Skip to main content

উত্তরপূর্বের কবিদের কবিতার আন্তরিক বিনির্মাণ ‘অপার বাংলা’


‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।’ ...... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সুখের সন্ধানে মানুষের অতৃপ্তির ভাবনা বিষয়ক ‘মোহ’ শিরোনামের এই কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণিকা গ্রন্থের অন্তর্গত এক বহুপঠিত কবিতা। মূল ভাবের দিকে দৃষ্টিপাত না করে অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতাটিকে দেখলে পাওয়া যায় এপার-ওপারের এক নান্দনিক অর্থসূচক ব্যঞ্জনা। এপার ওপারের সংজ্ঞা লেখক, আলোচক কিংবা দর্শকের চোখে ভিন্ন আবহে ভিন্ন অর্থ নিয়ে আসে। নদী পার হলেই বদলে যায় এপার-ওপারের সংজ্ঞা।
কবি সঞ্জয় চক্রবর্তীর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থও এমনই এক দ্ব্যর্থক ব্যঞ্জনা নিয়ে। গ্রন্থের নাম ‘অপার বাংলা। অপার অর্থে এপারও নয়, ওপারও নয় - এ হচ্ছে উভয়পারের বৃত্তান্ত। এক্ষেত্রেও এপার ওপার কিংবা অপারের সংজ্ঞা নির্ধারণ নির্ভর করে সেই বক্তা বা দর্শকের নিজস্ব অবস্থানের উপর। ইতিপূর্বে সঞ্জয়ের বিভিন্ন কবিতায় দেখা গেছে গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ইছামতী, ধানশিরি থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক এসেছে অসংখ্যবার, ভিন্ন ভিন্ন আবহে, অনুষঙ্গে।
ভৌগোলিক সীমারেখা কিংবা বিভাজনসূচক নদীর মাধ্যমেই নির্দিষ্ট হয় পারাপারের বৃত্তান্ত। কবি সঞ্জয় চক্রবর্তীর কবিতা-বিশ্ব গঙ্গাও নয়, মেঘনাও নয়। মূলত বরাক, ব্রহ্মপুত্র, খোয়াই, গোমতীকে বুকে ধরেই তাঁর কাব্যস্রোত। অর্থাৎ কিনা কবিতার এই উত্তরপূর্বকে কেন্দ্র করেই কবি সঞ্জয়ের কাব্যধারা। ২০১৫ তে প্রসূন বর্মন, প্রবুদ্ধসুন্দর কর ও অমিতাভ দেব চৌধুরীর সম্পাদনায় ভিকি পাবলিশার্স, গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘উত্তর-পূর্বের বাংলা কবিতা’ শীর্ষক সংগ্রহযোগ্য একটি সংকলন গ্রন্থ যেখানে সন্নিবিষ্ট হয়েছিল সঞ্জয় চক্রবর্তী সহ এই উত্তরপূর্বের মোট ৭৮ জন নির্বাচিত কবির কবিতা। এখানে স্থান পেয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়কাল অবধি বহু বিশিষ্ট কবিদের পাশাপাশি কিছু অপেক্ষাকৃত স্বল্পখ্যাত কবির কবিতাও। বলা যায় উত্তরপূর্বের কবিতার প্রাথমিক পর্ব থেকে সমকালিক অবস্থান অবধি একটা রূপরেখা তৈরির প্রচেষ্টা। সেই ৭৮ জন কবির মধ্য থেকে নিজেকে সরিয়ে বাকিদের কবিতার ধাঁচ অনুসরণ করে ৭৭ জন কবিকে নিয়ে নিজস্ব ধারণায় কবি সঞ্জয় এঁকেছেন এক অনবদ্য কবিতামঞ্জরী। বলা যায় কবিতার সগৌরব ধ্বজাবাহকদের প্রতি সৃষ্টি করেছেন এক অনন্যসাধারণ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
এতজন কবির কাব্যধারাকে নিয়ে রীতিমতো গবেষণালব্ধ এক বিরল কাজ করেছেন সঞ্জয়। এই চিন্তাধারা, এই উদ্যম, উদ্যোগ এবং সফল রূপায়ন সম্ভবত তাঁর পক্ষেই সম্ভব। বিশিষ্ট কবিদের তিনি উৎসর্গ করেছেন তাঁদেরই বহুখ্যাত কবিতার ছন্দধারায়, তাঁদেরই জীবন ও সৃষ্টিবিষয়ক কবিতা। এক অসাধ্যসাধন বটে। এ নিয়ে ভূমিকায় কবি লিখছেন - ‘উত্তরপূর্বের বাংলাভাষার কবিদের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাই এই কবিতাগুলি রচনার উৎস। ...সংকলনে সংকলিত কবিদের উদ্দেশ্যেই আমার এই রচনা। বলা বাহুল্য, এর বাইরেও অনেক কবি রয়ে গেছেন, যাঁদের নিয়ে আমি লিখিনি। এই কবিতাগুলি আমি লিখিনি। লিখেছেন সেই কবিরাই। আমি শুধু বিনির্মাণের চেষ্টা করেছি। বলা যেতে পারে, তাঁদের কাব্যভুবনকে মাত্র একটি কবিতায় ধরার একটি দুরূহ এবং অক্ষম প্রয়াসের দুঃসাহস দেখিয়েছি। কবিরা আমাকে ক্ষমা করবেন। অন্তরের পরম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসাই আমাকে তাড়িত করেছে।’
কবিতাগুলির শিরোনাম কবিদের নামেই রেখেছেন সঞ্জয়। দু’একটি পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে এই পরিসরে -
প্রহরকে বলেছ মা, আমি জন্ম অহংকারী
বাবা শিখিয়েছেন সূর্যপ্রণাম, রোজ ভোরে মন্ত্র পড়ি...। (কবিতা - বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য)।
...ডালিমের গোলাকার অবয়ব থেকে
ছিটকে বেরোল যে রক্তাভ দানা, স্বধর্মে সে
পাতিপুরুষ, অ্যানাটমিও খুঁজে পেল না একটি দেশ...। (কবিতা - মিলনকান্তি দত্ত)।
...আমি এক বিষাদবালক
অসুখ অহরহ সাইরেন বাজায় আমার ধমনীর ভেতর
আর আমি বারবার ফিরে যাই গয়েরকাটা।
হ্যালুসিনেশনের পর আমি শান্ত
জল সরে গেলে অসামান্য কাদা। (কবিতা - বিকাশ সরকার)।
বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ, গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত আলোচ্য গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন বিশিষ্ট লেখক, সম্পাদক সুকুমার বাগচীকে। স্পষ্ট ছাপা, সুচারু বাঁধাই, শুদ্ধ বানান, যথাযথ অক্ষরবিন্যাসে প্রকৃতই এক সংগ্রহযোগ্য গ্রন্থ হয়ে উঠেছে ‘অপার বাংলা’। উদয়ন বিশ্বাসের প্রচ্ছদ যথাযোগ্য। কোথাও কোথাও মূল কবিদের কবিতার ছন্দজনিত পঙ্‌ক্তিবিন্যাস হুবহু এক না হলেও প্রতিটি কবিতার ভাব, শব্দাবলির অধ্যয়নজনিত প্রয়োগ কবি সঞ্জয়ের এই প্রয়াসকে একশো শতাংশ সাফল্যে অভিষিক্ত করেছে নির্দ্বিধায়।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৬৪২৬৩৩৭০ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি