প্রতিবেশী
দেশ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অশান্তি, হিংসা ও পালাবদলের পালা চলছে বেশ কিছুদিন
ধরেই। এ নাকি নব্য স্বাধীনতা। এই নিয়ে বহুবার স্বাধীন হল দেশটি, তবু কাঙ্ক্ষিত
লক্ষ্যে পৌঁছোতে পেরেছে কিনা তা সে দেশের জনগণই ভালো বলতে পারবেন। বাংলাদেশ নিয়ে
মাতামাতি আমাদের খানিকটা বেশিই। সে হবে নাই বা কেন ? পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে কি
আর চোখ কান বুজে ঘুমোনো যায় ? তবে সব ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক নয় জেনেই আমরা কিছু
কিছু ব্যাপারে অপেক্ষাকৃতভাবে নীরব থাকি। একটি দেশের সরকার কার হবে, কে হবেন
দেশনেতা সে বিচারের ভার সংশ্লিষ্ট দেশটির জনগণই ঠিক করবেন। আমাদের সেখানে বলার
কিছু নেই। কিন্তু এবারের ঘটনাপ্রবাহ এমনই যে এই ব্যাপারেও বেরিয়েই এল কিছু কথা,
আমাদের অন্তর থেকে, স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই। এর পিছনে যে কারণটি মুখ্য তা হল বঙ্গবন্ধু
মুজিবুর রহমান ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিমূর্তি ভেঙে ফেলার মতো
ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
ঈশান বাংলার অধিবাসী হওয়ার সূত্রে ১৯৭১ এর মুক্তি সংগ্রাম ও তৎকালীন পরিস্থিতির কথা আমরা আমাদের পূর্বজদের মুখ থেকে শুনেছি। কীভাবে একটি দেশের স্বাধীনতা আনতে মুজিবের অবদানকে আজ অস্বীকার করা হচ্ছে সে কারোও বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। যেমন বোধগম্য নয় ভারত-বিরোধিতা। অকৃতজ্ঞতারও একটা সীমা থাকা উচিৎ। পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার চক্রান্ত, সেনা লেলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার মতো পাশবিক কার্যকলাপের কথা বেমালুম ভুলে গেল ওদেশের ছাত্র-রাজনীতির ধ্বজাধারীরা ? সে কীসের ভিত্তিতে ?
সে যাই হোক, এ বিষয়টি এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য নয়। কথা হচ্ছে এইসব রাজনৈতিক কার্যকলাপের অন্তর্গত কিছু অন্তর্নিহিত অবলোকন। আমরা দেখলাম সাম্প্রতিক এই আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশ জুড়ে চলল সংখ্যালঘু - বিশেষ করে হিন্দুদের উপর যথাপূর্বক অত্যাচার। অত্যাচার শুধুই শারীরিক হয় না। মানসিকও হয়। ও বাড়ির মেয়েটিকে জবরদস্তি তুলে নিয়ে গেলে এ বাড়ির লোক আর কোন ছাই শান্তিতে থাকতে পারেন ? ধর্মীয় স্থান ভেঙে দিলে থাকা যায় শান্তিতে ? এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে।
(১) বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতা
এই সম্পূর্ণ পট পরিবর্তনের আবহে কিছু পারিপার্শ্বিক চিত্র আজকের দিনে বড়ই প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিয়েছে। এদেশের বুদ্ধিজীবিরা, যারা মূলত হিন্দুবিরোধী - তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। এত বড় একটি ঘটনা ঘটে গেল পাশের বাড়িতে অথচ এরা বাধ্য হয়ে গেছে মুখে কুলুপ এঁটে রাখতে। প্রাথমিক পর্ব অবশ্য এরকম ছিল না। ছাত্র আন্দোলন, যা ছিল মূলত কোটা বা সংরক্ষণবিরোধী আন্দোলন তার সমর্থনে এবং সে দেশের সরকারের অনমনীয় মনোভাবের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেছিল এরা বেশ আটঘাট বেঁধেই। অথচ নিজেদের দেশে এরা সংরক্ষণের সমর্থক। এমন দ্বিচারিতাই এদের বিশেষত্ব। এরপর যখন সেই আন্দোলন হাইজ্যাক হয়ে গেল রাজনৈতিকভাবে তখনই শুরু হল সরকার পতন এবং দেশ ছাড়লেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এই অরাজক অবস্থায় দেশ জুড়ে শুরু হল অত্যাচার, উৎপীড়ন, খুন, ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা। নির্বাচিত সরকারের সমর্থক আওয়ামী লিগের সদস্যদের পাশাপাশি হত্যা করা হলো হাজারেরও বেশি পুলিশ কর্মীকে। জ্বালিয়ে দেওয়া হল থানা এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের যাবতীয় দলিলপত্র। এবং ফি-বছরের প্রাক-পূজা বার্ষিক আনন্দোৎসবের মতোই শুরু হল হিন্দুদের উপর অত্যাচার। এবার বেকায়দায় পড়ে গেলেন এই কুবুদ্ধিজীবীরা। লুকিয়ে পড়লেন গর্তে। কারণ এর প্রতিবাদ করার মতো জিন এদের শরীরে নেই। হিন্দু শব্দটিতেই তাদের অ্যালার্জি। এই শব্দটি ওরা লিখতেও পারে না, উচ্চারণও করতে পারে না। এর উল্টোটা হলে দাপিয়ে বেড়ায় এই প্রজাতির লোকেরা।
সামাজিক মাধ্যমে এরা চুপটি মেরে সুযোগের অপেক্ষায় রইল। কেউ কেউ এর মধ্যেও নির্লজ্জ ভাবে উলটো কথা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে এসব ধোপে টেকেনি। সামাজিক মাধ্যমে আসতে থাকল একের পর এক নির্লজ্জপনার ছবি, ভিডিও। তার মধ্যেই একটি ভিডিও এল, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের একটি ছবির নীচে কিছু ক্যাপশন লেখা ছিল যা আপাতদৃষ্টিতে ফেক অর্থাৎ ভুয়ো বলেই মনে হচ্ছিল এবং সেদেশের অনেকেই এটিকে অসত্য বলে মন্তব্য করছিলেন। ইতিমধ্যেই এটি বহুলভাবে শেয়ার হয়ে গেছে। এবার এই ছুতোয় সেই দুর্বুদ্ধিজীবীরা আবার আসতে চাইলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। অভিযোগ - সবাই নাকি না জেনেবুঝেই যা তা ছড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। কী তাদের অসহিষ্ণুতা ! এরা এদেশে সুখের ঘরে থেকে গ্রাউন্ড রিয়্যালিটি থেকে শত যোজন দূরে। এতদিন ধরে যারা চুপ করেছিলেন বা দুমুখো মন্তব্যের মাধ্যমে অস্তিত্বের লড়াইতে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন তারা সরব হতে চাইলেন। কিন্তু এই একটি ভিডিওর সূত্র ধরে এসব বিরোধিতার কি কোনও মূল্য থাকতে পারে ? অপরাপর অপরাধের ভিডিও তো একশোভাগ খাঁটি। সেসব নিয়ে তারা চুপ কেন ? বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার কি নতুন ? এ তো প্রতি বছরেই হয়ে থাকে। সেসব কি মিথ্যা ? আসলে সেসবে তাদের তো কিছু যায় আসে না। তাদের এই নির্লজ্জ কাণ্ডকারখানা সভ্যতার পরিপন্থী।
এই কুবুদ্ধিজীবীরা বড়ই অদ্ভুত। এরা ভগবান মানে না কিন্তু অধিকাংশ বাড়িতে লুকিয়ে পুজোআচ্চা করে। কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যেও করেন। পুজো শেষ হলেই বলেন এটা হচ্ছে আচার, আমরা ধর্ম মানি না, পুজো মানি না। কিম্ভূতকিমাকার অবস্থা। এরা মারা গেলে হিন্দু ধর্মানুযায়ী দাহকার্য হয় এবং শ্রাদ্ধও হয়। তবু এরা সমাজে বিশেষ হয়ে থাকার অভিলাষে জীবন্তে এই মিথ্যাচারে মত্ত থাকে। এদের স্বভাবই হচ্ছে হচ্ছে উলটো সুরে কথা বলা। তাই এরা নিয়তই জনসাধারণের মতের বিরুদ্ধবাদী। অপরিণত বয়সেই এরা মগজধোলাইয়ের শিকার। সেই মগজ আর সারা জীবনেও শুদ্ধ, পরিশিলীত হয় না। সুসংঘবদ্ধ সমাজটাকে এরা বিষিয়ে তোলে পরিকল্পিতভাবে। সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎটাকে যুগ যুগ ধরে করে রেখেছে কুক্ষিগত। অযোগ্যকে খ্যাতনামা করেছে, যোগ্যকে করেছে বঞ্চিত। দেশভাগ নিয়ে কান্নাকাটি করলেই সাহিত্য হয় না। দেশভাগ নিয়ে তাদের কোনও প্রতিবাদ নেই। মতের অমিল হলেই এই মিথ্যাচার আজও চলছে অবিরত।
ভারতে সরকার পরিবর্তন হওয়ার ফলে এদের অসহিষ্ণুতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এরা গণতন্ত্রের পক্ষে চিরদিনই বিপদজনক। গণতান্ত্রিকভাবে যেখানে এদের শাসনে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই তখন এরা অন্য দলের লেজুড়বৃত্তি করে উপরে উঠতে চাইছে। শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান দেখে এরা আজ উল্লসিত। এ দেশেও এভাবেই অবৈধ উপায়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার স্বপ্নে এরা মশগুল। দক্ষিণপন্থী এক বিরোধী দলের এক নেতা তো দিনকয়েক আগে অতি উৎসাহে সেরকম ইঙ্গিত দিয়েই ফেললেন সামাজিক মাধ্যমে। অসহিষ্ণুতার চরম নিদর্শন। এই ঈশানের অধিবাসী এক বামাচারী বাংলাদেশ কাণ্ডের প্রথম দিনেই উল্লসিত হয়ে একটি পোস্ট দিলেন ফেসবুকে। সম্ভবত কিছু বিরূপ মন্তব্যের কারণে পরদিন এই পোস্ট মুছে দিয়ে মন্তব্য করলেন - আমি এখন বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলব না কারণ সবটা আমি এখনও পুরোপুরি জানি না। এর পরদিনই আবার তিনি পোস্ট না দিয়ে থাকতে পারলেন না। অসহিষ্ণুতার কী নির্লজ্জ নিদর্শন।
(২)
বছরে বেশ কয়েকবার এদেশ থেকে একদল কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক জগতের ব্যক্তিরা ওদেশে যান ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়’ গড়ে তোলার অছিলায়। এত বছরে কতটুকু সমন্বয় হয়েছে সে তো দেখাই যাচ্ছে। এসব শুধু ফুর্তি, বিদেশ ভ্রমণ, নাম কামানো আর আর্থিক লাভালাভের উদ্দেশ্যে। এর বাইরে কিছুই নয়। এদের মধ্যে কেউ আজ অবধি ওদেশে গিয়ে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু বলেছেন কি ? অসম্ভব। তাহলে কীসের সমন্বয় ? গেলেন, ফুর্তি করলেন আর সামাজিক মাধ্যমে রসিয়ে লিখলেন - ...ভাই, ...ভাইয়ের আমন্ত্রণে সফরে গিয়ে ...ভাইয়ের ঘরে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে তাদের আন্তরিকতা, আপ্যায়নে আমরা মুগ্ধ। যেন দেশোদ্ধার করে ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙার বেলায় তারা চুপ। কোথায় রইল সাংস্কৃতিক সমন্বয় ?
আসলে এসবই হচ্ছে যুগ পুরোনো মগজ ধোলাইয়ের খেলা। যে খেলায় অপাপবিদ্ধ কিছু মানুষ নিজেরই অজান্তে ডুবে যাচ্ছে মিথ্যা স্বপ্নের মায়াজালে। মিথ্যা ইতিহাস, মিথ্যা প্রচারের জেরে এরা ইতিমধ্যেই দেশটার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিটি ঘটনায় এরা অবাধে সংখ্যালঘুর পক্ষে মাঠে নেমেছে। সংখ্যালঘুদের কুকীর্তির বেলায় এরা নিশ্চুপ থাকে বরাবর। এই ঈশানে, এই রাজ্যে যত চুরি, ডাকাতি, পকেটমারি, খুন ধর্ষণ, রাহাজানি, ড্রাগসের অবৈধ কারবার সবকিছুতেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু। কিন্তু এসব নিয়ে এই বিশেষপন্থীরা মুখে চিরদিনই তালা আটকে রাখে। আসলে ছোট থাকতেই তাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে দেওয়া হয়।
(৩)
একটি অভাবিত বিষয়ের অবতারণায় প্রথমেই বলে রাখা ভালো - ধর্মকে আফিম বলেছিলেন এক সম্প্রদায়ের গুরুদেব কার্ল মার্ক্স। সে অনেক আগের কথা। এতদিনে আজকের বিরুদ্ধবাদীরা এদেশে ধার্মিক সচেতনতা এবং বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের বিশাল সম্ভার থেকে সবার দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে এক নতুন আফিমের আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সেও বড় কম দিন হল না। সে আফিম হল ভাষা, মাতৃভাষা। তারা এমনভাবে ভাষার আফিম খাইয়েছেন যে জনগণ ধর্মের কথা ভুলে যেতে বসেছেন। এটাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। অথচ একটি ব্যক্তির মুখের ভাষা যতটা প্রয়োজন ততটাই প্রয়োজন নিজস্ব পরিচিতি, সামাজিক ও পরম্পরাগত অবস্থিতি যা ধর্মাচরণেই প্রকৃষ্টভাবে ফুটে ওঠে। শেখানো হচ্ছে - ধর্ম হচ্ছে অদরকারী, আমরা সর্বধর্মে বিশ্বাসী কিংবা ধর্মহীনতায় বিশ্বাসী। সেক্যুলার শব্দটিই এই দেশের কাছে এক প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধভাবে তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সংবিধানে। কী বিরাট পরিকল্পনা তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। কেন, নিজ নিজ ধর্ম অনুসরণ করে সবাই একত্রে বসবাস করতে পারে না ? পারছেই তো এদেশে। কিন্তু ওদেশে তা হবার নয়। হয়নি। সংখ্যালঘু হিন্দুরা দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই নিপীড়িত। কিন্তু কেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কি হিন্দুদের অবদান নেই ? সবাই একত্র হয়ে যখন ভাষার প্রশ্নে দেশকে স্বাধীন করল ঠিক তখনই ফোকাস কী করে ঘুরে গেল ভাষা থেকে ধর্মের দিকে ? মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া অন্যতম বর্বর ধর্মভিত্তিক হিংসাত্মক ঘটনা। যার ফল আজকের এই টানাপোড়েন। তবু আমরা আজও ভাষা ভাষা করে বিগলিত। ভৌগোলিক ভাবে বাংলা দুটিই - পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা এ কথা জেনেও। মনে রাখতে হবে আমরা কিন্তু কোনো বাংলার অধিবাসী নই। এ রাজ্য আমাদের পূর্বপুরুষদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলা আমরা বলছি, বলবও। ভাষার উপর আঁচ এলে তা প্রতিহতও করবই। তা বলে ভাষাভিত্তিক বৈরীতা কোনওভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। অথচ উলটোপন্থীরা আমাদের ভাষার আফিমে মজ্জিত রেখে ধর্ম ভুলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। ওরা বোঝাতে চেষ্টা করে ওদেশের মানুষও বাঙালি, আমরাও বাঙালি। সুতরাং ভাই ভাই। নিপীড়ন তাহলে কীসের ভিত্তিতে সে নিয়ে চুপ। ওরা ওদেশে গিয়ে কান্নাটান্না করে কিন্তু প্রতিবাদ করে না। অথচ ওরা বলে প্রতিবাদই ওদের হাতিয়ার। আসলে ওরা সরল খেটে খাওয়া মানুষ আর কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মগজে পরিকল্পিতভাবে ঢুকিয়ে দেয় মিথ্যাচার আর ভুল বার্তা। ধর্ম পরিবর্তিত হলে বা ধর্মচ্যূত হলে পৃথিবীর কোন জিনিসটা অপরিবর্তিত থাকবে ? আলো, হাওয়া, জল কি একই থাকবে ? প্রত্যেকেরই নিজের ধর্ম আছে। এটা বোঝা উচিৎ। বিশেষ করে আজকের দিনে যখন আমরা অন্য দেশে লাঞ্ছিত আর এদেশে মিথ্যাচারের ফাঁদে আক্রান্ত। আমাদের দিকে আঙুল তোলে আরোও অনেকেই যারা ইতিহাস পড়েনি ভালো করে। বলে আমরা নাকি ওদেশ থেকে পালিয়ে এসেছি। অতি উৎসাহে কেউ আবার তথ্য না জেনে বলেন ‘কাঁটাতারের তলা দিয়ে পালিয়ে আসা’ বাঙালির বংশধর আমরা। অথচ সীমান্তে কাঁটাতার লেগেছে এই সেদিন। আর যারা সেইসব দিনের বীভৎসতা দেখেননি বা জানেন না, যারা অবাঙালি বা আধা বাঙালি তাদের পক্ষেই ‘পালিয়ে আসা’ শন্দটির প্রয়োগ সম্ভব। পালানো আর সরে আসার মধ্যে ফারাক আছে। পালানো শব্দটি ইচ্ছে করেই প্রয়োগ করা হয় তুচ্ছার্থে। স্বামী বিবেকানন্দ যখন উত্তর ভারতের এক আশ্রমে কিছু ভণ্ড সাধুদের দ্বারা বন্দি হয়েছিলেন তখন একটি বালিকার সাহায্যে তিনি সেখান থেকে সরে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাহলে তো বলতে হয় স্বামী বিবেকানন্দও তাহলে একদিন পালিয়েছিলেন। হাজার হাজার উন্মত্ত সশস্ত্র মানুষের সামনে খড়কুটোর মতো দাঁড়িয়ে থেকে মরার চাইতে সরে আসা যে বুদ্ধিমানের কাজ সেটা কি কাউকে বলে বোঝাতে হয় ? নিজের উপর পড়লে তখন তারা বুঝত। আগুনের সামনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে ঝলসে যাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ ? নাকি সেখান থেকে সরে আসা ? যেখানে উপায় আছে সেখানে এই সরে আসাকে কোনওভাবেই ‘পালিয়ে আসা’ বলে না। বরং বুদ্ধিমানের কাজই বলা চলে। সে অর্থে আমাদের শরীরে পলায়নবাদীর জিন নয়, আছে বুদ্ধিমত্তা আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জিন। আমরা গর্বিত আমাদের পূর্বজদের নিয়ে। আজ যখন সে উপায় নেই তখন সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরতে হবে। এর বাইরে গত্যন্তর নেই।
ভাষার
আফিমে মানুষকে বুঁদ করে রেখে ধর্মকে, বলা ভালো এই ঈশানের হিন্দু বাঙালিদের দ্বারা
ধর্মকে অস্বীকার করার অঙ্গীকার করাতে কুবুদ্ধিজীবিরা সদাই কাজ করে যাচ্ছে। অথচ এই
হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার সূত্রেই পূর্বপুরুষরা নিজেদের দেশ, বাড়িঘর, ভিটেমাটি
ছেড়ে এদেশে শরণার্থী হয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এমনকি অনেক এইসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদেরও। ওরা সেটা উল্লেখ করে না এমনই অকৃতজ্ঞ।
সেই দুঃখগাথা আজ অনেকেই ভুলে গেছেন কিংবা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হন। প্রতিটি ধর্মকে
যথাযথ সম্মান দিয়ে নিজ ধর্মে অচঞ্চল হয়ে থাকতে বাধা কোথায় ? কাজী নজরুল লিখেছিলেন
- হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন ? বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
এটা মানা হচ্ছে না ওদেশে। মানা হচ্ছে এদেশে। সম অধিকার নিয়ে, যাবতীয় সরকারি সুযোগ
সুবিধা নিয়ে মুসলিম সমাজ এদেশে বসবাস করে আসছে। অথচ ওদেশে ? কিছু ব্যতিক্রমের
বাইরে এদেশে
ওদেশে সর্বত্র বুদ্ধিজীবীদের একই চিত্র। এতসব দেখে শুনেও একই
মিথ্যাচার ক্রমান্বয়ে চালিয়ে যাচ্ছে এই বুদ্ধিজীবীরা। এর থেকে সাবধান হওয়ার আশু
প্রয়োজন আজ। দেশকে অস্থির করে, অশান্ত করে পট পরিবর্তনের ছক যেন কোনভাবেই ফলপ্রসূ
করতে না পারে এরা সেই বিষয়ে সতর্ক থাকারও প্রয়োজন রয়েছে। ভোটের দিন গরম, বৃষ্টির
ছুতোয় আরাম আয়েসের ছলে ঘরের বাইরে না বেরনোর প্রথাকে ভুলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে মিথ্যাচারী
আর আফিমের কারবারিদের। নিবন্ধের ইতি টানব একটি অমনোনীত, অপ্রকাশিত কবিতার মাধ্যমে
-
একটি
নদীর একটি ছিল ওপার
কতটা সুখের ছিল সেই পার, যাঁরা জানতেন
তাঁদের
কেউ আর বেঁচে নেই আজ।
আমাদের এপারেই সৃষ্টি, স্থিতি, লয়
ওপারের
বৃত্তান্ত -
সে আমাদের কথা নয়।
আমাদের এপারের বৃত্তান্তে বৃত্ত আছে বহু
অন্ত নেইকো আপাতত।
আদি আছে এক বিচিত্র, আর আছে
বৃত্তে
বৃত্তে ছায়াবৃত্তে অফুরান কথাবৃত্ত।
বৃষ্টিভেজা শৈশবের প্রথম কদম ফুল থেকে
পায়ে পায়ে চলে আসা ইমারত জীবনগাথা
সেও এক দুঃখসুখের পারাপার কথামালা।
এ আমার স্বদেশ, আমার আপন যাপন ভূমি
এ
ভূমি বাংলার মাটি নয়, ভারত আমার দেশ
যে
দেশে রোজ সকালে সূর্য ওঠে ঈশান কোণে
আমরা সেই ঈশানের পুত্র
ভেঙেছি আমরা কালির আঁচড়, যত ভুয়ো মানচিত্র
এপার ওপার মিথ্যা
বিবাদ, ভুল ভূগোলের সূত্র।
ঈশান বাংলার অধিবাসী হওয়ার সূত্রে ১৯৭১ এর মুক্তি সংগ্রাম ও তৎকালীন পরিস্থিতির কথা আমরা আমাদের পূর্বজদের মুখ থেকে শুনেছি। কীভাবে একটি দেশের স্বাধীনতা আনতে মুজিবের অবদানকে আজ অস্বীকার করা হচ্ছে সে কারোও বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। যেমন বোধগম্য নয় ভারত-বিরোধিতা। অকৃতজ্ঞতারও একটা সীমা থাকা উচিৎ। পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রাসন, রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার চক্রান্ত, সেনা লেলিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার মতো পাশবিক কার্যকলাপের কথা বেমালুম ভুলে গেল ওদেশের ছাত্র-রাজনীতির ধ্বজাধারীরা ? সে কীসের ভিত্তিতে ?
সে যাই হোক, এ বিষয়টি এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য নয়। কথা হচ্ছে এইসব রাজনৈতিক কার্যকলাপের অন্তর্গত কিছু অন্তর্নিহিত অবলোকন। আমরা দেখলাম সাম্প্রতিক এই আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশ জুড়ে চলল সংখ্যালঘু - বিশেষ করে হিন্দুদের উপর যথাপূর্বক অত্যাচার। অত্যাচার শুধুই শারীরিক হয় না। মানসিকও হয়। ও বাড়ির মেয়েটিকে জবরদস্তি তুলে নিয়ে গেলে এ বাড়ির লোক আর কোন ছাই শান্তিতে থাকতে পারেন ? ধর্মীয় স্থান ভেঙে দিলে থাকা যায় শান্তিতে ? এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে।
(১) বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতা
এই সম্পূর্ণ পট পরিবর্তনের আবহে কিছু পারিপার্শ্বিক চিত্র আজকের দিনে বড়ই প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিয়েছে। এদেশের বুদ্ধিজীবিরা, যারা মূলত হিন্দুবিরোধী - তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। এত বড় একটি ঘটনা ঘটে গেল পাশের বাড়িতে অথচ এরা বাধ্য হয়ে গেছে মুখে কুলুপ এঁটে রাখতে। প্রাথমিক পর্ব অবশ্য এরকম ছিল না। ছাত্র আন্দোলন, যা ছিল মূলত কোটা বা সংরক্ষণবিরোধী আন্দোলন তার সমর্থনে এবং সে দেশের সরকারের অনমনীয় মনোভাবের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেছিল এরা বেশ আটঘাট বেঁধেই। অথচ নিজেদের দেশে এরা সংরক্ষণের সমর্থক। এমন দ্বিচারিতাই এদের বিশেষত্ব। এরপর যখন সেই আন্দোলন হাইজ্যাক হয়ে গেল রাজনৈতিকভাবে তখনই শুরু হল সরকার পতন এবং দেশ ছাড়লেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। এই অরাজক অবস্থায় দেশ জুড়ে শুরু হল অত্যাচার, উৎপীড়ন, খুন, ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা। নির্বাচিত সরকারের সমর্থক আওয়ামী লিগের সদস্যদের পাশাপাশি হত্যা করা হলো হাজারেরও বেশি পুলিশ কর্মীকে। জ্বালিয়ে দেওয়া হল থানা এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের যাবতীয় দলিলপত্র। এবং ফি-বছরের প্রাক-পূজা বার্ষিক আনন্দোৎসবের মতোই শুরু হল হিন্দুদের উপর অত্যাচার। এবার বেকায়দায় পড়ে গেলেন এই কুবুদ্ধিজীবীরা। লুকিয়ে পড়লেন গর্তে। কারণ এর প্রতিবাদ করার মতো জিন এদের শরীরে নেই। হিন্দু শব্দটিতেই তাদের অ্যালার্জি। এই শব্দটি ওরা লিখতেও পারে না, উচ্চারণও করতে পারে না। এর উল্টোটা হলে দাপিয়ে বেড়ায় এই প্রজাতির লোকেরা।
সামাজিক মাধ্যমে এরা চুপটি মেরে সুযোগের অপেক্ষায় রইল। কেউ কেউ এর মধ্যেও নির্লজ্জ ভাবে উলটো কথা ছড়ানোর চেষ্টা করেছে সামাজিক মাধ্যমে। তবে এসব ধোপে টেকেনি। সামাজিক মাধ্যমে আসতে থাকল একের পর এক নির্লজ্জপনার ছবি, ভিডিও। তার মধ্যেই একটি ভিডিও এল, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের একটি ছবির নীচে কিছু ক্যাপশন লেখা ছিল যা আপাতদৃষ্টিতে ফেক অর্থাৎ ভুয়ো বলেই মনে হচ্ছিল এবং সেদেশের অনেকেই এটিকে অসত্য বলে মন্তব্য করছিলেন। ইতিমধ্যেই এটি বহুলভাবে শেয়ার হয়ে গেছে। এবার এই ছুতোয় সেই দুর্বুদ্ধিজীবীরা আবার আসতে চাইলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। অভিযোগ - সবাই নাকি না জেনেবুঝেই যা তা ছড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। কী তাদের অসহিষ্ণুতা ! এরা এদেশে সুখের ঘরে থেকে গ্রাউন্ড রিয়্যালিটি থেকে শত যোজন দূরে। এতদিন ধরে যারা চুপ করেছিলেন বা দুমুখো মন্তব্যের মাধ্যমে অস্তিত্বের লড়াইতে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন তারা সরব হতে চাইলেন। কিন্তু এই একটি ভিডিওর সূত্র ধরে এসব বিরোধিতার কি কোনও মূল্য থাকতে পারে ? অপরাপর অপরাধের ভিডিও তো একশোভাগ খাঁটি। সেসব নিয়ে তারা চুপ কেন ? বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার কি নতুন ? এ তো প্রতি বছরেই হয়ে থাকে। সেসব কি মিথ্যা ? আসলে সেসবে তাদের তো কিছু যায় আসে না। তাদের এই নির্লজ্জ কাণ্ডকারখানা সভ্যতার পরিপন্থী।
এই কুবুদ্ধিজীবীরা বড়ই অদ্ভুত। এরা ভগবান মানে না কিন্তু অধিকাংশ বাড়িতে লুকিয়ে পুজোআচ্চা করে। কেউ কেউ আবার প্রকাশ্যেও করেন। পুজো শেষ হলেই বলেন এটা হচ্ছে আচার, আমরা ধর্ম মানি না, পুজো মানি না। কিম্ভূতকিমাকার অবস্থা। এরা মারা গেলে হিন্দু ধর্মানুযায়ী দাহকার্য হয় এবং শ্রাদ্ধও হয়। তবু এরা সমাজে বিশেষ হয়ে থাকার অভিলাষে জীবন্তে এই মিথ্যাচারে মত্ত থাকে। এদের স্বভাবই হচ্ছে হচ্ছে উলটো সুরে কথা বলা। তাই এরা নিয়তই জনসাধারণের মতের বিরুদ্ধবাদী। অপরিণত বয়সেই এরা মগজধোলাইয়ের শিকার। সেই মগজ আর সারা জীবনেও শুদ্ধ, পরিশিলীত হয় না। সুসংঘবদ্ধ সমাজটাকে এরা বিষিয়ে তোলে পরিকল্পিতভাবে। সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎটাকে যুগ যুগ ধরে করে রেখেছে কুক্ষিগত। অযোগ্যকে খ্যাতনামা করেছে, যোগ্যকে করেছে বঞ্চিত। দেশভাগ নিয়ে কান্নাকাটি করলেই সাহিত্য হয় না। দেশভাগ নিয়ে তাদের কোনও প্রতিবাদ নেই। মতের অমিল হলেই এই মিথ্যাচার আজও চলছে অবিরত।
ভারতে সরকার পরিবর্তন হওয়ার ফলে এদের অসহিষ্ণুতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এরা গণতন্ত্রের পক্ষে চিরদিনই বিপদজনক। গণতান্ত্রিকভাবে যেখানে এদের শাসনে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই তখন এরা অন্য দলের লেজুড়বৃত্তি করে উপরে উঠতে চাইছে। শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান দেখে এরা আজ উল্লসিত। এ দেশেও এভাবেই অবৈধ উপায়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার স্বপ্নে এরা মশগুল। দক্ষিণপন্থী এক বিরোধী দলের এক নেতা তো দিনকয়েক আগে অতি উৎসাহে সেরকম ইঙ্গিত দিয়েই ফেললেন সামাজিক মাধ্যমে। অসহিষ্ণুতার চরম নিদর্শন। এই ঈশানের অধিবাসী এক বামাচারী বাংলাদেশ কাণ্ডের প্রথম দিনেই উল্লসিত হয়ে একটি পোস্ট দিলেন ফেসবুকে। সম্ভবত কিছু বিরূপ মন্তব্যের কারণে পরদিন এই পোস্ট মুছে দিয়ে মন্তব্য করলেন - আমি এখন বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলব না কারণ সবটা আমি এখনও পুরোপুরি জানি না। এর পরদিনই আবার তিনি পোস্ট না দিয়ে থাকতে পারলেন না। অসহিষ্ণুতার কী নির্লজ্জ নিদর্শন।
(২)
বছরে বেশ কয়েকবার এদেশ থেকে একদল কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক জগতের ব্যক্তিরা ওদেশে যান ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়’ গড়ে তোলার অছিলায়। এত বছরে কতটুকু সমন্বয় হয়েছে সে তো দেখাই যাচ্ছে। এসব শুধু ফুর্তি, বিদেশ ভ্রমণ, নাম কামানো আর আর্থিক লাভালাভের উদ্দেশ্যে। এর বাইরে কিছুই নয়। এদের মধ্যে কেউ আজ অবধি ওদেশে গিয়ে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু বলেছেন কি ? অসম্ভব। তাহলে কীসের সমন্বয় ? গেলেন, ফুর্তি করলেন আর সামাজিক মাধ্যমে রসিয়ে লিখলেন - ...ভাই, ...ভাইয়ের আমন্ত্রণে সফরে গিয়ে ...ভাইয়ের ঘরে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে তাদের আন্তরিকতা, আপ্যায়নে আমরা মুগ্ধ। যেন দেশোদ্ধার করে ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙার বেলায় তারা চুপ। কোথায় রইল সাংস্কৃতিক সমন্বয় ?
আসলে এসবই হচ্ছে যুগ পুরোনো মগজ ধোলাইয়ের খেলা। যে খেলায় অপাপবিদ্ধ কিছু মানুষ নিজেরই অজান্তে ডুবে যাচ্ছে মিথ্যা স্বপ্নের মায়াজালে। মিথ্যা ইতিহাস, মিথ্যা প্রচারের জেরে এরা ইতিমধ্যেই দেশটার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। এদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের বিরুদ্ধে প্রতিটি ঘটনায় এরা অবাধে সংখ্যালঘুর পক্ষে মাঠে নেমেছে। সংখ্যালঘুদের কুকীর্তির বেলায় এরা নিশ্চুপ থাকে বরাবর। এই ঈশানে, এই রাজ্যে যত চুরি, ডাকাতি, পকেটমারি, খুন ধর্ষণ, রাহাজানি, ড্রাগসের অবৈধ কারবার সবকিছুতেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু। কিন্তু এসব নিয়ে এই বিশেষপন্থীরা মুখে চিরদিনই তালা আটকে রাখে। আসলে ছোট থাকতেই তাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে দেওয়া হয়।
(৩)
একটি অভাবিত বিষয়ের অবতারণায় প্রথমেই বলে রাখা ভালো - ধর্মকে আফিম বলেছিলেন এক সম্প্রদায়ের গুরুদেব কার্ল মার্ক্স। সে অনেক আগের কথা। এতদিনে আজকের বিরুদ্ধবাদীরা এদেশে ধার্মিক সচেতনতা এবং বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের বিশাল সম্ভার থেকে সবার দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে এক নতুন আফিমের আবিষ্কার করে ফেলেছেন। সেও বড় কম দিন হল না। সে আফিম হল ভাষা, মাতৃভাষা। তারা এমনভাবে ভাষার আফিম খাইয়েছেন যে জনগণ ধর্মের কথা ভুলে যেতে বসেছেন। এটাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। অথচ একটি ব্যক্তির মুখের ভাষা যতটা প্রয়োজন ততটাই প্রয়োজন নিজস্ব পরিচিতি, সামাজিক ও পরম্পরাগত অবস্থিতি যা ধর্মাচরণেই প্রকৃষ্টভাবে ফুটে ওঠে। শেখানো হচ্ছে - ধর্ম হচ্ছে অদরকারী, আমরা সর্বধর্মে বিশ্বাসী কিংবা ধর্মহীনতায় বিশ্বাসী। সেক্যুলার শব্দটিই এই দেশের কাছে এক প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধভাবে তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সংবিধানে। কী বিরাট পরিকল্পনা তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। কেন, নিজ নিজ ধর্ম অনুসরণ করে সবাই একত্রে বসবাস করতে পারে না ? পারছেই তো এদেশে। কিন্তু ওদেশে তা হবার নয়। হয়নি। সংখ্যালঘু হিন্দুরা দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই নিপীড়িত। কিন্তু কেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কি হিন্দুদের অবদান নেই ? সবাই একত্র হয়ে যখন ভাষার প্রশ্নে দেশকে স্বাধীন করল ঠিক তখনই ফোকাস কী করে ঘুরে গেল ভাষা থেকে ধর্মের দিকে ? মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে গেল পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া অন্যতম বর্বর ধর্মভিত্তিক হিংসাত্মক ঘটনা। যার ফল আজকের এই টানাপোড়েন। তবু আমরা আজও ভাষা ভাষা করে বিগলিত। ভৌগোলিক ভাবে বাংলা দুটিই - পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা এ কথা জেনেও। মনে রাখতে হবে আমরা কিন্তু কোনো বাংলার অধিবাসী নই। এ রাজ্য আমাদের পূর্বপুরুষদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলা আমরা বলছি, বলবও। ভাষার উপর আঁচ এলে তা প্রতিহতও করবই। তা বলে ভাষাভিত্তিক বৈরীতা কোনওভাবেই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। অথচ উলটোপন্থীরা আমাদের ভাষার আফিমে মজ্জিত রেখে ধর্ম ভুলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। ওরা বোঝাতে চেষ্টা করে ওদেশের মানুষও বাঙালি, আমরাও বাঙালি। সুতরাং ভাই ভাই। নিপীড়ন তাহলে কীসের ভিত্তিতে সে নিয়ে চুপ। ওরা ওদেশে গিয়ে কান্নাটান্না করে কিন্তু প্রতিবাদ করে না। অথচ ওরা বলে প্রতিবাদই ওদের হাতিয়ার। আসলে ওরা সরল খেটে খাওয়া মানুষ আর কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মগজে পরিকল্পিতভাবে ঢুকিয়ে দেয় মিথ্যাচার আর ভুল বার্তা। ধর্ম পরিবর্তিত হলে বা ধর্মচ্যূত হলে পৃথিবীর কোন জিনিসটা অপরিবর্তিত থাকবে ? আলো, হাওয়া, জল কি একই থাকবে ? প্রত্যেকেরই নিজের ধর্ম আছে। এটা বোঝা উচিৎ। বিশেষ করে আজকের দিনে যখন আমরা অন্য দেশে লাঞ্ছিত আর এদেশে মিথ্যাচারের ফাঁদে আক্রান্ত। আমাদের দিকে আঙুল তোলে আরোও অনেকেই যারা ইতিহাস পড়েনি ভালো করে। বলে আমরা নাকি ওদেশ থেকে পালিয়ে এসেছি। অতি উৎসাহে কেউ আবার তথ্য না জেনে বলেন ‘কাঁটাতারের তলা দিয়ে পালিয়ে আসা’ বাঙালির বংশধর আমরা। অথচ সীমান্তে কাঁটাতার লেগেছে এই সেদিন। আর যারা সেইসব দিনের বীভৎসতা দেখেননি বা জানেন না, যারা অবাঙালি বা আধা বাঙালি তাদের পক্ষেই ‘পালিয়ে আসা’ শন্দটির প্রয়োগ সম্ভব। পালানো আর সরে আসার মধ্যে ফারাক আছে। পালানো শব্দটি ইচ্ছে করেই প্রয়োগ করা হয় তুচ্ছার্থে। স্বামী বিবেকানন্দ যখন উত্তর ভারতের এক আশ্রমে কিছু ভণ্ড সাধুদের দ্বারা বন্দি হয়েছিলেন তখন একটি বালিকার সাহায্যে তিনি সেখান থেকে সরে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাহলে তো বলতে হয় স্বামী বিবেকানন্দও তাহলে একদিন পালিয়েছিলেন। হাজার হাজার উন্মত্ত সশস্ত্র মানুষের সামনে খড়কুটোর মতো দাঁড়িয়ে থেকে মরার চাইতে সরে আসা যে বুদ্ধিমানের কাজ সেটা কি কাউকে বলে বোঝাতে হয় ? নিজের উপর পড়লে তখন তারা বুঝত। আগুনের সামনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে ঝলসে যাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ ? নাকি সেখান থেকে সরে আসা ? যেখানে উপায় আছে সেখানে এই সরে আসাকে কোনওভাবেই ‘পালিয়ে আসা’ বলে না। বরং বুদ্ধিমানের কাজই বলা চলে। সে অর্থে আমাদের শরীরে পলায়নবাদীর জিন নয়, আছে বুদ্ধিমত্তা আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জিন। আমরা গর্বিত আমাদের পূর্বজদের নিয়ে। আজ যখন সে উপায় নেই তখন সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরতে হবে। এর বাইরে গত্যন্তর নেই।
কতটা সুখের ছিল সেই পার, যাঁরা জানতেন
আমাদের এপারেই সৃষ্টি, স্থিতি, লয়
আমাদের এপারের বৃত্তান্তে বৃত্ত আছে বহু
অন্ত নেইকো আপাতত।
আদি আছে এক বিচিত্র, আর আছে
বৃষ্টিভেজা শৈশবের প্রথম কদম ফুল থেকে
পায়ে পায়ে চলে আসা ইমারত জীবনগাথা
সেও এক দুঃখসুখের পারাপার কথামালা।
এ আমার স্বদেশ, আমার আপন যাপন ভূমি
আমরা সেই ঈশানের পুত্র
ভেঙেছি আমরা কালির আঁচড়, যত ভুয়ো মানচিত্র
বিদ্যুৎ
চক্রবর্তী
দারুন
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete