Skip to main content

কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যা ‘ঈশান’


জন্মান্তর থাক বা না থাক
আমি কিন্তু জন্ম নেব পুনর্বার
এই বলে রাখি
তোমাকেই হল না দেখা পুরোপুরি
আরো কত ভালোবাসা বাকি… (কবিতা - জন্মান্তর)
কিংবা -
তুমি ফিরে এসো এ কথা বলেনি কবি কোনোদিন,
যখন বলার মতো হয় এই কথা, তার আগে সকলই হারায়।
কবি চেয়েছিল তুমি বলে যাবে কেন এই যাওয়া
সেই চাওয়াটুকু এতকাল পরে ছাড়ে না যে তারে।... (কবিতা - কবি একা একা খোঁজে)
এই ইহকাল, এই সংসারনদীর বয়ে যাওয়া, জীবন আর মরণকে আবহে অনুষঙ্গে ভিন্নতর চোখে প্রত্যক্ষ করা, মৃত্যুকে নিজের মতো করে অনুশাসনের মোড়কে প্রস্ফুটিত করার মতো দৃপ্ত সাহসী উচ্চারণ যাঁর কবিতায়, গদ্যে প্রত্যক্ষ করে এসেছে ঈশানের এই সাহিত্য-বিশ্ব সেই যুগন্ধর কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের প্রয়াণ যেন স্তব্ধ করে দিয়ে গেল কোনও এক কিংবা একাধিক নাম না জানা নদীর সহজ চলার পথ। নদীকে তিনি দেখেছিলেন এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টিতে। তাঁর অসংখ্য কবিতায় ফুটে উঠেছে নদীর অসংখ্য আবহ। জীবন নদীর চলার পথে তিনি এঁকেছিলেন জীবনবোধের এক ব্যতিক্রমী চিত্রপট।
সেই ব্যতিক্রমী কবি সাহিত্যিকের সদ্য প্রয়াণের পর তাঁরই স্মৃতি রোমন্থনে, তাঁকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে প্রকাশিত হয়েছে ‘ঈশান’ পত্রিকার নববর্ষ ১৪৩১ সংখ্যা, বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা। একটি স্মৃতিচারণমূলক সংকলনের যাবতীয় গুণে সমৃদ্ধ এই সংখ্যাটির মাধ্যমে একাধারে যেমন তুলে ধরা হয়েছে প্রয়াত কবির জীবন ও সাহিত্যকৃতির টুকরো ঝলক ঠিক তেমনই তাঁর অগণিত গুণমুগ্ধ পাঠকের এবং বহু বিশিষ্ট কলমচির চোখে কেমন ছিল তাঁর কবিসত্তা ও কাব্য-সাহিত্য গুণ তারও এক পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিনিধিত্বমূলক বিচার-বিশ্লেষণ।
২০৭ পৃষ্ঠার এই সুচয়িত সম্ভার-সমৃদ্ধ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে আছে বহু তথ্য, বহু ভাববিজড়িত অনুসন্ধান। আছে কবিকে নিয়ে এক সার্বিক মূল্যায়ন - ‘রত্নগর্ভা ঈশান বাংলা কিছুদিন আগে অমূল্য রত্ন হারিয়েছে। আক্ষরিক ও রূপক অর্থে যিনি নিরলস যোদ্ধা, সেই অগ্রজ কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য গৌরবজনক ইতিহাস নির্মাণ করে সেই অনন্ত পরিসরে বিলীন হয়েছেন। ‘সাহিত্য’ পত্রিকা তাঁর অসামান্য অবদানে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। সেই পূর্বসূরি আজ অশ্রুনদীর সুদূর পারে। ঈশান তাঁর ক্ষয়হীন পরম্পরার গর্বিত শরিক...।’ আসলেই ‘সাহিত্য’ পত্রিকা বলতে গেলে ঈশানের জাত চিনিয়ে দিয়েছে বহির্বিশ্বে।
সংখ্যাটির শুরুতেই রয়েছে প্রয়াত কবির একগুচ্ছ কবিতা এবং গল্প - ‘মা’। রয়েছে দুটি প্রবন্ধও - ‘লিটল ম্যাগাজিনই সাহিত্যের মূল স্রোত’ এবং ‘আসামে আধুনিক বাংলা কবিতা’। বস্তুত এই দুটি বিষয়কে নিয়ে তিনি লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ। বলা যায় এখানেই প্রোথিত ছিল তাঁর সার্বিক মনন-চিন্তন। বহির্বরাকে নিজস্ব এক স্থান গড়ে উঠলেও তিনি ছিলেন এই একান্ত আপন সাহিত্যবিশ্বেরই এক আদ্যোপান্ত পূজারি। উল্লিখিত কবিতাগুচ্ছের সবগুলো কবিতা হয়তো তাঁর লেখা শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে পড়ে না। আসলে গুণমানে সমৃদ্ধ বিশাল এই কাব্যসম্ভার থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতার খোঁজই এক অনর্থক পণ্ডশ্রম। এরপর রয়েছে কবির সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি। রয়েছে ‘একটি অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার; কবিপত্নী শিখা ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় ঈশান। সহযোগিতা করেছেন ‘প্রবাহ’ - সম্পাদক আশিসরঞ্জন নাথ। এরপর কবিকে নিয়ে কলম ধরেছেন অপরাপর বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিকবৃন্দ। তাঁদের লেখায় যেন নতুন করে জেগে উঠেছেন কবি, সাহিত্যিক, ব্যক্তি বিজিৎকুমার। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়সমৃদ্ধ এই লেখাগুলির বিষয়ে আলাদা করে আলোচনা পরিসরে কুলোবে না বলে শুধু শিরোনামের উল্লেখেই সারতে হবে দায়। প্রত্যেকেই নানা বিষয়ে নানা আঙ্গিকে মূল্যায়ন করেছেন তাঁর ব্যক্তিসত্তা এবং সাহিত্যিকসত্তাকে। ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য লিখছেন - ‘ভাষাদর্পণে তুমি ও আমি’, হীরেন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন - ‘মুখর নৈঃশব্দ্যের অন্ধকার - কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য’। একের পর এক রয়েছে - তপোধীর ভট্টাচার্যের ‘নন্দনযোদ্ধা বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য’, রণবীর পুরকায়স্থের ‘নির্বাসিত বাংলার কাহিনি’, পৃথ্বীশ দেশমুখ্যের ‘বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের কবিতা’, সমীর চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি শুধু একবারই ছুঁয়ে যাব তোমার বিস্ময়’, ‘পীযূষ রাউতের ‘বিজিতের কবিতা বিষয়ক ভাবনা’, উদয়ন ঘোষের ‘প্রিয় বন্ধুর তর্পণে’, মিথিলেশ ভট্টাচার্যের ‘ও ছেলে বাউল ছেলে’, কিরণশংকর রায়ের ‘বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য - তাঁর ‘সাহিত্য’ ও কবিতা বিষয়ক কয়েকটি কথা’, সুব্রত কুমার রায়ের ‘জেগে আছে স্তব্ধতায় - বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের কবিতা’, আশিসরঞ্জন নাথেরমৃত্যুর পরেও তিনি হেঁটে যাবেন রৌদ্রে’, শঙ্কু চক্রবর্তীরআমার অভিভাবক - শ্রদ্ধেয় বিজিৎদা’, স্বপ্না ভট্টাচার্যেরতোমরা তো ডাকবে না কেউ, তবু যাব এই অবেলায়’, মৃন্ময় রায়েরছায়া’, বিশ্বতোষ চৌধুরীর বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের কবিতা - প্রকৃতি ও প্রেমের মেলবন্ধন’, দিলীপকান্তি লস্করেরবিজিৎদাকে যেমন দেখেছি’, সুভাষ কর্মকারেরবিজিৎকুমার ভট্টাচার্যকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা’, শংকরজ্যোতি দেবেরউনিশের সফল উত্তরাধিকারএবং দেবাঞ্জন মুখোপাধ্যায়েরবিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের কবিতায় সময় ও সমাজ বিশিষ্ট সব প্রাবন্ধিক, সমালোচক, সাহিত্যিকদের এই তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদনে প্রকৃতার্থেই যেন পাঠক সমাজের চোখের সামনে বিমূর্ত হয়ে উন্মোচিত হয়েছেন বিজিৎকুমার
প্রায় একশো শতাংশ নির্ভুল বানানযুক্ত গোটা সংকলন জুড়ে এক গভীর যত্নের ছাপ পরিষ্কার ফুটে উঠেছে বিষয়সূচি, ছাপা, শব্দ, বাক্য, পঙ্ক্তিবিন্যাস প্রতিটি ক্ষেত্রেই গভীর গরজের সুস্পষ্ট ছাপ প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে ভাস্কর (.) স্বপন পাল প্রকাশক - অন্বেষক সামাজিক সংস্থার পক্ষে তরুণ গুহ। মুদ্রক - অক্ষরযাত্রা, কলকাতা। সংকলনের সম্পাদক অমিতাভ সেনগুপ্ত সম্পাদকীয়তে লিখছেন - ‘এই সম্পাদক এখানে সংকলক মাত্র’ তবু বলা যায় এই সংখ্যাঈশাননিঃসন্দেহে পালন করেছে এক গভীর দায়িত্ব, যথার্থ স্মৃতিচারণের মাধ্যমে    
এক কথায় এক সংগ্রহযোগ্য সংকলন যা ভবিষ্যতের জন্য এক দলিল হয়ে রইবে নিঃসন্দেহে

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ৩০০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০২২৩০৪৩০ 

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি