Skip to main content

সমকালিক সাহিত্যে স্বাতন্ত্র্যে ভাস্বর কবি, গল্পকার অমিতাভ সেনগুপ্ত


কবিই তো ঈশ্বর, ইশ্বর কবি
আঁধারিতে ইন্দু, দিবসে রবি
শাস্ত্রে আছে ঈশ্বর নিজে নাকি একজন কবি আবার প্রত্যেক কবিই নাকি এক একজন ঈশ্বর কবির সংজ্ঞা নিরূপণ যার তার কাজ নয় যাঁরা বলেন সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি - তাঁরাও হয়তো প্রকৃত কবির সংজ্ঞা নিরূপণে অপারগ কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কবিতা লিখতে পারা মানুষের সংখ্যা এতটাই সীমিত যে তাঁদের সবাইকেই কবি হিসেবে ধরে নিলেও মহাভারতখানা একেবারেই যে অশুদ্ধ হয়ে পড়বে তেমন আশঙ্কা করার কিছু নেই প্রতিষ্ঠিত কবিদের অবশ্য এতে আপত্তি থাকারই কথা তবে বাকি জনসংখ্যার কাছে এটা এমন কোনও দোষণীয় ব্যাপার নয়
কবি অমিতাভ সেনগুপ্ত সেই অর্থে ঈশ্বরই বটে তাঁর কবিতায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ঈশ্বরের প্রতি দায়বদ্ধতা, সমর্পণ, অভিযোগ ইত্যাদি প্রতিটি আঙ্গিকের উপস্থিতি অনুভব করা যায়। ঈশ্বরকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে যাঁরা উপস্থাপন করেন, বলা ভালো বিনির্মাণ করেন তাঁদের কৃতকর্মকেও খুঁজে পাওয়া যায় অমিতাভের কবিতায়। কবি হিসেবে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত অমিতাভ ? কেনই বা তাঁকে নিয়ে কলম ধরা ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই অবধারিত ভাবে এসে পড়ে আনুষঙ্গিক বেশ কিছু প্রশ্ন। এর বিচার করবে কে ? একজন কবিকে প্রতিষ্ঠিত করে কে ? পাঠক, নাকি অন্য কোনও তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত কবি ? এমন যিনি এই কাজটি করবেন তাঁর প্রতিষ্ঠা লাভের পিছনে কারকগুলো কী ছিল ? তাঁর কবিতার মান, নাকি তাঁকে প্রতিষ্ঠার, উপরে ওঠার সিঁড়িটি ধরে রাখা বিশেষ কিছু লোকজন, বিশেষ কোনও গোষ্ঠী ? কথাটি এজন্যই বলা হল কারণ এমন ভূরিভূরি উদাহরণ রয়েছে এই পৃথিবীতে। একজন কবির প্রতিষ্ঠা লাভের মানদণ্ড কী ? প্রকাশিত কবিতা কিংবা গ্রন্থের সংখ্যা ? দ্বিতীয়োক্ত কারণটি হতে পারে না। দেখা গেছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠিত কবি আছেন যাঁদের গ্রন্থের সংখ্যা নিতান্তই কম। আসলে এসব প্রশ্নের উত্তর মেলা বড়ই দুরূহ। যেমন দুরূহ একজন কবির কবিতার মান নির্ধারণ। সেক্ষেত্রে পাঠকের দ্বারস্থ হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আপামর পাঠক - বোদ্ধা থেকে সাধারণ। আর এখানেই বাজিমাত করতে পারেন কবি অমিতাভ সেনগুপ্ত।
কবিদের কোনও ভুবন নেই এমন কথা শোনা যায় সততই। ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না কবি-সাহিত্যিকদের। সত্য হলেও এর ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে এক গভীর প্রহসন যা উপলব্ধি করা যায় প্রতিক্ষণে। এপার-ওপার, এখানকার কবি - ওখানকার কবি ইত্যাদি ভুবনায়নের সুর প্রতিনিয়ত শোনা যায় কান পাতলেই। সেসব আলোচনায় না গিয়ে সরাসরি আমরা প্রবেশ করব অমিতাভ সেনগুপ্তের কবিতাবিশ্বে।
‘দক্ষিণ আসামের এক প্রান্তিক রেলশহর বদরপুর অমিতাভ সেনগুপ্তের জন্মশহর। ওখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা। পড়াশোনার সাথে সাথে সাহিত্যচর্চারও শুরু একই জায়গা থেকে। স্থানীয় সাহিত্য পত্রিকায় কবিতা দিয়েই অমিতাভের ভীরু আত্মপ্রকাশ। মিতবাক অমিতাভ কোন লেখক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত না হয়েই বদরপুরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘অন্বেষক’-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এই সংস্থার মুখপত্র ‘ঈশান’-এর পাতায় পাতায় তাঁর উজ্জ্বল কবিতাসমূহ একে একে প্রকাশিত হতে থাকে। ক্রমে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, ত্রিপুরা এবং কলকাতার ছোট পত্রিকায় তাঁর রচিত কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। কালচক্রের অমোঘ নিয়মে তিনি ‘ঈশান’ পত্রিকার সুদক্ষ সম্পাদক হয়ে ওঠেন। পত্রিকা সম্পাদনার গুরুদায়িত্বের সাথে সাথে কবিতা রচনাও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে’...... (কবির ‘বীজঘুম’ গ্রন্থের ব্লার্ব থেকে নেওয়া)। কবির জন্ম ১৪ নভেম্বর ১৯৬১ ইংরেজি। বাবা অমৃতলাল সেনগুপ্ত, মা শীলারানী সেনগুপ্তা এর তিন বছর পর থেকেই দিনটি শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এই প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখ করার কারণ হল যে কবি অমিতাভের সঙ্গে যাঁদেরই ব্যক্তিগত পরিচয় আছে তাঁরা সবাই জানেন কবির ভিতরে সততই রয়েছে এক শিশুসুলভ সারল্য ও আন্তরিকতা। সদাহাস্যময় এই কবির ব্যক্তিগত জীবন বহু ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত হলেও তাঁর এই সারল্য, তাঁর বিজয়ীসুলভ আত্মপ্রত্যয় তাঁকে করে তুলেছে সর্বজনপ্রিয়। মাটির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক কবি অমিতাভের। জীবনকে দেখেছেন তিনি অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে। অন্তরে পুষে রেখেছেন গভীর অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভব। তারই আভাস ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায় কবিতায়। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কবিতা গল্প ও অন্যান্য লেখালেখির সঙ্গে তিনি নিরন্তর যুক্ত করে রেখেছেন নিজেকে লিখেছেন বেশ কিছু একাঙ্ক নাটকও এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে তিনটি কবিতার বই। ২০২২ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে। বহু দেরি হয়েছে বই বেরোতে বেরোতে। এর বহু আগে থেকেই এদিকে ওদিকে তাঁর অজস্র কবিতার স্বাদ গ্রহণে ঋদ্ধ হয়েছেন পাঠকমহল। তবু যে বেরিয়েছে বই সেও বা কম কীসে ? স্বভাবে প্রচারবিমুখ অমিতাভের যৌথ সম্পাদনায় আরো দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে বর্তমানে আরো কিছু বই রয়েছে প্রকাশের অপেক্ষায়
কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বীজঘুম’। অত্যন্ত সার্থকনামা এই গ্রন্থে আছে ৪৯টি ভিন্ন স্বাদের কবিতা। প্রতিটি কবিতাই আপন মাহাত্ম্যে ভাস্বর। অসংখ্য কবিতা দাগ রেখে যায় পাঠকের অন্তরে। বোধের উঠোন মাড়িয়ে আসা পঙ্‌ক্তিসমূহ জাত চিনিয়ে দেয় কবির। অমিতাভের বহু কবিতায় আমরা দেখতে পাই পরমপিতার কাছে, তাঁর পরমগুরু বাবাইদার কাছে, তথাগত বুদ্ধের কাছে এক নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। বেদের শ্লোক, ত্রিপিটকের উল্লেখ রয়েছে বহু কবিতায়। তাঁর কবিতায় সবচাইতে বেশি যে বিষয়, যে অনুষঙ্গ ফিরে আসে বেশি করে তা হল জীবনবোধ এবং মৃত্যুচিন্তা। বলা যায় জীবন্মৃত্যুর এক নির্মোহ বিশ্লেষণ। কবি জীবনানন্দ দাশের ছায়া অবিরাম উন্মোচিত হয় তাঁর কবিতায়। বারবার উচ্চারিত হয় নক্ষত্রের অনুষঙ্গ। এমনকি জীবনানন্দীয় ভাষার উল্লেখও অবিকল খুঁজে পাওয়া যায় কবিতায়। কবিতায় এক উদ্‌ভ্রান্ত ‘আমি’কে কবি উন্মোচিত করেছেন অন্তরকে নিংড়ে নিংড়ে। করেছেন বিবির্মাণ‘আমি’কে কবি দেখেছেন অভূতপূর্ব স্বকীয়তায় -
কেন চলে এসেছি এখানে, আমারই কি আসার কথা ?
কোথাও কি ছিল এমন অঙ্গীকার ?
এই অবয়ব কোন জন্মের ধারা বিবরণী শোনায় ?
তার যোগসূত্র খুঁজে খুঁজে দেখি আমি,
খুঁজি বাতাসের প্রবাহ,
খুঁজি আমার এই আমি হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত।
...কী ভয়ানক, কী ভয়ানক সেই যোগসূত্র,
ললাট লিখন।
তবু আমি নির্দিষ্ট হয়ে গেছি এই আমিতে।
সবই আমি, এই প্রশ্নময় আমি
আমি দেখেছি কত দ্বিজজীবন আমার;
কুৎসিত শুঁয়োপোকার গুটি ছেড়ে প্রজাপতি হবার।
আহ্‌ আমি... আমি... আমি...।
আমি এক বিস্ময়,
আমি এক দুর্ঘটনা,
আমি এক বিশাল প্রশ্নচিহ্ন। ......
‘আমি’ শীর্ষক এই কবিতার শেষের দিকে কবি লিখছেন -
আমাকে আর কত পাঠাবে এই তমোগৃহে
আমার এই শিশুশরীরের ত্রিতাপ জ্বালা
সব অষ্টপাশ খুলে আমিই ভাসিয়ে দেবো গঙ্গায়
একবুক মন্ত্রঃপূত জলে, কোনও এক মহালয়ার ভোরে...
দিনের শেষে আমি কি ফিরে যাব না ঘরে ?
এই যে তারামণ্ডল, লক্ষ যোজন ছাপিয়ে
সেখানে তোমার যে বিস্তৃত মাঠ,
সেখানে কোথায় রেখেছ আমার ঘর ?
সারাদিন ঘুরে ঘুরে এত যে ক্লান্তি।
আমি ঘরে ফিরে যাব তারামণ্ডল
আমার ঘর কোথায় বলো ?
আর কোনও বিলাস চাই না
শুধু একটি ঘর চাই আমার
আর একটা টানা ঘুম... আহ্‌
আমাকে আর ডেকো না।
বস্তুত এই ‘আমি’ কবিতাতেই কবি নিজের যাবতীয় স্বাতন্ত্র্যকে ধরে রেখেছেন সযতনে, সজ্ঞানে। অমোঘ পঙ্‌ক্তি জুড়ে নিজেকে করেছেন প্রতিভাত। মায়াবী শব্দের কুহকে শেষের আবহে নিজেকে করে রেখেছেন জাগ্রত -
...এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি
মহাশ্মশানের স্তব্ধতার মাঠে,
শিউলির মতো কিছু সাদা খই
আকাশের নির্দিষ্ট তারাদের ব্যঙ্গ করে
হয়তো একদিন পড়ে থাকবে ধুলায়।
কোথায় বা মেরামত করি, কীইবা
রং তুলিতে আঁকা যায় নতুন করে
বড়ো অগোছালোই কি রয়ে যাবে
এই ক্ষুদ্র জীবন ? ...... (কবিতা - মহাজীবন)।
নির্জনতাকে ভালোবাসেন কবি নিজের মতো করে। কবি লিখেন -
নির্জন আমাকে কত কথা শোনায়...
নির্জন জেগে উঠলে সব কোলাহল ছাপিয়ে ওঠে
আরো মগ্নতার শব্দ...
নির্জন জেগে উঠলে একান্তে
বড়ো প্রগলভ হয়ে উঠি আমি... (কবিতা - নির্জন)।
ঘুমের মতো নির্জনতায় কবি করেন আত্মপক্ষ সমর্পণ -
আমি তো আমি নই শুধু, খুঁজে দেখো এই মুখ
এই মুখে আরো মুখ আরো প্রতিভাস
এই মুখে আরো ক্রম আরো পর্যায়।
আমি জন্ম নিয়েছি আরো বহুজন্ম আগে
বাতাসের স্তরে স্তরে রেণু প্রতিরেণু জুড়ে
কত মর্মকথা লেখা হয়েছিল জানো ?
আরো আরো বীজঘুম জুড়ে আমাকে খোঁজো।
প্রতিটি মৃতদেহই একটি বীজঘুম
কত বীজঘুম সে পেরিয়ে এসেছে জানো। (কবিতা - বীজঘুম)।
 
একজন কবি কখনও একমুখী হতে পারেন না। চিন্তার বৈচিত্র কবিকে করে তোলে বহুমুখী। তাঁর মনোজগতে নিয়ত ফুটে বিচিত্র সব পারিজাত। তাঁর কবিতায়, শব্দে, চরণে লেখা হয় সমকাল - ইহকাল, পরকাল। কবিরও থাকে এক সামজিক জীবনচর্চা। ‘মহাযুদ্ধের ঘোড়া’ গ্রন্থটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে যেন ‘বীজঘুম’-এরই রেশ। মৃত্যু, শ্মশান আর চিতাকাঠের অনবদ্য ভাবনাসঞ্জাত পঙ্‌ক্তি -  
কতবার চিতাকাঠ বদল করেছি আমি
মহাশ্মশানের আগুনে -আমার অদাহ্য
নাভিকুণ্ড মৃত্তিকায় পুঁতে রেখে আমি যাই চলে -
আবার ফিরে আসি মাটির ধূলিকণায় -
পায়ে পায়ে ক্রমাগত পথ গড়ে চলেছি আমি,
পেছন ফিরে তাকাতে নেই - মাটির কলসের ফুটো থেকে
গড়িয়ে নামে বৈতরণীর জল - আগুনকে সাতপাকে বেঁধে -
তাঁর হাত ধরে চলে গেছি আমি। ... (কবিতা - অবশেষে)।
কিংবা -
এতো মৃত্যু ভিতরে নিয়ে,
হে আলোকের বৈভব -
কীভাবে বেঁচে থাকি আমি বলো ?
রোজ চিতাকাঠ জ্বলে আমার ভিতর
এইসব আগুনের হলকা পোড়ায় প্রতিনিয়ত...... (কবিতা - আলোকের বৈভব)।
অথচ দ্বিতীয় পর্বে কবি যেন ভাবনার জগতের বাইরে বেরিয়ে বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন। সরাসরি উচ্চারণ করেছেন তাঁর ভালো লাগা, না লাগা। বিষাদগ্রস্ততা থেকে এক প্রত্যয়ের পথে জাগ্রত হয়েছেন কবি।  
হয়তো মৃত্যু ছুঁয়ে যাবে নতুবা জীবন
কেন পাথর বেঁধেছ ডানায় - শ্বাসের ডগায় ?
এইভাবে কি সহজ আসতে পারে সহজে ?
জীবনকে ছুঁতে গেলে জীবনকে অগ্রাহ্য
করতে হয় - জানো না কি বালক ?
চলে যেতে হলে - চলে যাবে,
এইসব পরোয়ানাকে পরোয়া করো না খুব
সময় আর নিয়তিকে খুঁটে খুঁটে দেখো না এত,
এত অবসাদ নিয়ে স্থবিরের বিষাদ
কেন ডেকে আনো এমন,
সব কিছুই ছেড়ে দিতে হয় - সব নিয়ন্ত্রণ,
তাঁকে দেখো হাত বাড়িয়েই আছেন -
দিয়ে দাও সব অধিকার
আর কত ধরে রাখবে আঁচল। (কবিতা - দাও সব অধিকার)।
একই আবহে জীবনানন্দীয় বিনির্মাণকে উল্লেখে না আনলে এ রচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে -
...আজ এই বোধ কাজ করে - তবুও আঁধারের
বেদনার ভিতর - আহা - আহা আমার মৃত্যুরে
দেখিতেছি আমি - আকাশের জেগে ওঠায় -
দেখি নক্ষত্রেরা উঠিতেছে জেগে - দেখি মৃত্তিকার
মায়াময় চেতনা আরো গভীর চেতনার
ভিতর আমাদের বেঁচে থাকা উঠিতেছে জেগে।
তোমার মুখ উজ্জ্বল হতেছে ক্রমে - তোমাকেই
বিশ্বাস করি জীবনেরও অধিক - মৃত্তিকার
যাবতীয় বিশ্বাস দেখি শুধু তোমারে লয়ে
জেগে থাকে - এক আলোকের বিচ্ছুরণের মতো
ছড়ায়ে পড়িতেছে তাহা আমাদের সব বেঁচে
থাকার ভিতর - সব মুহূর্তের ভিতর -
আমাদের ভালবাসার ভিতর। (কবিতা - তোমাকেই দেখি)।
 
কবির তৃতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘চিরন্তন অক্ষর’। এখানেও এমনকি জীবনানন্দের দুঃসহ মৃত্যুর আবহকেও কবি রেখেছেন ধরে একই ধারায় - সমকালের আঙ্গিকে, বাস্তবতায় -
এখানে কোনো ট্রামগাড়ি নেই -
তবে অনেক চলমান লরি বাস আছে,
জীবনের আনন্দে উদাস হেঁটে গেলে
হয়তো কোনোদিন চলেও যেতে পারি
কোনও এক দুরন্ত ট্রাকের নীচে।
আমার থেঁতলানো হাড়গোড় মাংস মজ্জা
থেকে, হয়তো কয়েকগাছা চুলের মতো -
খুঁজেও পেতে পারো আমার কিছু চূর্ণকবিতা।
আগুন ছুঁড়ে দেবার আগে -
আমার না বলা কবিতাগুলি বাতাসে ভাসিয়ে দিও। (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৪)।
বিশিষ্ট গল্পকার মিথিলেশ ভট্টাচার্য কবির অতি আপন গুরুসম, বন্ধুসম ব্যক্তি। কবির প্রেরণার শক্তি হিসেবে তিনি উদাত্ত চিত্তে স্বীকার করেন এই তথ্য। অমিতাভ তাঁর এই এ যাবৎ প্রকাশিত শেষতম কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন মিথিলেশকে। বেশ কিছু কবিতায় আমরা পাই মিথিলেশের প্রতি কবির দুর্বলতা, সম্মান, অভিযোগ আবদারের আবহ। এই সুযোগে জীবনানন্দেরই উল্লেখ সহ কবি অমিতাভের কবিতা নিয়ে মিথিলেশ ভট্টাচার্যের মূল্যায়ন সব চাইতে বেশি প্রাসঙ্গিক হবে। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের ব্লার্বে আছে মিথিলেশের বয়ান - ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইয়ের ভূমিকায় জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন - কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস - শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়। অমিতাভ সেনগুপ্তের কবিতাগুলো পাঠ করতে বসলে উপরের কথাগুলি মনে পড়ে। কবিতার বহিরঙ্গ রূপের পরিবর্তে অমিতাভ’র সবিশেষ ঝোঁক অন্তরঙ্গ রূপের দিকে। তাঁর রচিত কবিতায় মানব জীবনের অতলান্ত ব্যপ্ততার ছবি ফুটে ওঠে। এক জীবনের পরতে আরও বহু জীবনের সন্ধান তাঁর কবিতাকে সত্যিকার অর্থে করে তোলে রহস্যময়। চেতনার গভীরতম স্তর থেকে উঠে আসে তাঁর জীবন অভিজ্ঞতার উপলব্ধির কথা। আজকের সময়ে অমিতাভ সেনগুপ্ত এক স্বতন্ত্র কবি হিসাবে উপস্থিত হন মনোযোগী পাঠকের কাছে...।’   
কবিতায় কবি অমিতাভ মিথিলেশের প্রতি লিখেন -
বড় কষ্টে বেঁচে আছি মিথিলেশ,
বড় কষ্টে বেঁচে আছি।
ম্লান মুখে শুধুই কি দেখে যাবে,
দেখো জীবন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আমাকে ডাক্তার দেখাবে না ?
কোথায় ডুবে আছো নিজের ভিতর
আর দেখে যাচ্ছো একটা জীবনের পতন -
বিষে বিষে জর্জরিত হয়ে পড়েছি
অথচ নীলকণ্ঠ হবার মারকোচ
আমি শিখিনি, মিথিলেশ...। (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৩২)।
এখানে কবিকে আমরা বাস্তবের গভীর সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। এই কষ্ট, এই অ-সুখ পাঠক হৃদয়ে ঝড় তোলে। এই গ্রন্থের অন্তর্গত কবিতায় স্পষ্ট ধরা দেয় এক পথক্লান্তি। এখানে এসে কবি যেন ঘোর থেকে বেরিয়ে কোনও এক হিসেবনিকেশের কথায় মজেছেন। পাততাড়ি গোটানোর ভঙ্গিমায় জীবনকে যেন কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে চাইছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এক ঘোর সমর্পণে নিজেকে করেছেন নিবেদন -
আমি বাঁচতে পারিনি কোনোদিন তোমাদের মতো
শান্তি নেই, স্বস্তি নেই...
কী এক অসুখের মতো লেগে আছে ঘোর
কবিতার অক্ষরে লিখে রেখেছি তাহা... (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৪৪),
তুমি তো আসবেই জানি,
এই শরীরে রেখেছি তার আয়োজন
পালিয়ে যাবো তোমার হাত ধরে
কোনও এক অজানার দেশে।
তুমি তো আসবেই জানি
শরীরে জাগে অনেক গোপন ইশারা ...। (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৭৩)।
এ কীসের ঈশারা কবিই তা বলতে পারবেন। এই আবহে তাঁর সৃষ্ট কবিতাকে নিয়েও ঝরে পড়ে কবির উদ্‌বেগ - সমর্পণে সমর্পণে -
...তুমি আছো জানি আমারই চারিপাশে
এতো লুকোচুরি খেলো না আমার সাথে
শুনি আমার ভাঙাপথের ধুলায় ধুলায়
চরণধ্বনি তোমার রুনু ঝুনু বেজে যায়।
আমার ব্যর্থ কবিতারা কান পেতে থাকে
শুনি কী এক বিস্তার
উঠোনে প্রাঙ্গণে মাঠে ঘাটে আকাশে
ভেসে যায়, ভিজে যায়,
আমার চিরন্তন অক্ষর। (কবিতা - চিরন্তন অক্ষর - ৬৭)।
যেমন আগেই বলা হয়েছে - একজন কবি কখনও একমুখী হতে পারেন না, আমরা দেখি উপরিউক্ত তিনটি কাব্যগ্রন্থেই বিষয় ও ভাবনাই প্রাধান্য পেয়েছে কবির কবিতায়। ছন্দের পথে হাঁটেননি কবি। কিন্তু এই গ্রন্থসমূহের বাইরেও নানা পত্রপত্রিকায়, বিশেষ করে ‘ঈশান’ পত্রিকায় অমিতাভের অসংখ্য প্রকাশিত কবিতায় আমরা দেখতে পাই বেশ কিছু ছন্দ কবিতাও তাঁর রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ -
এক হাতে উড়ন্ত ঘুড়ি, আকাশ ছুঁয়েছে ছেলেবেলা,
নিরিবিলি ভরদুপুর, উঠোনকোণে আবোলতাবোল,
আকাশ জুড়ে নীল ছেয়েছে, দুচোখ বেয়ে কোপাই নদী
পাহাড় চুড়োয় ছুটে যায় দুই বিনুনি কোন কিশোরী
 
দুই বিনুনি উথলে ফেঁপে, পিঠ ছাপিয়ে মেঘের কালো
চোখের কোণে বিষ জমেছে, মাটির অসুখ, মাটির ভাঁড়ে
স্বর্ণমৃগ নেচে বেড়ায়, জ্বরের ঘোরে রাক্ষুসী তোর বৃন্তদ্বয়
ঈশ্বরদণ্ড নেমে এলে আগুব কুণ্ডে, প্রলাপ নাচে রক্তময়…. (কবিতা - বসবাস, প্রকাশিতঈশানএপ্রিল-মে সংখ্যা ২০২৩)
সম্পূর্ণ ভিন্নতর শৈলীতে রচিত এই কবিতায়ও কিন্তু আমরা আবিষ্কার করতে পারি কবির বহুমুখী প্রতিভা। এভাবেই দীর্ঘকালীন এই নিরন্তর কবিতা-যাত্রায় কবি নিশ্চিতভাবেই এক স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রাখতে পেরেছেন। বহুপঠিত হয়তো এখনও হয়ে ওঠেনি তাঁর কবিতা তবু হলফ করেই বলা যায় ঘোর লাগা বিস্ময়ে পড়ে যেতে হয় তাঁর কবিতা। কবিতায় কী এক মায়াময়তা যেন ছড়িয়ে রেখেছেন তাঁ স্বভাবসিদ্ধ বাচনভঙ্গিরই আদলে। যাঁরাই কবিকে কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁর বিনয়, তাঁর সহজ সরল অন্তরের পরিচয় পেয়ে এক-সাক্ষাতেই হয়ে উঠেছেন তাঁর গুণগ্রাহী। বিদগ্ধ পাঠক, মগ্ন পাঠক নিশ্চিতভাবেই অপেক্ষায় থাকবে তাঁর পরবর্তী কবিতাসমূহের অপেক্ষায়।
 
এক ভিন্নতর পাঠসূত্রে আমরা কবি অমিতাভ সেনগুপ্তকে আশ্চর্যজনকভাবে আবিষ্কার করি তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘নিত্যানন্দের ছাতা’য়। ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা - যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে যায় জীবন জুড়ে, সেসব নিয়েই নির্মোহ কাটাছেঁড়া
গ্রন্থের প্রথম ব্লার্বে এখানেও কলম ধরেছেন স্বনামধন্য গল্পকার মিথিলেশ ভট্টাচার্যলিখছেন - ‘গল্প রচনায় অমিতাভের দক্ষতা এতখানি যে কোনোরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাষার মারপ্যাঁচ বা ভণিতা ও ভঙ্গি-সর্বস্বতা ছাড়াই শুধুমাত্র শক্তিশালী বিষয়কে অবলম্বন করে চমৎকার গল্প লেখা যে সম্ভব তার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত গল্পসমূহে।’
প্রতিটি গল্পেরই লিখনশৈলী সমান ভাবে সাবলীল ও গোছানো। বেশ কিছু গল্পের প্রেক্ষাপটে সাযুজ্য লক্ষ করা যায় যদিও বিষয় বৈচিত্র্যে ভিন্নতর উপস্থাপন প্রতিটি গল্পের বিস্তার যেন এক ঘোরলাগা অনুভব। বয়ান ও বুনোট যেন গল্প পড়ার নেশা চাগিয়ে দেয় পাঠক মনে। ব্লার্বে বর্ণিত বয়ান অনুযায়ী গল্পসমূহের ভিতরে বাহুল্য নেই কোথাও, নেই ভাষা সাহিত্যের কারিকুরিও। তবু গল্প এগোয় আপন বৈশিষ্ট্যে। গভীর জীবনবোধের কথা পরতে পরতে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে এই গ্রন্থের সব ক’টি গল্পে। বয়ানে, বুনোটে, ব্যঞ্জনায়, সংলাপের মুনশিয়ানায় লিপিবদ্ধ হয় দিনবদলের নস্টালজিয়া, বাস্তব প্রেক্ষিতে মূলস্রোত থেকে প্রজন্মের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বেদনা, বিধ্বস্ত মনস্তত্ত্ব, শিশু মনস্তত্ত্ব আদি নানা অনুষঙ্গঅমিতাভের গল্প অস্তিত্বের চলমানতা নিয়ে বলা যায় এক ব্যতিক্রমী চিন্তাচর্চার ফসলএখানেও পরিস্ফুট হয়েছে এক গভীর বেদনা, ঈশ্বরের অস্তিত্বের একদিকে কাটাছেঁড়া, আরেক দিকে নির্মোহ সমর্পণ
এই একমাত্র প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের বাইরেও রয়েছে অমিতাভের বহু গল্প - নানা পত্রপত্রিকায়। সেখানেও আমরা প্রত্যক্ষ করি মিথিলেশের সেই উক্তি - ‘ভাষার মারপ্যাঁচ বা ভণিতা ও ভঙ্গি-সর্বস্বতা ছাড়াই শুধুমাত্র শক্তিশালী বিষয়কে অবলম্বন করে চমৎকার গল্প লেখা যে সম্ভব’ তার যাথার্থ্য। সমকালকে একেবারেই নিজের মতো করে সাজিয়েছেন অমিতাভ তাঁর গল্পে। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যায় ‘ঈশান’ পত্রিকার শারদ ১৪৩০ সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর গল্প - ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ ও সমীরণ সরকার’শিরোনামেই উপর্যুক্ত ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন গল্পকার অমিতাভ। গল্পটি থেকে কিছু সংলাপ-নির্ভর অংশ উদ্ধৃত করার লোভ সামলানো গেল না। বন্ধু অবিনাশকে বলছে গল্পের মুখ্য চরিত্র সমীরণ -
- জানিস, ওদিকে যুদ্ধ লেগে গেছে ?
- কোথায় ?
- কেনো, নিউজ দেখিসনি, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ?
- হায় ভগবান, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ করছে করুক। তোর কী ? তোর মাথা ব্যথার কী হল ? কোথায় রাশিয়া-ইউক্রেন আর কোথায় তুই - এই সুদূর এক কোণে, এক অজ পাড়াগাঁয়ে, শিলচরে। কোথাকার কোন পাতি সমীরণ সরকার...।
- ধুর, তুই কিছু বুঝিস না। আজকাল আর দূর, রিমোট প্লেস বলে কিছু নেই। এখন সব গ্লোবাল, সব হাতের কাছে। পৃথিবীটা খুব ছোট।
- হলেই বা কী ? তোর শালার এখানে মিউনিসিপালের কাচড়ার উপরই কোনও কন্ট্রোল নেই - ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে তুই কী করবি ?
- কিন্তু প্রভাব ? সেটা তো আছে। কাচড়ার দুর্গন্ধটা তো নাকে লাগে, যুদ্ধেরটাও তেমনই লাগে...
- চিন্তা চিতা সমানান্তি... শ্লোক আওড়ায় সুব্রত। - বৎস, ক্ষান্ত হও।
ক্ষান্ত তো হতেই হবে তাকে, সবাইকে। কখন যে ভাবনায় ডুবে যায় সমীরণ, সমীরণ সরকার। ...
সমকাল আর সংলাপ যেন এখানে একাকার হয়ে গেছে। কোনও বাড়তি মেদবিহীন টানটান গদ্য।    
  
এতসব লেখালেখির পরেও এ কথা বলতে দ্বিধা হবার নয় যে কবি, গল্পকার অমিতাভকে নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয়নি আজও এমনকি এই তাঁর নিজস্ব কবিতাবিশ্বে, গল্পবিশ্বে। প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে অধরা এই বহুমুখী প্রতিভা। কিন্তু এই দায়ভার কাঁধে নিয়ে একদিন নিশ্চিত সোচ্চার হবে ভাবীকাল, নিশ্চিত সোচ্চার হবেন কোনও এক বজ্র-কণ্ঠের অধিকারী এ কথা বলা যায় হলফ করে। সুবিচার হবে একদিন কবি, গল্পকার অমিতাভ সেনগুপ্তের দাগ রেখে চলা লেখালেখিরএমন ভরপুর সম্ভার অন্তত পাঠকের সামনে নির্মোহ সাবলীলতায় সাজিয়ে রেখেছেন, রাখছেন কবি, লেখক অমিতাভ সেনগুপ্ত। সৃষ্টিকর্তার কাছে এই সৃষ্টিমগ্ন কবির দীর্ঘায়ুই হোক আজ অগণিত পাঠকের একমাত্র আবেদন।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

  1. আমার কতটুকু কি আছে জানিনা
    কিন্তু আপনার ভালোবাসা যে প্রচুর ! আমাকে আপ্লুত করে!!
    ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করা যায় না
    কিন্তু ভালোবাসার কাছে অনায়াসে নতজানু করে...

    ReplyDelete
  2. আমার কতটুকু কি আছে জানিনা
    কিন্তু আপনার ভালোবাসা যে প্রচুর ! আমাকে আপ্লুত করে!!
    ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করা যায় না
    কিন্তু ভালোবাসার কাছে অনায়াসে নতজানু করে...

    অমিতাভ সেনগুপ্ত

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়

নান্দনিক ও গোছালো আয়োজন দ্বিতীয় সংখ্যা ‘সম্পর্ক’

‘…বলা যায়, একটি বই-ই পারে গোটা বিশ্বের কিছু জীর্ণ প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে। বইয়ের এই অমোঘ শক্তি সর্বজনবিদিত। বেদের ঋষি থেকে শুরু করে সমকালীন সময়ের অনেক লেখক তাঁদের সৃষ্টিসম্ভার দিয়ে কিছু প্রচলিত ধারণাকে সময়ে সময়ে বদলে দিয়ে এক নতুন পথের সন্ধান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বই পড়ার মধ্যে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ। বই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। এই যান্ত্রিকতার যুগে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিচলিত মানুষের বইয়ের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম টান। আজকের সামাজিক মাধ্যমের বাড়বাড়ন্ত অবস্থায় বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলেও, বই প্রকাশের কাজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পাঠকের সংখ্যা বই প্রকাশের তুলনায় তেমন হারে বৃদ্ধি পায়নি। এই পাঠক সংকট বিশ্বব্যাপী…।’ - এমনই কিছু মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহারে এক প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের মধ্য দিয়েই শ্রীগণেশ হল বাংলা সাহিত্য সভা, অসমের লংকা শাখার দ্বিতীয় বার্ষিক মুখপত্র, বিশ্ব বই দিবস সংখ্যা ‘সম্পর্ক’ -এর । সৌরভ চৌধুরীর নান্দনিক প্রচ্ছদটি প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঠকের। এবং এই নান্দনিকতা ছড়িয়ে আছে শেষ পৃষ্ঠা অবধি