Skip to main content

দীপালিকায় জ্বালাও আলো


শরতের চলে যাওয়া মানেই এক উৎসবমুখরতার সমাপনে, শিউলির ম্রিয়মান সুবাসে, দাবদাহের অবসানে এক নতুন অনুভবের জন্ম। এ অনুভব কিছু পেতে চায় আঁজলা ভরে। অনাস্বাদিত কিছু মুহূর্তের খোঁজে চঞ্চল হয়ে ওঠে মন। ‘আরো আরো প্রভু আরো আরো, এবার যা করবার তা সারো সারো। আমি হারি কিম্বা তুমি হারো’। মন হারিয়ে যেতে চায় মহাকাশে, মাটির গন্ধে। ধীরে ধীরে হৈমন্তী আকাশ-মাটি এসে জায়গা করে নেয় ঝরা কাশের মন বনানীতে। ধানি রং মন মেঠো গন্ধে হয়ে ওঠে পাগলপারা। সৃষ্টির অপরূপ পালাবদলের মহিমায় সৃষ্টিকর্তার আভাস ফুটে ওঠে চরাচর জুড়েমনগগনে ধরা দেয় অবাক বিস্ময়, নয়ন মেলে দেখে তাঁর ভুবন জোড়া আসনখানি -
ভুবন জোড়া আসনখানি - ১
ফুলের হরষ, ঝড়ের পরশ, ভুবনবীণার সকল সুরের মূর্ছনায় অলক্ষ্যে মনোবীণায় আসন পেতে বসেন ভুবনলক্ষ্মী। আরাধনার মনোবাসনা এসে জড়ো হয় অন্তরের অন্তঃস্থলে। বাইরে ঘরে মৃদু রবে ধ্বনিত হয় যেন কার পুনরাগমন ধ্বনি। ঘরে ঘরে বেজে ওঠে মঙ্গলশঙ্খ। বিষাদিত সাঁঝ পুলকিত হয়ে ওঠে প্রেম আরতির আকুল আহ্বানে। ভবনে ভবনে জ্বলে ওঠে আঁধার নাশের আলো, শস্যসুখের আকুল কামনায় ধানের খেতে জ্বলে ওঠে হেমন্তের প্রথম প্রদীপ -
প্রথম প্রদীপ জ্বালো- ২
বিধাতার বরে নীরব ঘর মুখর হয় আবার। আলোর রোশনাই আবছা হয়ে ধরা দেয় মুদিত নয়নে। বন্দনা আশে পরান কাঁপে প্রদীপের শিখার মতো। যত ইচ্ছে, যত আবেশ সব প্রকৃতির গন্ধে রূপে রসে আপ্লুত হয়ে লুটিয়ে পড়তে চায় ভুবনমাতার রাতুল চরণে। নবরূপে নবদুর্গার আগমন বার্তা ধ্বনিত হয় আকাশে বাতাসে। আবাহনের আকুলতায় চঞ্চল হয়ে ওঠে মানবহৃদয়। আরতি নৃত্যের মন্দমধুর ছন্দে হৃদয় জুড়ে বাজে অঞ্জলি সঙ্গীত -
অঞ্জলি লহো মোর সঙ্গীতে - ৩
সব কথা, সব ব্যাকুলতা লুটিয়ে পড়ে জননীর পদতলে। সৃষ্টিজননী আদ্যাশক্তির আরাধনায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে প্রাণ। নিভৃত যাপনে বিস্ময় জাগে মনে। সৃষ্টি রহস্যের অকুল ভাবনায় জেগে ওঠে সমর্পণ। কে তুমি ভুবনমাতা, কী তোমার পরিচয় ? অগাধ জলরাশির মাঝে এ মহাবিশ্বের উত্থানে তোমার বিপুল মায়ায় রচিত হয় কত কত প্রাণ, কত নির্জীব সৌন্দর্যের অবস্থান। ভুবন জুড়ে এত রঙ, আকাশ জুড়ে এত তারার প্রদীপের এত আলো কোথা থেকে এলো জগত জুড়ে ? তোমার সৃষ্টিতে উচ্চারিত হোক তোমারই স্নিগ্ধ আরাধনা -
এ মহাবিশ্ব তোমারি সৃষ্টি - ৪
বসুধা শিল্পীর সুরে সুরে গান গেয়ে যায় বনের পাখি, গানের সুরে মেতে ওঠে ভুবন। মানব জীবনে সৃষ্টি হয় দুঃখ সুখের অনন্ত অনুভূতি। আরাধনায় জীবন ভরে ওঠে সুখে, সম্পদে। এ অপার মায়ায় জগৎসংসার বয়ে চলে রৌদ্র ছায়ার লুকোচুরির খেলায়। দুঃখ শোকের অন্ত কামনায় অন্তরে বাসনা হয় আরাধনা সঙ্গীতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। জাগতিক মোহাবেশে হেমন্তের এই নাতিশীতোষ্ণ যাপনে ইচ্ছে হয় ক্ষণিক মনের মতো মনকে সাজাই আর দৈন্যবেশে মায়ের চরণখানি ধরে রাখি দেহমাঝে, সাজিয়ে তুলি মনদেবতার মুরতিখানি -
এসো গো এসো গো এসো গো জননী - ৫
দীন দুর্বল মন আশার হিল্লোলে ভেসে চলে দয়াময়ীর আশীর্বাদ কামনায়। পার্থিব জীবনে বয়ে চলে সময়। কালের ধারায় থেমে থাকে না কিছুই। আসে একের পর এক দুঃখ সুখের পালা, আবর্তিত হয় একের পর এক ঋতু বদলের চক্র। হেমন্ত জুড়ে শীতের আগমন ধ্বনি মৃদু ছন্দে মাঝে মাঝেই দোলা দিয়ে যায় দেহ মনে। হিমের আমেজ অনুভূত হয় অবসৃত যাপনে। ঋতু বদলের অনুভবে কালের নিয়মে মুখ লুকায় চাঁদ, আবার আলোর ঝলকানিতে জেগে উঠে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় ভরিয়ে দেয় চরাচর। এভাবেই চক্রাকারে ফিরে ফিরে আসে আঁধার আলোর অপরূপ মায়াজাল। অমাবস্যার আঁধারকে তাই আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিতে বসুন্ধরায় মেতে ওঠে মর্ত্যবাসী। আলোর উৎসব দীপাবলির আনন্দে মগ্ন হয় যাপিত জীবন। আলোর পথের যাত্রীরা সব দীপালিকায় জেগে ওঠে আনন্দ সঙ্গীতে -
হিমের রাতে ঐ গগনের - ৬
তমসার অবসানে জগতজননীর আরাধনায় মেতে ওঠে নরনারী। পিতৃহৃদয়, মাতৃমন আপন আপন অনুভবে রত হয় জগন্ময়ীর পূজায়। নিবেদনে নিবেদনে মাতৃস্বরূপিনী জগন্মাতাকে ঘরের মানবী রূপে স্থাপন করে নেয় আপন ভাবনায়। মান অভিমান, সুখ দুঃখের জাগতিক ছন্দ ও ছন্দহীনতায় শামিল করে নেয় তাঁকে একান্ত কাছের একজন করে। একাত্মতায় উজাড় করে দেয় যত পার্থিব অনুযোগ। জননীর পায়ের তলায় স্থান পেতে আকুল হয়ে ওঠে হৃদয়। মায়ের পায়ের ফুল হতে লুটিয়ে দেয় নিজেকে -
বনের জবা কোন সুবাদে- ৭
শ্যামল শস্যের হৈমন্তী আঁধার রাতে শ্যামা মায়ের আগমনে মর্ত্যে জোয়ার জাগে আনন্দের। ক্ষ্যাপা সন্তানের সটান আলাপচারিতায় মা হয়ে ওঠেন একান্ত আপন ঘরের মেয়ে। অনির্বচনীয় সুরের সৃষ্টিতে মা চলে আসেন সোজা ভক্তের হৃদয়াসনে। রামপ্রসাদ আর কমলাকান্তের অপরূপ সুরবন্ধনে প্রকাশিত হয় শ্যামা মায়ের রূপমাধুর্য। মা কখনো শ্বেত, কখনো পীত, কখনো বা নীললোহিত। মায়ের সে ভাব বুঝে কার সাধ্যি ? তাই সহজ মন শুধুই পাগল হয়ে থাকে সন্তান হয়ে মায়ের চরণে -
শ্যামা মা কি আমার কালো - ৮
সমর্পণে সমর্পণে কালী মায়ের পায়ের তলায় সাধক মন খুঁজে খুঁজে পায় হৃদি রত্নাকর। ভাবসাগরে ডুব দিয়ে সেই মহাকালের অগাধ ধনকে কুড়িয়ে নিয়ে নিজেকেই বিলিয়ে দিতে চায় জগতজননীর কোলে। ষড়রিপুর কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজেকে সমর্পিত করতে উতলা হয়ে ওঠে ভক্তহৃদয়। শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে বেজে ওঠে আরাধনা সঙ্গীত -
ডুব দে রে মন কালী বলে - ৯
ভাবসাগরের সেই রত্নাকরে পড়ে আছে ভক্তিরসের কতই না মণি মাণিক্য। সেই রত্নকে পেতে গেলে নিজেকে নিবেদন করে দিতে হয় সৃষ্টিরূপিনীর মহাসৃষ্টির মাঝে। তবেই না ফলবে রতন। সেই বিস্ময়ভরা সৃষ্টির মাঝেই আবার লুকিয়ে থাকে মহাকালের অন্তবেলা। অনন্ত মহাশূন্যের পথে বিলীন হওয়ার অমোঘ সত্য। সেই সত্য পথে যুগ যুগ ধরে জন্ম নেওয়া যুগন্ধর সাধকের চলার পথের নুড়ি হয়ে আমরাও তাই রচে যাই আরাধনা সঙ্গীত। সমর্পণের আকুলতায় পূজার উপচারে অন্তরের অন্তর্নিহিত নয়নে দেখে যেতে চাই অরূপ লালিমা। আর আজকের এই হৈমন্তী নিশায় আগন্তুক দীপাবলীর সাঁঝের বেলায় কালীমায়ের আরাধনায় কালচক্রে বিলীন করে দেই নিজেকে। বিদ্যুৎ প্রজ্ঞায়, সঞ্জীব সুরে, সুচয়িতা উচ্চারণে, সঞ্জীবনী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে - দীপালিকায় জ্বালাই আলো, জ্বালাও আলো, দূর করো এই তামসীরে -
মা গো, তোমার দুটি অভয় করে - ১০।

 

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়