Skip to main content

‘মানবী’ - আখর কথায় সময়ের দলিল



সেই আদিকাল থেকেই প্রকৃতি আর নারী চিরসম্পূরক, একাকার। প্রজন্মের সৃষ্টিকথা আবর্তিত হতে থাকে এঁদের নিয়েই। সৃষ্টিকথায় পুরুষের অবদান কতটুকু তা পরিমাপের কোনও উপায় নেই, কিন্তু প্রকৃতিই যে সৃষ্টির ধারক ও বাহক তা এক কথায় অনস্বীকার্যসেই প্রকৃতির অমোঘ টানেই যেন হাতে হাত ধরে, পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলেছেন একঝাঁক মানবী। পায়ের নিচে সবুজ ধরণী আর সামনে অবাধ প্রকৃতি। একে অপরের হাতের বেষ্টনিতে ঝাপসা ছবিতেই ফুটে ওঠে যুথবদ্ধ প্রত্যয়ের এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।

বলছিলাম শিলচর থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ছোট পত্রিকা - ‘মানবীর প্রচ্ছদের কথা। হালে প্রকাশিত হয়েছে এই পত্রিকার পঞ্চদশ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা - জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২১এতগুলো বছর ধরে বরাক উপত্যকা তথা এই ঈশান বাংলার ছোট পত্রিকার পরিমণ্ডলে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে এই ‘মানবী’ পত্রিকা। চারজন কৃতী মানবীর পর্যায়ক্রমে সম্পাদকীয় দপ্তর সামলানোর ব্যাপারটা এক কথায় ব্যতিক্রমী। এবারের সম্পাদক যশস্বী গল্পকার শর্মিলা দত্ত। এর বাইরে সম্পাদকীয় প্যানেলে আছেন কবি চন্দ্রিমা দত্ত, কবি শেলী দাসচৌধুরী এবং কবি - গল্পকার দোলনচাঁপা দাসপাল। প্রচ্ছদচিত্রটি তুলেছেন কবির শহরের আরেক গল্পকার মঞ্জরী রায় এবং প্রচ্ছদ অলঙ্করণ ও অক্ষর বিন্যাসে আছেন মান্না দেব।

কথামুখ শিরোনামে অনবদ্য সম্পাদকীয় বার্তায় সম্পাদক শর্মিলা দত্ত লিখছেন - পঞ্চদশ বর্ষে পা রাখল ‘মানবী’। এ পা রাখার জমি অতিমারী, মানবিক অবক্ষয়, স্বার্থচিন্তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ - সবকিছু নিয়ে টালমাটাল। - - - - নিখিল বিশ্বই তো রোগাক্রান্ত। এ যেন অশীতিপর দ্রোহকাল। - - -  কিছু কিছু মানুষের কলম চলে অনন্ত প্রত্যাশায়, অম্লান ভালোবাসায়। প্রতিবাদেও কলম কঠোর হয়ে ওঠে। প্রতিরোধের পাশেও কলম নিরলস জেগে থাকে। এইসব মুখর কলমকে আমাদের হাজার স্যালুট। 

কিছু বাছাই করা কথা, কবিতা ও বার্তার মাধ্যমে এক সুস্পষ্ট উৎকর্ষতা যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ‘মানবী’র পাতায় পাতায়। যা খুশি, যেমন খুশির স্থান নেই এখানে। সবগুলো লেখা যেন বাছাই করা মণি মাণিক্য। কথা বিভাগে প্রথমেই চন্দ্রিমা দত্তের নিবন্ধ - ৮ই মার্চে যা লিখি। কন্যা থেকে নারী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে মানবীদের কণ্টকময় পথের এক বিষাদময় আখ্যান। আছে উত্তরণেরও হদিশ। আছে আশার কথা, ভরসার সোপান-পথ। নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ বিষয়ক গবেষক অভিজিৎ চৌধুরীর ‘অভিজ্ঞতা’-প্রসূত দীর্ঘ নিবন্ধ - একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে ‘দেশনায়ক’ - পত্রিকার মানদণ্ড নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটাই। ‘অন্য উৎসব কথা’য় অভিমন্যু মাহাতর ‘বাংলা সংস্কৃতিতে ব্রাত্য আদিবাসীদের নববর্ষ’ এবং ‘স্মরণ’-এ ‘ছায়াময় বনস্পতি-মানুষ’ শিরোনামে কবি গৌরাঙ্গ মিত্রকে নিয়ে শর্মিলা দত্তের নিবন্ধও পাঠক মনকে ঋদ্ধ করে অজানাকে জানার মাধ্যমে। ‘অধিকার কথা’য় পুরোহিত-এর কাজে মহিলাদের অংশগ্রহণের যাথার্থ বর্ণনা করেছেন অপরাজিতা ভট্টাচার্য। ‘পাঠ কথা’য় কুমার অজিত দত্তের গল্প সংকলন ‘কিছু বিপন্ন সময়ের গল্প, কথা অথবা রূপকথা এবং অন্যান্য গল্প’-এর আলোচনা করেছেন মঞ্জরী রায়। সমৃদ্ধ কথা বিভাগ এই সংখ্যার এক উৎকৃষ্ট সম্পদ বলা চলে।

গল্প লিখেছেন ইন্দ্রনীল বক্সী, দোলনচাঁপা দাসপাল ও শর্মিলা দত্ত। আলাদা করে বিষয় বস্তুর উল্লেখ না করেও বলা যায় বিষয় বৈচিত্রে এবং গভীরতায় তিনটি গল্পই পাঠকের দরবারে হাজির করে আলাদা রকমের পঠনসুখ।

‘মানবী’র এ সংখ্যায় নিশ্চিতভাবেই বিদগ্ধ পাঠকের মন আলাদা ভাবে আকর্ষণ করবে কবিতা বিভাগ। যাঁরা লিখেছেন - পীযূষ রাউত, শেলী দাস চৌধুরী, রূপরাজ ভট্টাচার্য, চন্দ্রিমা দত্ত, ভাস্করজ্যোতি দাস, দোলনচাঁপা দাসপাল, মধুসূদন দাশ, অম্লান দে। একের পর এক ভীষণ রকমের মন ভালো করা কবিতা। প্রতিষ্ঠিত সব কবিদের এমন সম্ভার সচরাচর কমই দেখা যায় দুই মলাটের মধ্যেকার ছোট পত্রিকায়।

শেষ পাতে পায়েসেরই মতো কবি চন্দ্রিমা দত্তের ‘সম্মেলন কথা’য় ‘অষ্টম লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনের (ত্রিপুরা) আনন্দ কথা’ এক মূল্যবান দলিল হয়ে থাকবে নিশ্চিত।

শুধু কথা কিংবা কবিতায়ই নয়, সার্বিক উপস্থাপনা এবং বৈচিত্রে ‘মানবী’র এই সংখ্যাটি নিশ্চিত ভাবেই এক অনবদ্য পূর্ণাবয়ব সংখ্যা। শুধু কিছু ছাপাখানার ভুল (সূচিপত্রের পৃষ্ঠাসংখ্যা সহ) - এর বাইরে কোথাও অভাব নেই পারিপাট্যের। ছাপাই আরোও একটু গাঢ় হলে পাঠকের পঠন স্বাচ্ছন্দ্য আরোও একটু বেশি হতো।

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এবারও ‘মানবী’ অবধারিত এক ‘আখর কথায় সময়ের দলিল’।

 

‘মানবী’

জানুয়ারি - মার্চ ২০২১

মূল্য - ৫০ টাকা

যোগাযোগ - ৯৪৩৫১৭০৪৪৫

- - - - - - - - - - - - - -

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।


Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...