প্রতিশোধ
দীর্ঘ দু’মাসের এক তীব্র ঝড়
ঝঞ্ঝার পর্যায় পেরিয়ে কাল বেশ রাতেই ঘরে ফিরেছে নগেন। পেটের তাগিদে বাবার হাত ধরে কাঠমিস্ত্রির
তকমা জুটিয়েছিল অনেক আগেই। সেই সুবাদে এদিক ওদিক থেকে কাজের বরাত
আসে প্রায়শই। দু’মাস আগে এমনি এক কাজের
সূত্রে আরোও দু’টি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল পার্শ্ববর্তী
রাজ্যে। আর
তার তিন দিনের মাথায়ই লক ডাউনের জেরে আকাশটা ভেঙে পড়েছিল মাথায়। সেই
থেকে ঘরে একা মালতী
- নগেনের নতুন বিয়ে করা বউ আর বৃদ্ধা মা। মাঝে
মাঝে ফোনে বার্তালাপ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না নগেনের। তীব্র দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগকে সঙ্গী
করে কাটিয়েছে এতগুলো দিন। এরপর ফিরে এসে আবার চৌদ্দ দিনের কোয়ারেন্টাইন। সব
মিলিয়ে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হয়ে অবশেষে ঘরে ফিরেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছে কাল।
সকাল তখন প্রায় ন’টা বাজে। কালো
মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ
- ঠিক নগেনের মনের আকাশটারই মতো। ছাতা আর বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে ঘর
থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রাখল সন্তর্পণে। ঘরে প্রায় কিছুই নেই, দীর্ঘ ফর্দ ধরিয়ে
দিয়েছে মালতী। এদিকে পকেট প্রায় খালি। সবকিছু যেন কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা এই
মহামারী। ভেতরে
একরাশ চিন্তা, চোখে মুখে শুধুই হতাশা আর নিরাশা। সাইকেলটাও বিকল হয়ে আছে। পা
দু’টিই
তাই ভরসা। নগেনের
কুটিরের পাশেই বিশাল চারতলার ফ্ল্যাট হয়েছে বছর দু’এক আগে। অনেক লোক এসেছে সেখানে। ওই
ফ্ল্যাটের চারটি ঘরেও কাঠের কাজ করেছে নগেন। বাজারের দিকে পা বাড়াতেই ফ্ল্যাটের
গেট থেকে বেরিয়ে এলেন অবিনাশবাবু। নগেনকে দেখেই একমুখ হাসি ছড়িয়ে জিজ্ঞেস
করেন - কবে এলি, নগেন ?
এ হাসি বড় অসহ্যের মনে হয় নগেনের। অবিনাশবাবুকে
হাড়ে হাড়ে চেনে সে। ভীষণ
রকমের মতলবী আর স্বার্থপর মানুষ। তবুও ভদ্রতার খাতিরে কথা বলতেই হয় - কাল রাতে ফিরেছি
কাকা। ভালো
আছেন ?
পায়ে পা মিলিয়ে এগোতে থাকেন অবিনাশবাবুও। তাঁরও
হাতে বাজারের থলে। নগেন
বুঝে যায় হেঁটে বাজার পৌঁছা অবধি আর নিস্তার নেই তার। কথার ফুলঝুরি শুরু হবে এখনই।
- ভালো আর থাকতে দিচ্ছে
কে বল ? যে দিনকাল পড়েছে। তা, তোকে দেখিনি যে অনেকদিন ? কোথায় ছিলি ? ঘরে সব ঠিকঠাক চলছে তো ? - শুরু হলো বলে।
নিজের দুঃখের কাহিনি সংক্ষেপে শোনায়
নগেন - যদিও জানে এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ থাকবে না অবিনাশবাবুর।
- কথাটা শুনেছিস নগেন
? কত মানুষ না খেয়ে মরছে, আর কাজ না পেয়ে পায়ে
হেঁটে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছে নিজের ঘরে পৌঁছানোর জন্য ? বড় কষ্ট হয় রে।
নগেন ভাবে - এত দরদ, কিন্তু এই যে ঘরের পাশে আছি আমি - কই আমার কথাটা তো একবারও
এল না তোমার মনে। মনে মনে একটা খিস্তি দিতে ইচ্ছে হলেও সামলে নিয়ে বলে - হ্যাঁ কাকা,
শুনেছি। সত্যিই বড় কষ্ট।
- আর শুনেছিস,
কাল দেখলাম টিভিতে - হাসপাতালে, কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থুতু ছিটাচ্ছে ওরা ?
ওরা বলতে কারা সেটা আর বুঝতে বাকি
রইল না নগেনের। মনে
মনে ভাবে - কাকা, এই যে এই মাত্র রাস্তার উপরে এক দলা পানের পিক
ফেললে তুমি সে বেলায় দোষ নেই বুঝি ? মুখে আর বলে না কিছু। মিছিমিছি
বাকবিতণ্ডায় গিয়ে কী লাভ
?
- বুঝলি নগেন,
দেশের মানুষ বড় কষ্টে আছে রে। আমাদের কথাটাই ধর। কতদিন
হয়ে গেল একটু বাইরে ঘুরতে যেতে পারছি না। ভালো মন্দে এক বেলা বাইরে গিয়ে খাওয়া
দাওয়া করব সে গুড়েও বালি। পকেটে টাকা থাকলেও হয় না, বুঝলি ? ভালো
মাছটাও পাচ্ছি না বাজারে। পান ছাড়া আমার একটুকুও চলে না, এদিকে পানের সাপ্লাই
বন্ধ। অনেক
কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু লোকেল পান জোগাড় করতে পেরেছি শেষে। তুই এসেছিস ভালো হয়েছে। তোর
তো অনেক জানাশোনা। দেখিস
তো পারিস কিনা। যত
টাকাই হোক আমি দিয়ে দেব।
নগেন ভেবে উঠতে পারে না কী বলবে। ঘরে
যেখানে দু’বেলা চালের জোগাড়ই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে তখন কারই বা ভালো লাগে এসব আড়ম্বরের
কথা শুনতে ? ঘেন্না ধরে ভেতরে। মনে মনে গালিগালাজ শুরু হয়ে যায় - শালা, মাছ খাবি, পান খাবি, আয়েস করবি। আর
আমি খুঁজব পান ? ভুলেছি নাকি সেই যে একদিন বাজারে গিয়ে টাকা কম পড়ে গেছে বলে আমার কাছ থেকে
একশটা টাকা ধার নিলি বিকেলে দিয়ে দেব বলে - দিয়েছিস ?
তোরা সব হলি রক্তচোষার দল।
পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে দু’জন। নগেন
তাকায় অবিনাশবাবুর দিকে। লোভে, লালসায় আপাদমস্তক টইটম্বুর এক নরপিশাচ বলে মনে হয়। মনে
হয় যেন এক জ্যান্ত ভূত। ছিপছিপে এক গিরগিটি যেন বিচ্ছিরি সব দাঁত বের করে গিলে নিতে
চাইছে পৃথিবীটাকে। লোভী
জিহ্বাটা লকলক করে বেরিয়ে আসছে বাইরে। দু’হাতে চোখদু’টো
মুছে ছোট্ট করে জবাব দেয় নগেন - হুঁ।
নীরব শ্রোতা পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে
থাকেন অবিনাশবাবু - আসলে মানুষই এসবের জন্য দায়ী রে নগেন। মানুষ প্রকৃতিকে বুঝতে শেখেনি বুঝলি ? গাছ-গাছালি কাটছে নিরন্তর, মেরে ফেলছে পশু পাখি। জ্যান্ত
গণ্ডারের শিং নিচ্ছে কেটে
- মায় সেদিন কোথায় যেন একটা হাতীকেও মেরে ফেললো বম মেশানো আনারস খাইয়ে। মন্দিরে
মন্দিরে পশুবলির সে কী ধুম।
শুনে পিত্তি জ্বলে নগেনের। মুখের
উপর বলতে ইচ্ছে করে
- কাকা, রোববার হলেই সারি সারি ঝুলিয়ে রাখা পাঁঠার
মাংসের দোকানে যে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে কচি পাঁঠা খোঁজ তখন কোথায় থাকে তোমার এমন জ্ঞানগম্যির কথা ? গোটা
হাঁস, মুরগি কিনে এনে কতদিন নগেনকেই বলেছেন কেটে দিতে। মুখ
নিশপিশ করে নগেনের কিন্তু সামলে রাখে নিজেকে। কী হবে কথা বাড়িয়ে ? ঘরে যার নূন বাড়ন্ত
তার এসব কথায় কী দরকার ?
এদিকে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের প্রায়
কাছেই পৌঁছে গেছে ওরা। নগেন তাকিয়ে দেখে অবিনাশবাবু বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছেন যেন। তাই
একটু ধীরে হাঁটে এবার নগেন। হেঁটে বাজার সংলগ্ন বিষ্ণু মন্দিরের
সামনে এসে আর পেছন ফিরে দেখতেই পায় না অবিনাশবাবুকে। অবিনাশবাবুর এভাবে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায়
খানিকটা অবাক হলেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন নগেন। মনে মনে ভাবে হয়তো রাস্তার পাশের কোনও
দোকানে গেছেন। নগেনের
মতো ছাপোষা মানুষকে একটু বলে যাওয়ার মতো সৌজন্য দেখানোটা অবিনাশবাবুর মতো স্বার্থপর
মানুষের কাছ থেকে আশাও করা যায় না। বিরক্তিকর পথচলার শেষে এবার কেনাকাটায়
মন দেয় নগেন।
অনেকদিন পর খুলেছে বাজার। জিনিসপত্রের
যাচ্ছেতাই দাম। পকেট
ফাঁকা হতে বেশিক্ষণ লাগেনি নগেনের কিন্তু পরিচিত দোকানদার বন্ধুদের সাথে কথা বলতেই
অনেকটা সময় লেগে যায়। দূর দূর থেকে ওরা আসে এখানে নানারকম পসরা নিয়ে।
এদিকে আকাশটা আরোও কালো করেছে এতক্ষণে। আর
দেরি না করে তাই ব্যাগদু’ট দু’হাতে ঝুলিয়ে ঘরের উদ্দেশে পা বাড়ায় নগেন। দীর্ঘ
পথচলায় এবার একাই চলছে নগেন। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজেছে
অবাঞ্ছিত অবিনাশবাবুকে। কিন্তু আর তাঁর দেখা পায়নি। স্বস্তিই পেয়েছে মনে।
চলতে চলতে আস্তে আস্তে শরীরটা যেন
একটু খারাপ লাগতে শুরু করে নগেনের। এতদিনের দীর্ঘ ধকল বুঝি আর সইতে পারছে
না। একটা
জ্বর জ্বর ভাব অনুভব করে ভেতরে ভেতরে। ঘরের প্রায় কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায়
বন্ধু সুনীল দাঁড়িয়ে আছে গলির মোড়ে। নগেন ভাবে সুনীলকে বলবে ব্যাগদু’ট একটু বয়ে নিয়ে যেতে
ঘর অবধি। কিন্তু
সুনীলকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে। একটা হাই ভেঙে চোখদু’টো মুছে সুনীলই নগেনকে
দেখতে পেয়ে বলে - কবে ফিরলি ?
- কাল রাতে। কেমন
আছিস তোরা ? তোকে দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছিস। এত
দেরি করে উঠলি যে ?
- আর বলিস না। কাল
সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। ওই পাশের ফ্ল্যাটের অবিনাশকাকা কাল রাতে মারা গেলেন তো। তাঁর
সৎকার করে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাতটাই সাবাড়।
পা দু’টো টলছে নগেনের। কোনওক্রমে
বলে - কী ?
বলে যায় সুনীল - রাতের বেলা বড়জোর
আটটা হবে। হাওয়া
খেতে উঠেছিলেন ছাদে। এমন সময় বাজ পড়ে সব শেষ। দেহটা একেবারে ঝলসে গেছে রে। দেখে
একেবারে শিউরে উঠেছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন এক জ্যান্ত ভূত দেখছি। ছিপছিপে এক গিরগিটি যেন বিচ্ছিরি সব
দাঁত বের করে গিলে নিতে চাইছে পৃথিবীটাকে। লোভী জিহ্বাটা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। প্রকৃতির
কী নির্মম প্রতিশোধ
- - - - -
সুনীলের আর কোনও কথাই শুনতে পাচ্ছিল
না নগেন। দেহটা
মনে হচ্ছে যেন অসাড় হয়ে গেছে। অবচেতন মননে ভেসে আসছিল শুধু একটিই
শব্দ - প্রকৃতি, প্রকৃতি - - - - - ।
- - - - - - - - - - - - -
Comments
Post a Comment