Skip to main content

গোছালো ছোট পত্রিকা - ‘মানবী, পূজা সংখ্যা’



মানবী পত্রিকা আমাকে যেভাবে ভাবালো .......

বরাক উপত্যকা থেকে যে বাংলা ছোট পত্রিকাগুলো বেরোয় নিয়মিত তার মধ্যে ‘মানবী’ উল্লেখযোগ্য উল্লেখযোগ্য তার বৈচিত্রে, তার সম্পাদনার কারিকুরিতে সাহিত্য পথের নিত্যযাত্রী চারজন সম্পাদকের পালাক্রমে সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘মানবী’। ২০২১ (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর), পঞ্চদশ বর্ষ ২য় ও ৩য় যৌথ সংখ্যাটি প্রকাশিত হলো পূজা সংখ্যা হিসেবে। এবারের সম্পাদক কবি ও গল্পকার দোলনচাঁপা দাসপাল।
কী নেই এ সংখ্যায় ? উত্তর একটাই - সব আছে। আছে ‘উনিশের আলো’তে একটি নিবন্ধ এবং চারটি কবিতা, আছে একটি অণুগল্প, ‘কবিতার ভালোবাসায়’ শিরোনামে আছে দশটি কবিতা। ‘গল্পের বৈঠা হাতে’ শিরোনামে আছে দশটি ছোটগল্প, আছে একটি দীর্ঘ কবিতা। এবং সব শেষে, শেষ পাতে মিষ্টিমুখের মতো আছে ‘অনুভবের আকাশে’ শিরোনামে কিছু বইপত্রের আলোচনাও। সব মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আয়োজন। এবং যে কথাটি না লিখলেই নয় তা হলো এই - সচরাচর বিভিন্ন কারণে যখন বিভিন্ন ছোট পত্রিকায় কিছু লেখার মানের ক্ষেত্রে আপোষ করতে হয়, ‘মানবী’ সেখানে ব্যতিক্রমী। প্রতিটি লেখাই সুচিন্তিত এবং সুচয়িত। গদ্য হোক কিংবা পদ্য - প্রতিটি লেখার গুণগত মান বজায় থেকেছে বরাবরের মতো এই সংখ্যাটিতেও।
শতদল আচার্য স্বল্প পরিসরে বেছে নিয়েছেন একটি বিশাল বিষয়। তাঁর নিবন্ধের নাম ‘উনিশ মে আন্দোলনের বীরাঙ্গনাদের গল্প’। অত্যন্ত কঠিন বিষয় নিঃসন্দেহে। এতগুলো বছরের অন্তরালের পর ইতিহাস ঘেটে তথ্যকে আহরণ করা সহজ কথা নয় - যেখানে এই বিষয়ের উপর বিশেষ কোনও আলোচনা এর আগে প্রকাশ্যে এসেছে বলে জানা নেই। অথচ নিরলস প্রচেষ্টায় তা-ই করে দেখিয়েছেন নিবন্ধকার। তথ্যনির্ভর এই নিবন্ধটি নিশ্চিতভাবেই পরবর্তী রচনাসমূহের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে রইল। পরিসর আরোও একটু বাড়ালে হয়তো নিবন্ধকার এবং পাঠক উভয়েরই তৃপ্তিসুখ বেড়ে উঠতো আরোও খানিক। এবং ভবিষ্যতে সেই আশা করাই যেতে পারে। কবিতায় নিজেদের মতো করে উনিশে মে-কে স্মরণ করেছেন কবি চন্দ্রিমা দত্ত, কুন্তলা দে, অস্তরাগ সুপ্রিয় এবং পর্শীয়া রায়। শহিদ স্মরণে উঠে আসে কিছু অনাবিল উচ্চারণ -
‘স্বীকৃতি আসবে একদিন
আসবে সুদিন
সর্ব অঙ্গে প্রণম্য হবেই
এগারো শহিদের জীবন
অঙ্গার হবে সমূহহিম - - -‘
(কবিতা - কৃষ্ণচূড়া দিনে, চন্দ্রিমা দত্ত)
‘আবারো জোরালো এক উনিশের চেতনার
আওয়াজে কেঁপে উঠুক মসনদ
বাঙালি একই সাথে পা ফেলুক,
বিচারপতির নিদ্রা যাক টুটে - - -‘
(কবিতা - হৃদয়ে উনিশ, কুন্তলা দে)
‘উনিশ সেই মশালের আলো
ভাষা মায়ের তৃপ্তিসুধা।
উনিশ ঘরে বাইরে - জেগে উঠা শ্বাস প্রশ্বাস,
নতি স্বীকার - সরকারী টনক ফেরা।’
(কবিতা - উনিশ আমার উনিশ তোমার, অস্তরাগ সুপ্রিয়)
এক পৃষ্ঠার অণুগল্পে অনাবিল এক ভালোবাসার ছবি এঁকেছেন কবি চন্দ্রিমা দত্ত - তাঁরই স্বভাবজাত মুন্সিয়ানায়। শিরোনাম - ‘একটি নিটোল গল্পের জন্য’। কবিতায় কলম ধরেছেন শ্যামলী কর ভাওয়াল (দু’টি কবিতা), চন্দ্রিমা দত্ত, শেলী দাসচৌধুরী (তিনটি কবিতা), দেবব্রত চৌধুরী, কল্লোল চৌধুরী, ডঃ অলকানন্দা গোস্বামী (দু’টি কবিতা), কুন্তলা দে, সঞ্জিতা দাস (লস্কর), নিরুপম শর্মা চৌধুরী এবং আশিসরঞ্জন নাথ (দু’টি কবিতা)। প্রতিটি কবিতাই এমন একটি মানসম্পন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে যে আলাদা করে কারোও নামোল্লেখ করা সম্ভব নয়। করা উচিতও নয়।  
গল্পে মেতেছেন শ্রীবরুণ, শর্মিলা দত্ত, দোলনচাঁপা দাসপাল (দু’টি গল্প), বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, সুপ্রদীপ দত্তরায়, দীপক সেনগুপ্ত, শৈলেন দাস, শর্মিলী দেবকানুনগো, মিফতা উদ্দিন এবং সুজাতা চৌধুরী। ধারে ও ভারে গল্প বিভাগ যে জমে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। আলাদা করে উল্লেখ না করলেও বলা যায় - গল্পকার শর্মিলা দত্ত এবং মিফতা উদ্দিনের গল্প টানবে পাঠক মন। ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার গল্প শর্মিলী ও শৈলেন-এর। অনাবিল সাহিত্য রসে সম্পৃক্ত দীপক সেনগুপ্তের প্রেমের গল্প ‘অসমাপ্ত চুম্বন’। গল্পকার সুপ্রদীপ যেখানে স্বল্পকথায় এঁকেছেন এক বাস্তব বোধের গল্প সেখানে দোলনচাঁপা এবং বিদ্যুৎ চক্রবর্তী স্মৃতির সরণী বেয়ে সাজিয়েছেন গল্পকথার আসর। কল্পকথায় আবার বাস্তব ও প্রেমের আভাস ফুটিয়েছেন শ্রীবরুণ এবং সুজাতা চৌধুরী তাঁদের গল্পে।
দীর্ঘ কবিতায় ত্রস্তবেলার এই সময়টাকে ধরে রেখেছেন তমাল শেখর দে।
সংখ্যাটির শেষংশে মূল্যবান কয়েকটি আলোচনার সন্নিবেশ ঘটানোর মাধ্যমে পত্রিকাটির মান বেড়ে গেছে অনেকখানিমানবী - কলমের পাশে নিরলস জেগে থাকা ছোটপত্রিকাশিরোনামে  ‘মানবীর বিগত সংখ্যার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন গল্পকার মঞ্জরী হীরামণি রায় ‘সময়ের পরিভাষা’ পত্রিকার দু’টি সংখ্যার গল্প বিভাগ নিয়ে আলোচনা তথা আপন অনুভব লিপিবদ্ধ করেছেন গল্পকার শর্মিলা দত্ত। শর্মিলী দেবকানুনগোর সদ্য প্রকাশিত অণুগল্প সংকলন ‘ঘাসফুল কথা’র বিস্তৃত আলোচনা করেছেন মঞ্জরী হীরামণি রায়।
একটি পত্রিকা প্রকাশের পথে সমূহ বিপত্তি। লেখা আদায় দিয়ে যার শুরু, ছাপাইয়ে তার শেষ। পূজা সংখ্যার ক্ষেত্রে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এই কর্মযজ্ঞকে নিশ্ছিদ্র করে তোলা সহজ কাজ নয়। বিভিন্ন পর্যায়ে সময়ের তাড়নায় কিছু ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ‘মানবী’র প্রকাশের ক্ষেত্রে এই কথাটি একেবারেই প্রযোজ্য নয়। মানসম্পন্ন লেখার চয়ন থেকে শুরু করে পত্রিকা সজ্জা তথা বিন্যাস - নিখুঁত করে সব সামলেছেন সম্পাদকীয় দপ্তর। প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদে শিল্পী সুতপা নন্দী শারদীয় আবহে ধরে রেখেছেন বর্তমানকে। কিছু বানান বেয়াড়ার মতো থেকেই যায় দৃষ্টির অগোচরে। এর বাইরে এ সংখ্যা ‘মানবী’ পাঠকের দরবারে এক সমৃদ্ধ, গোছালো শারদীয় উপহার।
- - - - - - - - -
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
 
মানবী - পূজা সংখ্যা
মূল্য - ৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪০১৩৭৭০৩০

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়