ঋদ্ধ অনুভবের বৈচিত্রময় গল্প সম্ভার - ‘বিকেলের মোহনায়’
ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের কনিষ্ঠতম শাখা যদিও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এর অতুলনীয় সমৃদ্ধি, বৈচিত্র ও প্রসার ঘটেছে। বর্তমান সময়ের প্রায় সব লেখকই বাস্তববাদী ও সমাজ সচেতন। তাঁরা নিত্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গল্প লিখতে আরম্ভ করেছেন এবং এ এক নিরলস প্রচেষ্টা এতে সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে তথা আধুনিকতা থেকে উত্তর আধুনিকতার উত্তরণ পর্বে বাংলা ছোটগল্পের নিরন্তর পরিবর্তন পাঠককে ছোটগল্পের প্রতি আকর্ষিত করছে। গল্পের ভাব, ভাষা ও আঙ্গিকে এই আমূল পরিবর্তনের ধারাটি আজ বিস্ময়করভাবে সফল হয়েছে। পরাবাস্তববাদ, পারিপার্শ্বিক কল্পনাতীত ঘটনারাজি ও তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উঠে আসছে নবীন চিন্তার প্রতিফলন হিসেবে।
সম্প্রতি নতুন বছরের শুরুতেই অসম গ্রন্থমেলা, গুয়াহাটিতে উন্মোচিত হলো কবি, গল্পকার সজল পালের ৩১টি গল্প সম্বলিত গ্রন্থ - ‘বিকেলের মোহনায়’। এটি তাঁর চতুর্থ গল্প সংকলন এবং সার্বিক ভাবে ষষ্ঠ গ্রন্থ। সংকলনটিকে ইচ্ছাকৃতভাবেই ছোটগল্প সংকলন হিসেবে আখ্যায়িত করা যাচ্ছে না কারণ এই সংকলনে সন্নিবিষ্ট করা আছে ‘দুই দুগুণে চার’ শীর্ষক একটি বড় গল্পও। পাকা বোর্ড বাঁধাই-এ ২৪৮ পৃষ্ঠার এই বৃহৎ গল্প সংকলন নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী গ্রন্থ কারণ সচরাচর এ অঞ্চলে এমন বিশাল সংকলন প্রকাশিত হয় না।
গ্রন্থটির নামকরণ নিয়ে কিছু আলোচনার অবকাশ আছে বৈকি। প্রতিটি গল্পের সারবত্তাকে বিশ্লেষণ করলে যে কয়েকটি সাযুজ্য (Common Factor) পরিলক্ষিত হয় সেগুলো হলো - নান্দনিকবোধ, সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও কল্পকদের ধ্যানধারণা - চিন্তাচর্চা, জীবনচর্চা-বৃদ্ধাবস্থা-প্রেম আদি জাগতিক ও অপার্থিব অনুভূতির আধুনিক কনসেপ্টে বিচার বিশ্লেষণ ও সামাজিক মূল্যবোধ। মূলতঃ এই ক’টি বিষয়ের উপরেই অধিকাংশ গল্পগুলি লিখা হয়েছে। কিছু গল্পে এবং অবশ্যই প্রথম গল্প ‘বিকেলের মোহনায়’-এ বৃদ্ধাশ্রমের প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। সেই সূত্রে ‘বিকেলের মোহনায়’ শব্দবন্ধটি একটি সংকলনের শিরোনাম হওয়া খানিক চমক সৃষ্টি করেছে অবশ্যই। সম্ভবতঃ লেখক তাঁর নিজের বয়সের কথা মাথায় রেখেই এমন নামকরণে উদ্যোগী হয়েছেন। অথচ অবসর পরবর্তী জীবনকে মোহনার সঙ্গে তুলনা না করার যে বার্তাটি গল্পগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার বিপরীতেই হয়েছে এই নামকরণ। এমন আরো একাধিক সংকলন লেখকের কলম থেকে যে বেরিয়ে আসবে অদূর ভবিষ্যতে তা আশা করা যায় নিঃসন্দেহে। সুতরাং এমন নামকরণ ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখে আলোচ্য সংকলনের ব্যাপ্তিগত কোনও শিরোনাম হয়তো বেছে নেওয়া যেত অক্লেশে।
প্রায় প্রতিটি গল্পই বিস্তৃত মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জের। আধুনিক যুগে মানবিকতা ও মূল্যবোধের চুলচেরা পোস্টমর্টেম। ভাষাগত উৎকর্ষতা নয় বক্তব্যই এখানে মুখ্য যদিও ভাষা ও শব্দের জাগলারিও গল্পপাঠের এক সুখকর অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে। মানব মনের গভীরে গিয়ে কাঁটাছেঁড়া করেছেন সম্পর্কের, মানবিকতার - আধুনিকতার কনসেপ্টে। স্বল্প পরিসরে প্রতিটি গল্পের আলাদা ব্যাখ্যা সম্ভব নয় যদিও কিছু কিছু গল্পের কথা লিখতেই হয় - গল্পেরই আহ্বানে।
‘খোঁজে আকার খোঁজে অবয়ব’ গল্পে ভাষার নৈপুণ্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য। প্রেম ও বৃদ্ধাশ্রমের ককটেল ভাষা প্রয়োগের চমৎকারিত্বে দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে। ‘অন্তহীন অন্তরালে’ গল্পে লেখকের চিন্তাশক্তির বাহবা দিতে হয়। মন ও শরীরের এক জটিল মনস্তত্ত্বের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই গল্পে। ‘অভাব, অরুচি, অখাদ্য এবং অনশন’ গল্পে শিরোনামেরই মতো এক ব্যতিক্রমী প্লট সাজিয়েছেন গল্পকার। চার ভাগে বিভক্ত গল্পের প্রতিটি ভাগের গল্পের নায়িকাদের নামের বাহাদুরিও অসাধারণ। ‘বজ্রগুণন (২)’ শীর্ষক গল্প দাম্পত্য সম্পর্কের এক অভাবিত, অমীমাংসিত বোধের গল্প। গল্পের শেষ পরিচ্ছেদ থেকে কিছু সম্পাদিত উদ্ধৃতি তুলে ধরার লোভ সামলানো গেল না - ‘…… আসলে কি জানিস, এই দাম্পত্য জীবনে একজন আরেকজনের কাছে কখনও সম্পূর্ণ এবং যথেষ্ট নয়। এটা এমন একটা সম্পর্ক যেখানে, যা আছে তা এত বেশি গৌণ আর যা নেই তা এত বেশি মুখ্য, যা থেকে মুক্তি পাওয়া মুশকিল’। গল্পের চরিত্রদের মুখ দিয়ে এমনই সব নিখাদ সত্য, যা সচরাচর থেকে যায় অব্যক্ত - উচ্চারিত হয়েছে নিখাদ নির্বিকল্পে। ‘দুই দুগুণে চার’ - দীর্ঘ তিরিশ পৃষ্ঠার জমজমাট বড় হল্প। ‘এক বসা’য় শেষ না করে উঠে যাওয়া যায় না। অনবদ্য বুনোট, যেন এক অদৃশ্য সুতোয় ধরে রাখা পুতুল নাচের পুতুল। ‘অঞ্জনাভ আঁখি’ একটি অসাধারণ মানসিক টানাপোড়েনের টানটান গল্প। গল্পের জমাট বুনোট গল্পকারকে এক অনতিক্রম্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম। শেষটাও যথাযথ। গ্রন্থের শেষ গল্প ‘স্বদেশের চালচিত্র’। দেশভাগ এবং পরবর্তী প্রেক্ষাপটের উপর এক দুঃখবোধের গল্প হলেও শুধু দুঃখবোধই নয়, এর ভেতরে গল্পকার পাঠক মননে তুলে ধরেছেন একাধিক জিজ্ঞাসাও। ধর্ম ও ভাষার নিরিখে সংখ্যালঘু মানুষের এক বিচিত্র সামাজিক ও মানবিক আবহের সৃষ্টি করেছেন গল্পকার।
এছাড়াও ‘রিলে রেস’, ‘বজ্রগুণন (১)’, ‘পোড়ামুখী (২)’, ‘অবিনাশ রায়ের বাড়ির সন্ধানে’, ‘ঝি নয়, বোনঝি’, ‘ক্যানভাসে ধূসর ছবি’, ‘স্বপ্নের টেবিল’, ‘একটি অঘটন’ ইত্যাদি গল্পও এক কথায় অনবদ্য এবং ভিন্ন ভিন্ন আবহে আপন স্বকীয়তায় উজ্জ্বল।
সব মিলিয়ে বিচিত্র মানব মনের অসাধারণ সব অনুভব, অনুভূতির গল্প সংকলন - ‘বিকেলের মোহনায়’। মজলিশ বইঘর থেকে প্রকাশিত সংকলনের দারুণ এবস্ট্র্যাক্টে শিরোনামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী উদয়ন বিশ্বাস। বানান/ছাপার ভুল কিছু আছে যদিও সংকলনের বিশালতার মাপকাঠিতে তা নগণ্যই বলা যায়, কিন্তু ‘অবৈধ’ গল্পের পুরো প্রথম পরিচ্ছদটি অনবধানতায় মুদ্রিত হয়েছে দু’বার। এর বাইরে ঝকঝকে ছাপা ও বর্ণ-শব্দ-বাক্য বিন্যাস যথাযথ। এ অঞ্চলের গল্প সংকলন সমূহের তালিকায় ‘বিকেলের মোহনায়’ নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী সংযোজন হয়ে থাকবে এমন প্রত্যয় রাখাই যায় নির্দ্বিধায়।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
‘বিকেলের মোহনায়’সজল পাল
মূল্য - ২৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮৭৬৮৩৬১৮৩
ভাষার সাবলীল বিন্যাসে গভীর মনস্তত্বের একটি অসাধারণ গল্প সংকলন।
ReplyDelete