Skip to main content

উৎকর্ষে, বৈচিত্রে সমৃদ্ধ বর্ষা সংখ্যা ‘মজলিশ সংলাপ’


কবি সাহিত্যিকদের কাছে সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি আরেকটি ব্যাপার রয়েছে যা খুবই তৃপ্তিদায়ক তা হলো সাহিত্য আড্ডা এমন অনাবিল কালযাপন কবি লেখকদের কাছে যেমন প্রাণপ্রিয় তেমনি পাঠকদের জন্য ফলপ্রসূও বটে কারণ এসব মজলিশ থেকে বিচ্ছুরিত নির্যাস আখেরে পাঠকদেরই মননে এসে জায়গা করে নেয় পঠনসুখের আবেশে। এমনমজলিশ’-এ বসেসংলাপআওড়ানোর মতো সুখ লিখিয়েদের কাছে চিরকাঙ্ক্ষিত সেই সুখযাপনকে স্মৃতিতে ধরে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে প্রকাশিত হয়েই যাচ্ছে সাহিত্য পত্রিকামজলিশ সংলাপ বিংশতিতম বর্ষে পদার্পণ করে সম্প্রতি গুয়াহাটি থেকে প্রকাশিত হয়েছে এই পত্রিকার ১৫৬তম সংখ্যা
৮০ পৃষ্ঠার এই সংখ্যাটি যথারীতি বৈচিত্রময় হলেও প্রথমেই যে কথাটি বলে নেওয়া যায় তা হলো গদ্য বিভাগে যেসব রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার অধিকাংশই দীর্ঘ রচনা হওয়ার সুবাদে সংখ্যাগত দিকে গদ্যের সংখ্যা কম হয়েছে। যেহেতু বিংশতিবর্ষের প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে জুন সংখ্যা হিসেবে তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই সংখ্যাটি হচ্ছে বর্ষা সংখ্যা। এবং এমনই ভাবধারায় রয়েছে পৃষ্ঠাজোড়া একটি চমৎকার সম্পাদকীয়। বস্তুত একটি পত্রিকার সম্পাদকীয়ই হচ্ছে সংখ্যাটির ভূমিকা সেই অর্থে এমন নান্দনিক সম্পাদকীয় সহজ পথে পাঠকের পঠনস্পৃহা চাগিয়ে দিতে সদাই কার্যকর। এখানে এক দিকে যেমন রয়েছে আমাদের আপন বিশ্বের বর্ষাবেলার অনবদ্য রূপ তেমনি রয়েছে শঙ্কা - পত্রিকা প্রকাশে সহায়তার হাতের অভাব নিয়ে। তবু পোড় খাওয়া সম্পাদক তুষারকান্তি সাহা লিখছেন - ‘...সাহিত্য চর্চা এবং সাহিত্যকে ভালোবেসে প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে যে নিবেদন, যে গরজের প্রয়োজন সেই সম্পদে সম্পন্ন মানুষ আজ কোথায় ? টালমাটাল জলভূমিতে একা হাতে বইঠা নিয়ে কত আর এগোনো যায় ? কত আর বাওয়া যায় বই-তরণী ? তবু আমরা আশাবাদী। একেবারেই ফুরিয়ে যায়নি সব কিছু। লেখক, কবি, পাঠকের তৃপ্তি ভালোবাসায় আজও আমরা সম্পৃক্ত। এই পথ চলার দায় তাই ভবিতব্যেরই হাতে সঁপে দিয়ে কুঁড়ি থেকে কুড়ির এই উত্তরণকে হাতিয়ার করে হোক নাহয় এক সানন্দ বর্ষাযাপন...।’
ভেতরে প্রথম পাতায় রয়েছে একটি গীতি নৃত্যনাট্যের স্ক্রিপ্ট। ১৯ পৃষ্ঠা জোড়া এই গীতিনাট্যের মঞ্চ পরিবেশনপূর্ব ভাষ্যও আছে প্রথমেই। অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের গীতিনাট্য ‘সঙ্গবিহীন চিরন্তন’ বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষে কবিগুরুর রচনার উপর আধারিত একটি সুচয়িত ও সুগ্রন্থিত রচনা যদিও এ কথা অনস্বীকার্য যে এমন রচনার মঞ্চ-পরিবেশনে শ্রোতা দর্শকবৃন্দ উৎকর্ষ গ্রহণে যতটা সক্ষম, যেভাবে আবেগমথিত হন, তার লিখিত সারাৎসার পঠনে সেই আবেগ, সেই সুখের ভাব উদয় হওয়ার সুযোগ কম।
বিমল গঙ্গোপাধ্যায়ের চার পৃষ্ঠার গল্প ‘গন্ধমাতন’। গল্পে পরিবেশিত কাহিনির তেমন চমকপ্রদ কিংবা উৎসুকতাপূর্ণ সমাপ্তি না থাকলেও ভাষাচাতুর্যে উতরে গেছে গল্পে। লেখার মুনশিয়ানা, সুচতুর বাক্যবিন্যাসে বিন্যস্ত একটি সুখপাঠ্য গল্প। ‘প্রাসঙ্গিক আলোচনা’ শিরোনামে বিশিষ্ট লেখক, বাচিক শিল্পী ও ভাষা-উচ্চারণবিদ সুকুমার বাগচি লিখেছেন ১৭ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি দীর্ঘ নিবন্ধ ‘বাংলা উচ্চারণ নিয়ে দু-চার কথা’। উঠতি প্রজন্ম তথা আবৃত্তিকার ও বাচিক শিল্পীদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি নিবন্ধ। বহু তত্ত্ব ও তথ্যের সংমিশ্রণে এক মূল্যবান রচনা নিঃসন্দেহে।
অগতানুগতিক ধারায় সন্নিবিষ্ট হয়েছে একটি নাটক। উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্য বা নাট্যজগতে প্রদ্যোৎ চক্রবর্তীর পর হাল আমলে রণদীপ নন্দীর বাইরে তেমন নাম আর উঠে আসছে না। এই সংখ্যায় রয়েছে রণদীপের নাটক ‘মুখাগ্নি’। ১৭ পৃষ্ঠাব্যাপী বিস্তৃত ৯টি চরিত্রের উপস্থিতিতে এই একাঙ্ক নাটকটিতে উন্মোচিত হয়েছে এক হৃদয়বিদারক সত্য। এখনও আমাদের সমাজে যে প্রকৃতার্থে স্বার্থহীন সংস্কারবোধ গড়ে ওঠেনি তার পরিচয় নাট্যকার তুলে ধরেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। নগ্ন করেছেন দেখনদারির আড়ালে লুকিয়ে থাকা ধ্বস্ত বোধবুদ্ধি।
গদ্য বিভাগে বৈচিত্রের ধারা মেনে এর পরেই রয়েছে একটি অনুবাদ গল্প। আশিক জামানের অসমিয়া গল্প ‘অভিশাপ’-এর ভাষান্তর করেছেন লেখক সঞ্জয় গুপ্ত। সাড়ে আট পৃষ্ঠা জোড়া সমনামের গল্পটি বাস্তবের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিষাদগাথা। পরিজনসমৃদ্ধ হয়েও কেমন একাকী যাপনে বাধ্য আজকের মানুষ তারই এক চমৎকার বুনোটে সমৃদ্ধ এই গল্প। ভাষান্তরের কাজটিও প্রায় একশো শতাংশ মুনশিয়ানায় সমাধা করেছেন অনুবাদক। শেষ দুই পাতায় রয়েছে অণুগল্প লিখেছেন মধুবন চক্রবর্তী প্রথমটি (কাটলেট) যদি অণুগল্প হয় তাহলে দ্বিতীয়টি (ছবি) পরমাণুগল্প - শব্দসংখ্যায় এবং বিস্ফোরণেও
কবিতা বিভাগে কয়েকটি পর্যায়ে যাঁদের এক বা একাধিক কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁরা হলেন - চিরঞ্জীব হালদার (তিনটি কবিতা), বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, সিক্তা বিশ্বাস, বিনিময় দাস ও অজিত দেবনাথ রয়েছে গদাধর সরকারের ছটি ছড়া এবং তপনকুমার দাসের গুচ্ছ কবিতাও মজলিশ সম্পাদক কবিতার মান নিয়ে সদাই সচেতন বলা বাহুল্য এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি
কাগজের মান, ছাপা, শব্দ, বাক্য, পঙ্ক্তি বিন্যাস, অলংকরণ যথাযথ পার্থসারথি দত্ত উত্তরপূর্বের বিশিষ্ট চিত্রকর তাঁর একটি ছবিকে প্রচ্ছদ হিসেবে নেওয়া হয়েছে অর্থপূর্ণ চমৎকার ছবি তবু প্রশ্ন থেকে যায় স্পষ্টতার দিকটি বিবেচনায় রাখলে প্রচ্ছদচিত্র হিসেবে জলরং ছবি কতটা গ্রহণযোগ্য ? এসব প্রশ্নকে পাশে সরিয়ে রেখে বলা যায় ধারাবাহিকতার দায়ে দায়বদ্ধমজলিশ সংলাপগদ্যে পদ্যে বাজিমাত করতে সমর্থ হয়েছে এবারের সংখ্যাটিতেও

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৬৪০৬৬৯৯৪ 

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...