা এসেছিল এখন তার সিকিভাগও নেই। তাই পথ যেন আর শেষ হতে চায় না। শরতের বেলা ছোট হতে শুরু করেছে। রোদ এখন পড়ন্ত প্রায়।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেই বুঝতে পারল ওরা যা আশঙ্কা করেছিল সেটাই বাস্তব হয়েছে। নির্জন বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া দোকানে খবর নিয়ে জানতে পারল কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে গেছে শেষ বাস। মুষড়ে পড়ল উৎপল। প্রীতমের এমন অবস্থায় এবার কী হবে ? ওদের দেখে একটি হোটেল থেকে একজন এগিয়ে এসে বলল - ট্রেন আসবে ঘন্টাখানেক পর। আপনারা ট্রেন ধরে যেতে পারবেন।
ঘুরপথে ট্রেন ধরে গিয়ে পৌঁছোতে অনেকটাই দেরি হবে। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও তো নেই। মানসিক ভাবে অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল দুই বন্ধু। উৎপল ভাবছে তাড়াতাড়ি করে প্রীতমকে নিয়ে গিয়ে ঘরে পৌঁছে দিতে পারলেই রক্ষে। প্রীতমের ব্যাপারটা বড্ড ঘোরালো লাগছে। বলল - ট্রেন আসার যখন দেরি আছে তাহলে চল এক এক কাপ চা হয়ে যাক। সম্মতি জানায় প্রীতম। আসার পথে যে দোকানে ওরা প্রাতঃরাশ সেরেছিল সেটি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই অন্য একটি দোকানে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিল।
নতুন দোকানের মালিক কাম বয় চায়ের দোকানি এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল চা তৈরিতে। জিজ্ঞেস করল - আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন ? এখন কোথায় যাবেন ?
তাহলে তো ট্রেনে করে বেলিমুখ অবধি গিয়ে অন্যভাবে যেতে হবে।
- হ্যাঁ। তাই করতে হবে। রাত হবে পৌঁছোতে।
চা-পর্ব শেষে বিল মিটিয়ে প্রীতম বলে - একটা সিগারেট খাব। বলে পাশের পান দোকানে গিয়ে দু’টি সিগারেট কিনে একটা উৎপলকে দিয়ে সিগারেট ধরায় প্রীতম। আধজ্বলা দেশলাই কাঠিটি এগিয়ে ধরে উৎপলের দিকে। একটি দেশলাই কাঠি থেকে দুই বন্ধুর এই সিগারেট ধরানোর মধ্যে চিরদিনই লুকিয়ে থাকে এক অকৃত্রিম আন্তরিকতার প্রমাণ। প্রীতমকে স্বাভাবিক দেখে ভেতরে ভেতরে অনেকটা আশ্বস্ত হয় উৎপল। চায়ের দোকানে রেখে আসা ব্যাগদু’টি নিয়ে এসে সিগারেট শেষ হলে ওরা পা বাড়ায় স্টেশনের দিকে।
দূর থেকে দেখাই যাচ্ছে স্টেশন। বড় জোর তিনশো মিটারখানেক দূরত্ব হবে। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় ওরা স্টেশনে। এই লাইনে দু’জনই যাতায়াত করেছে একাধিক বার। আসতে যেতে রেলগাড়ি থেকেই দেখেছে স্টেশনটি। উভয়েই আজ প্রথম বারের মতো পা ফেলল এখানে। এক নৈসর্গিক দৃশ্য আছে স্টেশনটির আশেপাশে। শেষ বিকেলের নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ায় খুব ফুরফুরে লাগছে যেন নিজেদের। প্রায় চারটি লাইন আছে এখানে। শেষ লাইনে ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি পরিত্যক্ত কামরা। সেগুলোর ফাঁক দিয়ে লাগোয়া বাড়িঘরগুলো দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি ঘরের সামনে থোকা থোকা ফুলের গাছ। রং-বেরং এর ফুল ফুটে আছে। চোখে পড়ে আবছা। সন্ধ্যা নামেনি এখনও। ধীরে ধীরে যাত্রীরা আসতে শুরু করেছেন স্টেশনে। এসব জায়গার স্টেশনগুলো অন্য সময় ফাঁকাই পড়ে থাকে। গাড়ি আসার সময় হলেই সরগরম হয়ে পড়ে। এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো দাঁড়ায় না এখানে। শুধুমাত্র যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোই দাঁড়ায়। ফলে নিক্তি ধরে দিনে চার ছ’বার লোকজনের আনাগোনা প্রত্যক্ষ করে স্টেশনটি। টিকিটঘর পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপর থাকা একটি বেঞ্চে বসে পড়ে ওরা। এই স্বপনপুর যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতে খুব ইচ্ছে করছে উৎপলের। কিন্তু প্রীতমের অস্বাভাবিক আচরণের কথা মনে এসে পড়ছে বার বার। তাই অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে উৎপল।
- বেলিমুখ পৌঁছে কী করে যাব বল তো ?
- আমার মনে হয় পানহাটি সাতগাঁ লোক্যাল পেয়েও যেতে পারি। - প্রীতম বলে।
- পেলে তো ভালোই। কিন্তু না পেলে কী হবে ? রাতে কি ছোট গাড়ি কিছু পাব ?
উৎপল গিয়ে দু’টি টিকিট নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে গাড়ি আসার প্রথম ঘন্টি পড়ে গেছে। এবার টিকিট নিয়ে আসতে আসতে দ্বিতীয় ঘন্টিও পড়ল। মোটামুটি স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা। উৎপল বলে - চল খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। তাহলে ফাঁকা পাব।
ওরা আরোও একটু পিছিয়ে যায়। ইতিমধ্যে সন্ধে প্রায় হয়েই আসছে। দূর থেকে গাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। যমুনাপার স্টেশন ব্যস্তমুখর হয়ে উঠল। যাত্রীরা প্ল্যাটফর্মে যে যার পছন্দের জায়গায় অ্যাটেনশন ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল। দু’চার জন এসে দাঁড়িয়েছেন প্রীতমদের পাশে। ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে অবশেষে গাড়ি এসে দাঁড়াল স্টেশনে।
হুড়মুড় করে কিছু যাত্রী প্ল্যাটফর্মে নেমে আসতেই উঠে পড়ল প্রীতমরা। তড়িঘড়ি বসার সিট খুঁজতে থাকল। প্রত্যাশামতো সিট প্রায় খালিই ছিল। একটি খোপে ওরা জানালার ধার ঘেঁষে বসল মুখোমুখি। গাড়িতে জানালার পাশের সিটটি সব যাত্রীরই প্রিয়। যারা পরে এল তারা প্রীতমদের দেখে সামনে এগিয়ে গেল। মোটামুটি নিশ্চিন্তে গল্প করে যাওয়া যাবে ভেবে গুছিয়ে বসতে না বসতেই ছেড়ে দিল গাড়ি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল দু’জনই। টিকিটঘর পেরিয়ে এবার প্ল্যাটফর্মের অপর পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু’একজন যাত্রী নির্গমন পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার আবছা আঁধার দূর করতে জ্বলে উঠেছে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটপোস্টগুলোর উপর লাগানো বিজলিবাতি। ওরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে।
গাড়ি তখনও প্ল্যাটফর্ম ছাড়েনি। প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে এসে গেছে সম্ভবত। প্রীতম যাচ্ছে সামনের দিকে, উৎপল পিছন পিছন। প্রীতম দেখতে পেল লোকজন আর নেই প্ল্যাটফর্মের এই শেষ প্রান্তে। ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত একজন লোক শুধু একটি বাচ্চা ছেলেকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন চলন্ত গাড়ির দিকে। হয়তো কাউকে তুলে দিতে এসেছেন। গাড়ি তাদের কাছে আসতেই হঠাত প্রীতম এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতটি প্রাণপণে বাইরে বের করে চিৎকার করে উঠল -
হতভম্ব উৎপল চমকে গিয়ে বেসামাল প্রীতমকে জড়িয়ে ধরল। অবাক হয়ে দেখল মুহূর্তের মধ্যেই প্রীতমের পুরো শরীর ঘেমে একেবারে ভিজে জল হয়ে গেছে। চোখদু’টো বিস্ফারিত হয়ে আছে। জোর করে সিটে বসিয়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে খানিকটা জল ছিটিয়ে দিল প্রীতমের চোখে মুখে। গাড়ি ততক্ষণে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে একের পর এক গ্রাম প্রান্তর ছাড়িয়ে।
অসাড় প্রীতম যেন বিধ্বস্ত এক ভবঘুরের মতো বসে আছে সিটে। পকেট থেকে রুমাল বের করে তার মুখ কপাল মুছিয়ে দেয় উৎপল। অনেকটা সময় এভাবে বসে থাকার পর ধীরে ধীরে একটু সুস্থ বোধ হওয়াতে নিজেই অস্পষ্ট স্বরে স্বগতোক্তির মতো বলে প্রীতম -
- কী ?
- বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
Comments
Post a Comment